প্রবন্ধ
শ্রমিকের অধিকার------মে দিবস
ঋষিরাজ দাস
মুক্তধারা
"প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয়
অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
চিমনি মুখে শোনো সাইরেন- শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে,
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালবাসতে।"
----মে দিবসের কবিতা, সুভাষ মুখোপাধ্যায়
১৮৮৬ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে যে ঐতিহাসিক শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল সেই আন্দোলনের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি ছিল ৩ রা এবং ৪ ঠা মেতে। এই দুটি দিনই ছিল বেশ ঘটনাবহুল। কিন্তু আমরা জানি, এই গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিন থাকা সত্ত্বেও ১লা মে-কেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রশ্ন হল কেন ? ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, শ্রেণীগতভাবে কোনো আন্দোলনই হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। বাধ-প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে আন্দোলন। মে দিবসের আন্দোলনও ঠিক তেমনি একটি আন্দোলন। প্রচুর শ্রমিক একত্রিত হয়ে প্রথম থেকেই আন্দোলন করেছে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। এর পিছনে ছিল দীর্ঘ প্রস্তুতির ইতিহাস। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলিতে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিকদেরকে অতি মুনাফার লোভে মালিকেরা অমানুষিকভাবে ১০ ঘন্টা, ১২ ঘন্টা ,১৬ ঘন্টা কখনও বা ১৮ ঘণ্টা খাটাতো। তার উপরে ছিল মজুরি সংকোচন। কিন্তু মালিকদের লক্ষ্য ছিল কেবল মুনাফা, মুনাফা আর মুনাফা। বহুদিন ধরে চলে আসা এই অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণী মুখরিত হতে শুরু করেছিল উনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে। ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় "আমেরিকান ফেডারেশন অব্ লেবার"। সেখানে ১৮৮৪ সালের ৭ই অক্টোবর এক সম্মেলনে গৃহীত হলো এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। বলা হলো ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকে সমস্ত শ্রমজীবী মানুষ ৮ ঘন্টার বেশি কাজ আর করবে না। আমেরিকার আইনসভায় এটি পাস হলো বটে কিন্তু কার্যকরী হলো না। ১৮৮৫ সাল থেকেই আট ঘন্টা শ্রমদিবস এর দাবিতে ক্রমশ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। ধর্মঘটের পর ধর্মঘট, মিছিলের পর মিছিল, দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো সংগ্রামের ডাক। অবশেষে এলো সেই ঐতিহাসিক ১৮৮৬ সালের ১লা মে শ্রমিক আন্দোলনের দিন। একত্রিত হল প্রায় ৫ লক্ষ্যের বেশি শ্রমিক। তাদের ঐক্যবদ্ধতা দেখে পিছনে সরে দাঁড়ালো মালিকপক্ষ। প্রথম দু দিন ছিল যথেষ্ট শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। কিন্তু ৩ রা মে থেকে শ্রমিক আন্দোলনের মোড় ঘুরে গেল।"ম্যাককমী হারভাস্টার " নামে একটি কারখানার সামনে পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর ঘটলো বর্বর পুলিশি আক্রমণ। নির্বিচারে চলল শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ। প্রাণ হারালো নির্দোষ, নিরস্ত্র ৬ জন শ্রমিক। পরদিন ৪ঠা মে শিকাগো শহরের বিখ্যাত 'হে মার্কেট স্কোয়ার' - এ জমায়েত হয়েছিল হাজার হাজার শ্রমিকের দল তাদের সুবিশাল এক প্রতিবাদ সভায়। পুনরায় চলল বর্বর পুলিশি আক্রমণ। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে লুটিয়ে পড়ল অসংখ্য শ্রমিকের দেহ। শহীদের রক্তে রঞ্জিত হলো 'হে মার্কেট স্কোয়ার'-এর প্রশস্ত পথ। পুলিশের বিরুদ্ধে আক্রমণের অজুহাতে গ্রেফতার করা হল চারজন শ্রমিক নেতাকে। তারা হলেন অ্যালবার্ট পার্সনস, অগাস্ট স্পাইস, অ্যাডলফ ফিশ্চার এবং জর্জ এঙ্গেল। এরপর বিচারের নামে প্রহসন শেষ হলে এই চারজন শ্রমিক নেতার ফাঁসির আদেশ জারি হলো। ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর তাদের ফাঁসির আদেশ কার্যকরী করা হলো। চারজন শ্রমিক নেতার ফাঁসির প্রতিবাদে ঝড় উঠল সারা দেশ জুড়ে।সভায়, শোভাযাত্রায় ধিক্কার বাণী উচ্চারিত হল শ্রমিক শ্রেণীর সংগঠনের কন্ঠে। দেশ, কালের গণ্ডী পেরিয়ে সেই নৃশংস বর্বরতার খবর পৌঁছে গেল দুনিয়ার মেহনত করা শ্রমজীবী মানুষের কাছে। অবশেষে ১৮৮৯ সালের ১৪ ই জুলাই ফরাসি বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনের প্রথম দিনই সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব পাস করা হলো যে ১৮৯০ সাল থেকে ১ লা মে , যেদিন ঐতিহাসিক শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই ১লা মে-কেই শ্রদ্ধায় স্মরণ করে প্রতিবছর ১লা মে তে শ্রমিক শ্রেণীর আন্তর্জাতিক সংহতি ও সৌভ্রাতৃত্ব এবং সংগ্রামের দিন বলে ওই দিনটিকে পালন করা হবে। এভাবেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস রূপান্তরিত হয় ১৮৯০ সালের আন্তর্জাতিক মে দিবসে বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে। এরপর থেকে গ্রেট ব্রিটেন, ল্যাটিন আমেরিকা, ফ্রান্স ,রাশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে শ্রমিকদের ৮ ঘন্টার কাজের দাবি মেনে মে দিবস পালিত হয়। আবার ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে কম্যিউনিস্টরা প্রথম মে দিবস উদযাপন করে। এই ধারায় আজ এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ,ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশগুলির সর্বত্র ছোটো-বড়ো দেশজুড়ে মে দিবস পালিত হচ্ছে। প্রসঙ্গত, ভারতে মে দিবসের সূচনা ঘটে ১৯২৩ সালের ১লা মে-তে। মাদ্রাজের সমুদ্র-সৈকতে শ্রমিক নেতা "সিঙ্গারা ভেলুচেটিয়া"-এর সভাপতিত্বে ভারতে মে দিবস পালিত হয়েছিল।
মে দিবস হল দুনিয়ার মেহনত করা মানুষদের সংকল্প গ্রহণের দিন। সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্রেণী বৈষম্যের পুজিবাদী দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য শ্রমিকদের এক দৃঢ় অঙ্গীকারের দিন। মে দিবস আজ আর শ্রমিকদের কাজের ঘন্টা, কাজের সময় কমানোর আন্দোলন নয়। মে দিবস আজ দুনিয়ার মেহনত করা মানুষের সংগ্রামের দিন, সৌভ্রাতৃত্বের দিন। কিন্তু এত আন্দোলন সত্বেও আজও শ্রমিক শ্রেণীর একটি বৃহৎ অংশ পুজিবাদী দাসত্বের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। আজও শ্রমজীবী মানুষ নিপীড়িত, বঞ্চিত এবং অন্নহীন। তাই ,আজ, এই মে দিবসে আমাদের উচিত শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় সংকল্পবদ্ধ হওয়া। তাই শেষে, শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পাইসের ফাঁসির পূর্বে শেষ উচ্চারিত উক্তিকে ধার করে বলতে পারি------
"You may strangle this voice
but there will be a time when our silence will be more powerful than the voices you strangle today."
নতুন বন্ধু
সপ্তম শ্রেণী
কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠ খড়দহ
মজুমদার ভিলা, কল্যাণ নগর, খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা।
Comments :0