Post Editorial

চাল ও কাঁকড় আলাদা হলো না সকলেই ভুক্তভোগী, দায়ী কে

উত্তর সম্পাদকীয়​

কলকাতা হাইকোর্টের রায় নিয়ে রাজ্য তোলপাড়। দুর্নীতির অভিযোগে ২৫৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল। চাল ও কাঁকড় আলাদা করতে না পারার ফলে সকলেই ভুক্তভোগী!
রাজ্যের বহু স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা অথবা শিক্ষাকর্মী তারা চাকরি হারালেন। যদিও একথা সত্য ২৫৭৫৩ জনই দুর্নীতি করে চাকরি পায়নি। হ্যাঁ এটা ঠিক এর মধ্যে সাদা খাতা জমা দিয়ে অনেকেই চাকরি পেয়েছে, র্যা ঙ্ক জাম্প করে অনেকেই চাকরি পেয়েছে, পরীক্ষা না দিয়ে চাকরি পেয়েছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনেকে নিয়োগ পেয়েছে, কাস্ট সার্টিফিকেট জাল করে চাকরি পেয়েছে বি এড ডিগ্রি কিনে চাকরি পেয়েছে এরকম ১৭ রকম দুর্নীতি ঘটেছে। জানা যাচ্ছে এই সংখ্যাটাই সিংহভাগ।
তার সাথে ‌অবশ্যই স্বচ্ছভাবে চাকরি  পাওয়া মানুষও অনেকে  আছেন। 
স্বচ্ছভাবে যারা চাকরি পেয়েছিল তারা তো বিপদে পড়লই তার সাথে সাথে অসুবিধায় পড়লো রাজ্যের স্কুলগুলো। বিপদে পড়লো রাজ্যের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, আমাদের  আগামী প্রজন্ম। রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে লজ্জার দিন! তণমূলের লুটের রাজত্বে, নেতাদের টাকার নেশায়  শিক্ষাঙ্গনও কলুষিত হলো। গোটা শিক্ষক সমাজ সম্পর্কে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একটা ‌অশ্রদ্ধার প্রভাব প্রভাব ফেলে দিল মমতা ব্যানার্জির সরকার।
স্বচ্ছভাবে চাকরি পাওয়া প্রার্থীরা  কি দোষ করেছিল বলুন তো মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী? কি  দোষ ছিল স্কুলের পড়ুয়াদের যে তারা যোগ্য  দিদিমণি মাস্টারমশাইদের হারালো? এত লোভ? এত চুরি? চুরি প্রমাণিত হওয়ার পরও কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চ ডিভিসন বেঞ্চ যখন বলেছিল অযোগ্যদের বাদ দিতে তখন আপনি সুপ্রিমকোর্টে গেলেন। সেই দিন অযোগ্যদের বাদ দিলে আজকে এই সমস্যা পড়তে হতো না। 
এর পর খোদ স্কুল সার্ভিস কমিশন বলেছে অবৈধ নিয়োগ হয়েছে। নবম দশম শ্রেণির ক্ষেত্রে ৯৫২ ও একাদশ দ্বাদশ শ্রেণির ক্ষেত্রে ৯০৭ টি  গ্রুপ সি ৭৮৩, গ্রুপ ডি ১৭৪১ টি সাদা OMR বা ম্যানুপুলেটেড OMR প্রকাশ্য এসেছে। সাদা OMR-এ চাকরি পেয়েছে এটা খোদ স্কুল সার্ভিস কমিশনের ওয়েব সাইটে প্রকাশ হয়েছে। এটা কেবল OMR দুর্নীতি। আরো অনেকভাবে দুর্নীতি হয়েছে। সব মিলে সংখ্যা কত তার কোনও স্পষ্ট হিসাব নেই। কাস্ট সার্টিফিকেট জালিয়াতি করা হয়েছে। ইচ্ছা মতো ইন্টারভিউতে নাম্বার দেওয়া হয়েছে। এই সব দুর্নীতি স্কুল সার্ভিস কমিশন স্বীকার করেছে। এমন ‌অনেকরকম দুর্নীতির কথা হাইকোর্ট নিজেই বলছে। তাদের চাকরি বাতিলও হয়েছিল। তাদের মাইনে বন্ধ হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টে স্টে পাওয়ার  পরই তাদের আবার যুক্ত করা হলো। বেতন চালু করল। এমনকি এরিয়ারও দিল।  অযোগ্যদের সরকারের টাকা  দিলেন কেন? 
এরপর এই মামলা চলাকালীন দেখা গেলো নবম দশম শ্রেণির শিক্ষকের ক্ষেত্রে ১৫৩৯ জন, একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে ১৯৯ জন গ্রুপ সি এর ৬৯৯ জন গ্রুপ ডি তে ৪১৬ জন কে অতিরিক্ত নিয়োগ করেছে। এরা প্যানেলেই ছিল না। পরীক্ষা দেয়নি অনেকে। ( এদের সবার মাইনের টাকা ফেরত দিতে বলেছে কোর্ট, ১২% সুদ সহ)। এই তথ্য তো স্কুল সার্ভিস কমিশন নিজেই ঘোষণা করেছে। এরা অযোগ্য প্রমাণিত হয়ে যাবার পরেও এদের হয়ে কেন গলা ফাটাবে মমতা ব্যানার্জি? 
এরপর এই মামলা চলাকালীন জানুয়ারি মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত একাধিকবার বিচারপতিরা বলেছেন । অযোগ্যদের যে স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রকাশ করেছে তা বাদে বাকিরা কি সবাই স্বচ্ছ? তার হলফনামা কমিশন কে দিতে হবে। কিন্তু রাজ্য  সরকার, স্কুল সার্ভিস কমিশন সে কাজটি করল না।  কেন করল না? এই মামলা চলাকালীন হাইকোর্ট  সমস্ত চাকরিজীবীদের (এই প্যানেলে পাওয়া, যোগ্য অযোগ্য সবাইকে)  একটি নোটিস পাঠিয়েছিল। তাতে বলা ছিল আপনি যে চাকরি করছেন সেই চাকরির প্যানেলটি কলকাতা হাইকোর্টে বিচারাধীন। আপনার কিছু বলার থাকলে আপনি বলতে পারেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩-এর আগে যে সমস্ত চাকরিজীবীরা এই নোটিস গ্রহণ না করবে পয়লা জানুয়ারি থেকে তাদের বেতন বন্ধ হবে।
কেন করেছিলেন এই সিদ্ধান্ত? কেন সেদিন স্বচ্ছভাবে চাকরি পাওয়া যুবক-যুবতীদের সরকার প্রটেকশন দেয়নি? সরকারের পাপের তো কোনও সীমা নেই। 
কোনও চাকরির পরীক্ষা হওয়ার কুড়ি বছর পর্যন্ত OMR সংরক্ষণ করে রাখার কথা। পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশন তিন বছরের মধ্যে সবটাকে নষ্ট করল কেন?? উত্তর নেই। কমিশন যদি মনে করত স্বচ্ছভাবে চাকরি পাওয়া শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষা কর্মীদের পাশে দাঁড়াবেন তাহলে তারা কোর্টে ফলনামা দিতেন। সেই কাজটি করলে পড়াশুনা করে পরীক্ষায় পাশ করে যোগ্যতার সাথে চাকরি পাওয়ার শিক্ষক-শিক্ষিকা বা শিক্ষাকর্মীদের সাথে এই অপমানজনক ঘটনা ঘটতো না। 
 অযোগ্যদের থেকে চাকরির বিনিময়ে টাকা তোলা হয়েছে, তাই অযোগ্যদের  প্রতি কমিটমেন্ট আছে। অযোগ্যদের প্রতি কমিটমেন্ট দেখাতে গিয়ে যোগ্যদের সর্বনাশ করলেন মমতা ব্যানার্জি। 
তৃণমূল নেতারা কিভাবে চুরি করল একটু বিস্তারিত বলা যাক। 
বামফ্রন্ট সরকারের সময় স্কুল সার্ভিস কমিশন তৈরি হয়। সেই সময় স্কুল গুলি শিক্ষক নিয়োগ হতো RLST ( Regeonal Lavele Selection Test)   এর মাধ্যমে।  পশ্চিমবঙ্গ ৫টা রিজিওনালে ভাগ করে পরীক্ষা নেওয়া হতো যাতে প্রান্তিক অংশের স্কুল গুলিতে ও ভালো ভাবে শিক্ষক নিয়োগ করা যায়। এই সরকার এসে প্রথমেই সেটা ভেঙে SLST ( State Lavele Selection Test)  করল। ফলে প্রান্তিক গ্রামের স্কুল গুলিতে শিক্ষক পাওয়ার সমস্যা আছে। আর কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা করেই দুর্নীতি করা যায় তার জন্যই এই ব্যবস্থা। 
২০১৬ সালে পরীক্ষা নোটিফিকেশন হয়।  পরীক্ষাও হয় ২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর ও ৪ ডিসেম্বর  । ২০১৭ সালের মে-জুন মাস নাগাদ ফল বেরোয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে নিয়োগ শুরু হয়। আচমকাই দেখা যায় নিয়োগে গোলমাল। উত্তর দিনাজপুর জেলার দারিভিটার ঘটনা কথা আপনাদের মনে থাকবে। এর পর নিয়োগ বন্ধ। তার পর প্রায় ৬ মাস পর নিয়োগ চালু হয়। আর একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশ্য আসতে থাকে । তৃণমূল নেতা পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী কোনও লিস্টে না থেকেও চাকরি পেয়ে গেলেন। 
শুরু হয় যোগ্য প্রার্থীদের আন্দোলন। ধর্মতলায় প্রেস ক্লাবের সামনে ২৯ দিন অনশন আন্দোলন। তার পর মুখ্যমন্ত্রী আসেন। আশ্বাস দেন। যোগ্যদের নিয়োগ হবে। পরবর্তী সময়ে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ৫ সদস্যের একটি কমিটি তৈরি হয়েছিল।নিয়োগ মাথায় ছিলেন শান্তি প্রসাদ সিনহা। তিনি এখন গ্রেপ্তার হয়ে জেলে বন্দি। এই ৫ সদস্যের কমিটির মাধ্যমে লিস্টে পিছনে থাকা প্রার্থীরা চাকরি পায়,  ফেল করা লোকজনও চাকরি পায়। যাদের স্বচ্ছতা আনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাদের নেতৃত্বেই চুরি চললো দেদার। 
আর এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে  রাজ্যজুড়ে গণআন্দোলন শুরু হলো চাকরি প্রার্থীদের। একাধিক মামলা হয় আদালতে। আদালতের নির্দেশ সিবিআই, ইডি তদন্ত করছে। প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতার  বাড়ি থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা ছাড়াও প্রচুর সম্পত্তি উদ্ধার হচ্ছে।  টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের সংখ্যাটাও বিরাট। মাথাপিছু ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা দিয়েছেন এরা, এমন কি এর থেকেও বেশি এমনও শোনা যায়।ফলে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, আসলে ঠিক কত টাকার বেনিয়ম হয়েছে। যা উদ্ধার হয়েছে তা তো সামান্য। 
প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, উপদেষ্টা শান্তি প্রসাদ সিনহা পর গ্রেপ্তার হয়েছেন মধ্য শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান কল্যাণময় গাঙ্গুলি, প্রাক্তন স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ও উত্তর বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুবীরেশ ভট্টাচার্য। তৃণমূলের যুব নেতা কুন্তল শান্তনু, সহ কালীঘাটের কাকু সুজয় কৃষ্ণ ভদ্র ( যিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও তার ভাইপো অভিষেক ব্যানার্জির খুব ঘনিষ্ঠ)  এরা সবাই গ্রেপ্তার হয়েছে। 
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ক্যাবিনেট মিটিং-এ সিন্ধান্ত করেছিলেন যাদের ব্যাতিক্রমী নিয়োগ হয়েছে তাদের জন্য সুপার নিউমারিক পোস্ট তৈরি করে এই অযোগ্যদের চাকরি বাঁচাবে। কমিশন এতো নির্লজ্জ যে বলেই দিল যে অবৈধ নিয়োগ হয়েছে তাই সুপারনিমারিক পোস্ট। আদালতে ধমকানিতে সেই পোস্ট প্রত্যাহার করল কমিশন। অযোগ্যদের বাদ দিয়ে কেবল যোগ্যদের জন্য সুপারনিউমারিক পোস্ট হলে হয়তো একটা কথা ছিল । কিন্তু সরকার তা করবে না। সরকার তো অযোগ্যদের বাদ দিতেই চায় না সরকারের অযোগ্যদের বাঁচানোর এই অনড় মনোভাবের জন্যই আজ এই রায় হলো। 
এই রায়ের পরিপেক্ষিতে কিছু বলাতো থেকে যায়। রায়ের ফলে এটা স্পষ্ট যে শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। রাজ্য সরকার ও স্কুল সার্ভিস কমিশন এই চুরির সাথে যুক্ত। সরকার প্রচুর ছলচাতুরি করে অযোগ্যদের বাঁচাতে চেয়েছে কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এই রায়ের ফলে অযোগ্যরা বাদ যাবে । যোগ্যদের নিয়োগ হবে।। এই কাজ খুব দ্রুত করতে হবে। এই সুযোগ আছে। রাজ্য সরকার আর অসভ্যতা না করে অযোগ্যদের বাদ দিক যোগ্যদের দ্রুত নিয়োগ করুক। বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থী এর রায়ের ফলে অসম্মানিত হলেন। তাদের জীবনে কিছুটা অনিশ্চয়তা এল। দ্রুত  পূনর্মূল্যায়ন হওয়ার পর বর্তমান যারা করছেন তাদের চাকরিতে বহাল করতে হবে।  তাদের সার্ভিস কন্টিনিউ করতে হবে। যারা দুর্নীতি করেছে, যারা চাকরি বিক্রি করেছে  তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
এই রায়তে বলা আছে অযোগ্যদের সুপারনিউমারিক পোস্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে কার উদ্যোগ ছিল তা নিশ্চিত করতে হবে। যুক্তি তর্কে এটা পরিষ্কার যিনি বা যারা দুর্নীতিতে যুক্ত সুপারনিউমারিক পোস্ট তৈরি করতে উদ্যোগী ছিলেন। ফলে অবিলম্বে বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রীকেও সিবিআই ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন। 
এই দুর্নীতির ফলে আমাদের রাজ্যের আগামী প্রজন্ম, আমাদের রাজ্যের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকার। তাই শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগ্য প্রার্থীরাও লড়াই করছে। ১১৪০ দিন রাস্তায় বসে আছে। রোদ, ঝড়,বৃষ্টি, উৎসব সব দিন বসে আছে। হকের লড়াই লড়ার জন্য। এ লড়াই শুধুমাত্র চাকরি প্রার্থীদের নয় আমাদের সকলের। সকলের জন্য শিক্ষা এবং শিক্ষান্তে কাজ এই দাবিতে আন্দোলন আরও জোরালো করতেই হবে। এই কাজ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াইও চালিয়ে যেতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment