অনিন্দ্য হাজরা: নিউটাউন
নিউটাউনের অ্যাকশন এরিয়া-১’র ‘সংকল্প-১ আবাসন প্রকল্প’। রাজ্যের করদাতাদের টাকায় শুরু হয়েছিল এই আবাসন প্রকল্প। অভিযোগ, প্রায় ৮০ শতাংশ তৈরি হয়ে যাওয়া এই প্রকল্পকে বাজারদরের থেকে অনেক কমদামে পবন আগারওয়ালের মালিকানাধীন বেসরকারি নির্মাণ সংস্থা সৃজন গ্রুপের হাতে তুলে দিয়েছে হিডকো।
নিউটাউনের আবাসন শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের বক্তব্য, এই জমিতে নজর ছিল রাজ্যের বর্তমান আবাসন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের। তাই কি চাহিদা থাকলেও প্রকল্পটি শেষ করা হয়নি? উল্লেখ্য, প্রকল্পটির বিপণনের দায়িত্ব দেওয়া হয় পবন আগরওয়ালেরই মালিকানাধীন অপর সংস্থা এনকে রিয়েলটর্সকে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কেন লাভজনক একটি সরকারি প্রকল্পকে কার্যত জলের দরে তুলে দেওয়া হল বেসরকারি গোষ্ঠীর হাতে? তবে কি বিপুল পরিমাণ কাটমানি এর পেছনে কাজ করেছে?
এই গোটা বিষয়টি সামনে আসে ২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। একাধিক সংবাদপত্রে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন দেয় সৃজন গ্রুপ। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, নিউ টাউন অ্যাকশন এরিয়া-১-এ টাউন স্কোয়ার নামে একটি আবাসন প্রকল্প হচ্ছে। গণশক্তি’র তদন্তে উঠে আসে, বিজ্ঞাপিত জায়গাটি সহ লাগোয়া জায়গায় চারটি প্লট চিহ্নিত করেছিল হিডকো। নাম দেওয়া হয়েছিল সংকল্প ১, ২, ৩ এবং ৪। প্রাক্তন আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেব এই প্লটগুলি চিহ্নিত করেছিলেন। সংকল্প ২, ৩ এবং ৪’এ হিডকো আবাসন তৈরি করে এবং সমস্ত আর্থিক স্তরের মানুষের জন্য লটারির মাধ্যমে আবাসন বরাদ্দ হয়। পূর্ণতা পায়নি কেবলমাত্র সংকল্প-১।
এই আবাসান প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১২সালে। ২০১৬সাল নাগাদ, অর্ধেকের বেশি তৈরি অবস্থায় আবাসনটিকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। সেই স্মৃতি এই এলাকা দিয়ে যাতায়াত করা নিত্যযাত্রী ও স্থানীয়দের মনে এখনও টাটকা।
কাজ এতদূর এগনোর পরেও, কেন হিডকোর এই বহুমূল্য প্রকল্প সৃজন গ্রুপের হাতে তুলে দিল হিডকো কর্তৃপক্ষ? কার স্বার্থে?
তথ্য বলছে, ২০২২সালের ৫মে হিডকো টেন্ডার ডেকে প্রকল্পটি সৃজন গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছে। এই টেন্ডারের নম্বর হলো, ১০০৩/হিডকো/এডিএমএন-৩৯৩৪/২০২২। সেই ই-টেন্ডারে অংশ নেয় তিনটি সংস্থা। ১৮১ কোটি টাকার বিনিময়ে টেন্ডার পায় পবন আগারওয়ালের মালিকানাধীন সৃজন গোষ্ঠী।
সৃজন গ্রুপের দেওয়া বিজ্ঞাপন অনুযায়ী দেখা যায়, ২০২২ সালের ১৭সেপ্টেম্বর আবাসনের ফ্ল্যাটের ন্যূনতম দাম ছিল ২.৩কোটি টাকা। মাত্র চারদিন পরের বিজ্ঞাপনেই ন্যূনতম দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২.৩৪ কোটি টাকা।
আবাসন শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের বক্তব্য, সংকল্প-১ প্রকল্পের নির্মাণের কাজ ৭০শতাংশের বেশি শেষ হয়ে গিয়েছিল। পাঁচটি টাওয়ারের নির্মাণ পুরোপুরি হয়ে গিয়েছিল। বাকি ছিল কেবলমাত্র জল, নিকাশী, লিফট এবং কমিউনিটি হল তৈরির মতো ন্যূনতম কাজ। টাওয়ার ১ থেকে ৫’র ২৫৯টি ফ্ল্যাট সৃজন গোষ্ঠীকে প্রকল্প বরাত দেওয়ার আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। টেন্ডার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই ফ্ল্যাটগুলির মোট বিক্রয়যোগ্য আয়তন ৫লক্ষ ৬৬হাজার ৪৭৬ স্কোয়ার ফিট। এর মধ্যে ১৩৮টি হায়ার ইনকাম গ্রুপ ইউনিট, ১০৬টি ডুপ্লেক্স এবং ১৫টি পেন্টহাউস। জমির মোট পরিমাণ ৬.২৯ একর।
সৃজন গোষ্ঠীর বিজ্ঞাপন অনুযায়ী সংকল্প ১ প্রকল্পে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, স্কোয়ার ফুটের গড় দাম ১২,৮৯২টাকা। সব মিলিয়ে ৭৩০কোটি টাকার কিছু বেশি। এর সঙ্গে গ্যারেজ এবং কার পার্কিংয়ের জায়গা বিক্রির দাম আলাদা। অর্থাৎ কোন অজ্ঞাত কারণে ৭৩০কোটি টাকারও বেশি দামের প্রকল্প মাত্র ১৮১কোটি টাকায় সৃজন গ্রুপের হাতে তুলে দিয়েছে হিডকো।
সৃজন গ্রুপকে মুনাফা পাইয়ে দেওয়া এখানেই শেষ নয়। টেন্ডারের ১৫ নম্বর পাতায়, স্পষ্ট বলা হয়েছে, প্রকল্পের এফএআর’র উপরে ২০শতাংশ অবধি অতিরিক্ত এফএআর অনুমোদিত। এর মোট আয়তন এক লক্ষ ৮৫ হাজার স্কোয়ার ফিট। কিন্তু ছাড়ের ঊর্ধ্বসীমাকে লংঘন করেই আরো দুটি টাওয়ার তৈরি করেছে সৃজন গ্রুপ। আগ্রহী ক্রেতাদের দেওয়া সৃজন গোষ্ঠীর ব্রোসিওর অনুযায়ী, টাওয়ার ৬’তে রয়েছে ৪৮টি ফ্ল্যাট, এবং টাওয়ার ৭-এ রয়েছে ৫০টি ফ্ল্যাট। সব মিলিয়ে ৯৮টি ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটগুলির আনুমানিক বিল্টআপ এরিয়া ২৬৩৪ ফিট। ৯৮টি ফ্ল্যাটের হিসাব ধরলে ২লক্ষ ৫৮ হাজার ১৫১স্কোয়ার ফিট। ১২,৮৯২টাকা স্কোয়ার ফিট পিছু হারে বিক্রি করলেও ৯৮টি ফ্ল্যাট বিক্রির মোট পরিমাণ ৩৩০কোটি টাকা। এটি সৃজন গোষ্ঠীর ন্যূনতম বাড়তি আয়। যদিও এরথেকে বেশি দামে স্কোয়ার ফিট বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সৃজন গোষ্ঠী ১৮১ কোটির বিনিময়ে যে ৬.২৯ একর জমি পেয়েছে, টেন্ডারে বলা না থাকলেও টাওয়ার ছয় এবং সাত সেখানে তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ, নতুন টাওয়ার দুটির জমি এক প্রকার বিনামূল্যে পেয়েছে সৃজন গোষ্ঠী। আবাসন শিল্পের সঙ্গে যুক্তরা বলছেন, সবথেকে ভালো কাঁচামাল দিয়ে ফ্ল্যাট তৈরি করলেও, তার খরচ স্কোয়ার ফিট পিছু তিন হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।। সহজেই অনুমান করা যায় সৃজন গোষ্ঠীর মুনাফার হার।
রাজারহাটের অ্যাকশন এরিয়া-১ লাগোয়া একটি আবাসনও অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে নেই। গড়ে ফ্ল্যাটপিছু আড়াই-তিন কোটি টাকা হারে আবাসন বিক্রি হয় এই অঞ্চলে। তারপরেও ডব্লিউবিআইএফডিসি’র টাকায় তৈরি এই প্রকল্প পূর্ণতা না পাওয়া অস্বাভাবিক।
এই গোটা বিষয়টি নিয়ে হিডকো’র কাছে আরটিআই করা হয়। হিডকো তথ্য জানার অধিকার আইনের ৮(১)(ডি) ধারা ব্যবহার করে ‘বাণিজ্যিক গোপনীয়তা’র উল্লেখ করে এবিষয়ে উত্তর জানাতে অস্বীকার করেছে।
NEWTOWN HOUSING SCAM
নিউটাউনে সরকারি আবাসন প্রকল্প জলের দরে বেসরকারি হাতে
×
Comments :0