ENVIRONMENT

পরিকল্পনা মাফিক নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে ধ্বংস করার পথে কেন্দ্র

জাতীয়

নিকোবর দ্বীপের ‘উন্নয়ন’ পরিকল্পনা খাতে ৭২,০০০ কোটির কেন্দ্রীয় বরাদ্দ বিষয়ে সিঁদুরে মেঘ দেখছেন পরিবেশবিদ, গবেষকরা।  এই দ্বীপের শম্পেন (Shompen) উপজাতিদের সংখ্যা ২০০’র কিছু বেশি এবং নিকোবারিজ (Nicobarese) জাতির সংখ্যা প্রায় ১,০০০। একত্রে, তারা ‘গ্রেট নিকোবর’এর ৮,০০০-এর কিছু বেশি জনসংখ্যার এবং প্রায় ১৫ শতাংশের আশেপাশে। ১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত এরাই গ্রেট নিকোবরের একমাত্র বাসিন্দা ছিল যখন মূল ভূখণ্ড ভারত থেকে বসতি স্থাপনকারীদের এখানে আনা হয়েছিল।
শম্পেনদের সরকার একটি "বিশেষভাবে দুর্বল উপজাতীয় গোষ্ঠী" (Particularly Vulnerable Tribal Groups) হিসাবে তালিকাভুক্ত করেছে, যারা প্রাক-কৃষি স্তরের প্রযুক্তি, নিম্ন স্তরের সাক্ষরতা এবং একটি ক্রমহ্রাসমান বা এক জায়গায় আটকে থাকা জনসংখ্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

নিকোবরের প্রায় ৮৫৩ বর্গ কিমি আন্দামান ও নিকোবর প্রটেকশন অফ অ্যাবোরিজিনাল ট্রাইবস রেগুলেশন, ১৯৫৬-এর (Andaman and Nicobar Protection of Aboriginal Tribes Regulation) অধীনে একটি উপজাতী সংরক্ষিত জায়গা হিসাবে মনোনীত। এর মানে হল যে এই স্থান এই সম্প্রদায়ের একচেটিয়া ব্যবহারের জন্য এবং প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া অন্যরা এই অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে না।  
‘গ্রেট নিকোবর’ প্রকল্প (Great Nicobar project) নীতি আয়োগ দ্বারা পরিচালিত, ৩৫,০০০ কোটি টাকার একটি ট্রান্স-শিপমেন্ট পোর্ট, একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, একটি টাউনশিপ এবং ১৬০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জমিতে বিস্তৃত পর্যটন পরিকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা। এর মধ্যে ১৩০ বর্গ কিমি প্রাথমিক বনও যুক্ত রয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে ৮৪ বর্গ কিমি, বা উপজাতি সংরক্ষিত এলাকার প্রায় ১০ শতাংশ, যা এখন পরিবেশ মন্ত্রকের দ্বারা অনুমোদিত চূড়ান্ত পরিবেশের প্রভাব মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুসারে বাতিল করা হবে। 

প্রকল্পটি পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল দ্বীপটির  বর্তমান  জনসংখ্যা ৮,০০০ থেকে আগামী তিন দশকের মধ্যে ৩.৫ লাখের বেশি বৃদ্ধি করতে চাইছে, যা আদতে ৪০০০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি। এটি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সমগ্র জনসংখ্যার চেয়ে সামান্য কম, যা ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ৩.৮ লক্ষ ছিল।
অশোকা ট্রাস্ট ফর রিসার্চ ইন ইকোলজি অ্যান্ড এনভয়রনমেন্টের (Ashoka Trust for Research in Ecology and Environment) গবেষক এবং পরিবেশ মন্ত্রকের সাবেক সদস্য শরদ লেলে বলেছেন, এই প্রকল্প এবং দ্বীপের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রস্তাবটি ‘‘আদিবাসী সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার পরিকল্পিত ধ্বংস সাধন’’। 
২৭ অক্টোবর, পরিবেশ মন্ত্রক প্রকল্পটির জন্য নীতিগত বা প্রথম পর্যায়ের বন ছাড়পত্র মঞ্জুর করে এবং তারপরে ৪ নভেম্বর চূড়ান্ত পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে পরিবেশের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন, যার ভিত্তিতে চূড়ন্ত পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল, উপজাতি সম্প্রদায়টির সম্পর্কে ভুল বোঝাপড়ার প্রতিফলন ছাড়াও বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ।

পিকে মিশ্র, ভারতীয় নৃতাত্ত্বিক সমিতির (Indian Anthropological Association) সভাপতি এবং ভাষাবিদ আনভিতা আবি সহ শীর্ষস্থানীয় গবেষকরা জানুয়ারিতে দাখিল করা একটি রিপোর্টে এই বিষয়ের উপর জোর দিয়েছিলেন। 
রিপোর্টটি হায়দ্রাবাদ-ভিত্তিক ভিমতা ল্যাবসের (Vimta Labs) তৈরি করা এই প্রকল্পের জন্য পরিবেশের ওপর প্রভাব সম্পর্কিত মূল্যায়ন প্রতিবেদনের যে খসড়া, তার প্রতিক্রিয়ায় তৈরি। গবেষকরা বেশ কিছু উদ্বেগ তুলে ধরেন যেমন শম্পেন উপজাতির প্রয়োজনীয় বন সম্পদের ধংস, বিভিন্ন রোগের সংস্পর্শে আসার আশঙ্কা এবং বহিরাগতদের আগমনের কারণে সাস্কৃতিক অবক্ষয়। এটি তাদের "স্থানিক পরিচয়" এবং "স্থানিক সংযুক্তি"কে দুর্বল করবে এবং এর ফলে তারা তাদের "স্বাস্থ্য, জাতিগত এবং ধর্মীয় ঐতিহ্য" নষ্ট হবে। 


যদিও, মার্চ মাসে প্রকাশিত প্রকল্পের জন্য চূড়ান্ত পরিবেশগত প্রভাব সংক্রান্ত রিপোর্টে যাবতীয় বিষয়কে শুধু উপেক্ষাই করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, উপজাতি সংরক্ষণের এলাকা ৭৫১ বর্গ কিমি হিসাবে রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে ২০১৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে জমা দেওয়া একটি হলফনামায় দ্বীপ প্রশাসন জানিয়েছে যে এলাকাটি ৮৫৩ বর্গ কিলোমিটার।
প্রতিবেদনে উপজাতি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ভুল রয়েছে এবং এমনকি ৪০টি জায়গায় সম্প্রদায়ের নামেরই বানান ভুল রয়েছে। 

অবসরপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় অর্থ সচিব ইএএস শর্মা ‘গ্রেট নিকোবর প্রকল্পের’ অনুমোদন দেওয়ার সময় তফসিলি উপজাতিদের জন্য জাতীয় কমিশনকে (National Commission for Scheduled Tribes ) বাইপাস করে প্রকল্পের অনুমোদন দেোয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ১৫ নভেম্বর পরিবেশ মন্ত্রী ভূপেন্দর যাদবের কাছে একটি চিঠিতে, শর্মা বলেছিলেন যে কেন্দ্র এবং রাজ্যগুলি তফসিলি উপজাতি সম্পর্কিত বিষয়ে কমিশনের সাথে পরামর্শ করতে বাধ্য।
কোয়েম্বাটোর-ভিত্তিক আদিবাসী অধিকার গবেষক এবং কর্মী সিআর বিজয় দাবি করেছেন যে বন অধিকার আইন, ২০০৬ অনুসারে, শম্পেনরা নিজেরাই আদিবাসী সংরক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনার জন্য একমাত্র আইনগতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ।
তিনি আরও বলেন যে প্রকল্পটি তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতি (অত্যাচার প্রতিরোধ) আইনও লঙ্ঘন করে। আইনটি জোর করে জমি দখল এবং সাধারণ সম্পত্তির অধিকারে বাধা প্রদানের পাশাপাশি বন, ভূমি এবং জল সহ বিভিন্ন অধিকারে হস্তক্ষেপকে স্বীকৃতি দেয়।
কিন্তু সরকারী সংস্থাগুলি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার জন্য যাবতীয় ভুলত্রুটি ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে।

উদাহরণ স্বরূপ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রকল্পের তরফে  আন্দামান ও নিকোবর প্রশাসনের আদিবাসী কল্যাণ দপ্তরকে অগাস্ট ২০২১-এর একটি চিঠিতে বলা হয়েছে যে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষিত হবে। কিন্তু সাথে  এটিও যোগ করা হয়েছে যে, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় যেকোনো ‘‘ছাড়’’ চাইতে পারবে ‘‘যখনই কোন ছাড়ের’’ প্রয়োজন হবে ‘‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য’’।
কেন্দ্রীয় উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রক এবং নীতি আয়োগও একই ধরণের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। ‘গ্রেট নিকোবরে’ উপজাতি ইস্যুতে বিশদ জানতে চাওয়া তথ্যের অধিকারের আবেদনের জবাবে, ৭ নভেম্বর উপজাতি মন্ত্রক বলেছে যে তার কাছে কোনও তথ্য নেই। উলটে মন্ত্রক নীতি আয়োগ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে প্রশ্ন করতে বলেছে।

Comments :0

Login to leave a comment