দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলন। নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, নবান্ন থেকে মুখ্য সচিবের অনুরোধ কোনো কিছুই বিক্ষোভের আগুন নেভাতে পারছে না। বুধবার একের পর এক জেলায় ডিআই অফিসগুলিতে তালা লাগিয়ে, রাস্তা অবরোধ করে, টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা। পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে আহতও হয়েছেন অনেকে, তবুও নাছোড় শিক্ষকরা সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে ‘পেটে লাথি’ মারার জন্য দায়ী করে বলেছেন, ‘অনেক ধাপ্পা শুনেছি, আর নয়। আদালতের কাছে ওএমআর শিট সহ প্রকৃত তথ্য দিয়ে আমাদের চাকরি রক্ষার ব্যবস্থা করুক সরকার।’
কোচবিহার থেকে আলিপুরদুয়ার, বর্ধমান, সিউড়ি, মেদিনীপুর, বারাসত, চুঁচুড়া, বহরমপুর, রায়গঞ্জের কর্ণজোড়া সহ বিভিন্ন জায়গায় চাকরিহারাদের ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে ডিআই অফিস, শিক্ষাদপ্তরের অফিস, জেলাশাসকের অফিসের সামনে। বিক্ষোভের খবর যতো ছড়াচ্ছে ততোই বেশি করে চাকরিহারারা ছুটে এসে বিক্ষোভে যোগ দিচ্ছেন। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তারা আতঙ্কিত, শিক্ষকদের জীবনবাজি রেখে লড়াইয়ের মানসিকতা এবং জনসমাজে তাঁদের প্রতি বিপুল সমর্থন দেখে পুলিশ বেশিরভাগ জায়গায় বলপ্রয়োগে রীতিমতো ভয় পাচ্ছে। সমস্ত ডিআই অফিসগুলিতে ব্যাপক পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করে সেগুলিকে দুর্গের মতো রক্ষা করা হচ্ছে। কোথাও লাঠি নিয়ে তেড়ে গিয়ে, কোথাও হাত জোড় করে আন্দোলনকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেছে পুলিশ। আবার কোথাও পুলিশ নিজেই ডিআই’কে আন্দোলনকারীদের সামনে হাজির করিয়ে বলিয়েছে, সমস্যা সমাধানের জন্য বিক্ষোভকারীদের দাবির কথা লিখিতভাবে উর্ধতনের কাছে জানানো হয়েছে। কিন্তু তৃণমূল সরকারের শিক্ষা দপ্তর সহ কোনো দপ্তরের মুখের কথায় চিঁড়ে ভিজছে না। আন্দোলনকারীরা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারের জন্যই আমাদের এই হাল, দুর্নীতিগ্রস্ত পদ্ধতিতে নিযুক্তদের বাঁচাতেই সরকার আদালতকে তথ্য না দিয়ে আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলেছে।
এর মধ্যেই কলকাতার কসবায় শিক্ষকদের ওপরে পুলিশী হামলার খবর পেয়ে বিক্ষোভ আরও চড়া হয়েছে। বুধবারের বিক্ষোভের মেজাজই বুঝিয়ে দিয়েছে, এই আন্দোলন এখনই থামার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং সরকার ‘চাল আর কাঁকড়’ আলাদা করার তথ্য প্রকাশ্যে এনে যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি বাঁচানোর ব্যবস্থা না করলে আন্দোলন আরও তীব্র হতে চলেছে। জেলায় জেলায় রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্যে দাবি উঠেছে, ‘ওএমআর শিটের মিরর কপি বের করো, অযোগ্যদের ছেঁটে ফেলে যোগ্যদের চাকরিতে পুনর্বহাল করো’।
মঙ্গলবারের পর বুধবারও মেদিনীপুর শহর অচল হয়ে যায় একাধিক জায়গায় চাকরিহারাদের বিক্ষোভে। এদিন সাত সকালেই জেলা স্কুল পরিদর্শকের দপ্তরে তালা লাগিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা। বিক্ষোভের জেরে ডিআই সহ কেউই ঢুকতে পারেনি অফিসে। সেখানে পুলিশের চাপ বাড়লে মেদিনীপুর শহর সংলগ্ন ধর্মামোড়ে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ টানা দুঘন্টা। মেদিনীপুর শহরের প্রবেশপথ, কেশপুরগামী চন্দ্রকোনা, দাসপুর ঘাটাল রাজ্য সড়ক অবরুদ্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে মেদিনীপুর শহরের ব্যস্ততম কালেক্টরেট মোড়ের ৬টি লেন দখল করে শিক্ষকরা বিক্ষোভ দেখান, এসএসসি’র প্রতীকি শবদেহ পোড়ান।
বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ বিক্ষোভের জেরে ডিআই তাঁর অফিসে পিছনের দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলে চাকরিহারাদের ক্ষোভ তুঙ্গে ওঠে। ডিআই স্বপন সামন্তকে ঘিরে ধরে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা প্রশ্ন করেন, শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে এবং তিনি পর্যদে ই-মেল পাঠিয়েছেন কিনা! ডিআই জানান, তিনি মেল পাঠিয়েছেন। কিন্তু, এখনও উত্তর আসেনি। তা শুনেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সেই সময় রীতিমতো ঠেলাঠেলি-ধস্তাধস্তি শুরু হয়। ডিআই-কে রুখে দেন শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা। তাঁরা বলেন, 'পিছনের দরজা দিয়ে নয়। সামনের দরজা দিয়েই ঢুকুন। কিন্তু, এক ঘন্টার মধ্যে জবাব দিন!' এরপরই, ডিআই- সহ দু-তিন জন কর্মীকে মেন গেটের তালা খুলে অফিসে ঢুকতে দিয়ে ফের তালা লাগিয়ে বিকাল পর্যন্ত চলে বিক্ষোভ।
এদিকে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার চাকরিহারা প্রায় দুই হাজার শিক্ষকশিক্ষিকা, শিক্ষা কর্মী বুধবার বারাসতের এসএসসি-র দক্ষিণপূর্ব আঞ্চলিক অফিসের সামনে দুপুর ১২টা থেকে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। বিক্ষোভের জেরে উত্তেজনা তৈরি হয়। কেউ কেউ এসএসসি-র অফিসে গেট ধরে টানাটানি করতে থাকেন। পুলিশ এসে উত্তেজিত শিক্ষকদের একাংশকে অফিসের গেটের সামনে থেকে সরিয়ে দেয়। এসএসসি-র চেয়ারম্যান সৌমী দাস শিক্ষকদের কয়েকজনকে অফিসে ডেকে কথা বলতে চাইলে শিক্ষকরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। শিক্ষকদের দাবি মেনে সৌমী দাস অফিসের নিচে নেমে এসে প্রতিবাদী শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন, আশ্বাস দেন তাঁদের দাবিগুলি বিবেচনা করার। প্রতিবাদী শিক্ষক মৃন্ময় মন্ডল জানালেন, আমাদের চাকরি ছেদ হওয়ার জন্য দায়ী এসএসসি এবং রাজ্য সরকার। রাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুতিতে ভুলছি না। আমাদের চাকুরি ফিরে পাব কিনা তা রাজ্য সরকারকে জানাতে হবে। চাকরিহারা শিক্ষকরা এসএসসি’র মূল গেটে তালা দিয়ে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখান।
এদিন বারাসত সরকারী কর্মচারী ভবনের পিছনে যৌথ মঞ্চের আহ্বানে প্রায় ২৫০ শিক্ষকের উপস্থিতিতে শিক্ষক নিযোগে দুর্নীতি ও প্রশাসনে থ্রেট কালচারের প্রতিবাদে এবং ২০ এপ্রিল ব্রিগেড সমাবেশে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিন ঘন্টার অবস্থান কর্মসূচী পালন করা হয়। এদিন চাকরিহারাদের চাকুরি ফেরানোর দাবিতে এসএফআই বিক্ষোভ দেখায় ডিআই অফিসে। ছিলেন সংগঠনের জেলা সম্পাদক আকাশ কর সহ অন্যান্যরা।
এদিন চাকরিহারারা মিছিল করে বর্ধমানে ডিআই অফিসের সামনে জমায়েত হলে পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়। ডিআই অফিসের গেটে তালা ঝোলাতে গেলে পুলিসের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তিতে ধুন্ধুমার বেঁধে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় বিশাল পুলিশবাহিনী ও র্যাতফ। বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে ডিআই অফিস চত্বরে চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে শিক্ষকদের উপর। ডিআই অফিসের সামনের রাস্তা অবরোধ করেন শিক্ষক–শিক্ষিকারা। রাস্তা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে যায়। রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন শিক্ষকশিক্ষিকারা। পুলিসের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষক–শিক্ষিকা আহত ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। আন্দোলনকারীরা বলেন, মন্ত্রী-আমলাদের দুর্নীতির জন্য আমাদের এই অবস্থা। এখন আমরা স্বেচ্ছাশ্রম দিতে স্কুলে যাব কেন? বেলা সাড়ে ৩টে পর্যন্ত রাস্তায় অবরোধ করার পরেও ডিআই’র দেখা না পেয়ে তাঁরা কার্জন গেটের সামনে জিটি রোড অবরোধ করেন।
আলিপুরদুয়ার জেলার চাকরিহারা শিক্ষকরা সকাল থেকেই শহরের প্যারেড গ্রাউন্ডে জড়ো হয়ে সেখান থেকে প্ল্যাকার্ড হাতে মিছিল করে ডিআই দপ্তরে গিয়ে বিক্ষোভ দেখান। দীর্ঘক্ষন বিক্ষোভ দেখানোর পর ডিআই নেমে এসে কথা বলেন শিক্ষকদের সাথে। কিন্তু শিক্ষকদের ছুঁড়ে দেওয়া একের পর এক প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি। ডি আই অফিসে পুলিশ আগে থেকেই তালা মেরে ঘিরে পাহারা বসিয়ে রেখেছিলো। শিক্ষকরা ক্ষোভে এদিন শহরের বি এফ রোডে টায়ার জ্বালিয়ে পথ অবরোধ করেন। কোচবিহার শহরেও জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের দপ্তরের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ কর্মসূচিতে শামিল হল চাকরিহারারা ও শিক্ষা কর্মী অধিকার মঞ্চ-২০১৬ একসঙ্গে। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তাঁরা ডিআই অফিসের সামনে আসেন এবং তারপর রাস্তায় বসে পড়েন। আন্দোলনে এক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এখানেও ডিআই’কে মাইক হাতে নিয়ে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে।
চুঁচুড়ায় হুগলির ডিআই অফিস অভিযানে সামিল হয়েছিলেন চাকরি হারা শিক্ষকরা। হুগলি স্টেশনে জমায়েত করে তাঁরা মিছিল করেন। মাঝে হুগলির মোড়ে জিটি রোড অবরোধ করেন কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আবার মিছিল এগিয়ে যায় পিপুল পাতিতে শিক্ষা ভবনের দিকে। সেখানে শিক্ষা ভবনের গেটে এবং ডিআই অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভ সামলাতে চুঁচুড়া থানা থেকে বিশাল পুলিশ বাহিনী ডিআই অফিসের ভেতরে মজুত করা ছিল। বহরমপুরে ডিআই অফিস ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়ে অফিসের গেটে ঝুলিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। বুধবার দুপুরে চাকরি হারানোর প্রতিবাদে বহরমপুরে ডিআই অফিস অভিযানে শামিল হয়েছিলেন যোগ্য শিক্ষক শিক্ষিকা অধিকার মঞ্চের মুর্শিদাবাদ শাখা। সিভিক শিক্ষক বা ভলান্টারি সার্ভিস নয়, সম্মানের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান তাঁরা। ডিআই’র কাছে ডেপুটেশন দেওয়ার পর বহরমপুরে মিছিল করেন তাঁরা। বুধবার সিউড়ি শহরেও মিছিল হয়েছে চাকরিহারাদের। বাসস্ট্যান্ডে পথ অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে ক্ষোভ উগড়ে দেন এসএসসি ও মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। চাকরিহারাদের মধ্যে বীরভূমেই রয়েছেন ১০২৫ জন। তাঁদের পক্ষ থেকেই এদিন বিক্ষোভ কর্মসূচীর ডাক দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা পথ অবরোধ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের বাধা ভেঙে ডিআই অফিস চত্বরে ঢুকে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। বুধবার সকালে প্রায় তিনঘন্টা বাঁকুড়া জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান বিক্ষোভ চলার পরে ডিআই পীযুষকান্তি বেরা অফিস থেকে বেরিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষক, শিক্ষিকাদের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হন। প্রশাসন প্রথম থেকেই বিশাল পুলিশবাহিনী মোতায়েন করে বাঁকুড়া ডিআই অফিসের গেট বন্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু চাকরিহারা শিক্ষক, শিক্ষিকারা ডিআই’র কাছে জবাবদিহি চাইতে বাঁকুড়া কৃষিভবনে জড়ো হয়ে মিছিল শুরু করেন। মিছিল চার্চমোড়ে যাওয়ার পর তাঁরা পথ অবরোধ করে সেখানে। পরে ফের মিছিল করে তাঁরা ডিআই অফিস যান। সেখানে কিছুটা ধস্তাধস্তিও হয় পুলিশের সঙ্গে তাঁদের। ডিআই অফিসের সামনেই বসে পড়েন তাঁরা। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন অনেকে। কয়েকজন শিক্ষিকা পুলিশের সামনেই গায়ে কেরাসিন তেল ঢালে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার নেয়। তাঁদের এই অনড় মানসিকতা দেখেই শেষ পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসন বাঁকুড়ার ডিআই’কে তাঁদের সামনে নিয়ে আসেন। তবে সহমর্মিতার বেশি কিছুই ডিআই জানাতে পারেননি।
ssc scam
আশ্বাস-অনুরোধে থামেনি বিক্ষোভ, মার খেয়েও চাকরি ফেরানোর দাবিতে অনড়

×
Comments :0