mudabrshiad md selim

দুয়ারে আতঙ্কের গ্রামে বাইকে সেলিম, মীনাক্ষীরা

রাজ্য জেলা

চন্দন দাস: জঙ্গিপুর

দু’টি ঘটনা ঘটেছে। তিন জন নিহত হয়েছেন। দেদার লুট, ভাঙচুর হয়েছে তার একটি জায়গায়। দু’টি ঘটনাতেই রহস্যময় পুলিশের ভূমিকা। 
মমতা ব্যানার্জির অপশাসনের নয়া নজির ‘জঙ্গিপুর চ্যাপ্টার’-এর এটিই অন্তঃসার। 
প্রথম ঘটনায় নিহত হন কাশিমপুরের ইজাজ আহম্মেদ। জাতীয় সড়কের উপরে তিনি গুলিবিদ্ধ হন শুক্রবার। শনিবার প্রত্যন্ত জাফরাবাদে নিহত হন বাবা ও ছেলে যথাক্রমে হরগোবিন্দ দাস এবং চন্দন দাস। কিন্তু এই দু’টি ঘটনার আগে থেকেই, প্রধানত বুধবার থেকে জঙ্গিপুরের বিভিন্ন জায়গায় নানা গুজব রটতে থাকে। ঔরঙ্গাবাদের এক গ্রামবাসীর কথায়, ‘‘কখনও শুনছিলাম কোথাও মন্দিরে হামলা হয়েছে, কখনও শুনছিলাম মুসলমানদের উপর হামলা হয়েছে। বাজারে, রাস্তায় এই নিয়ে আলোচনা চলছিল। আমাদের গ্রামের দুই সিনিয়র থানায় জানান। আইসি বলেন, তিনি কিছু জানেন না, শোনেননি!’’
উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল কয়েকটি মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তি। পুলিশ চুপচাপ জল মাপছিল।
প্রশ্ন— কেন এই ছড়াতে থাকা সাম্প্রদায়িক উসকানিকে পাত্তা দিতে ইচ্ছা হয়নি পুলিশের? কাদের নির্দেশে? 
প্রথম ঘটনা ঘটে জাতীয় সড়কের উপর শুক্রবার, দিনের বেলায়। কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদের নামে একদল উচ্ছৃঙ্খল লোক বাস, লরি পুড়িয়ে দেয়। পুলিশ বেশ কিছুক্ষণ পরে পৌঁছায় ঘটনাস্থলে, অর্থাৎ সাজুর মোড়ে। মামার বাড়ি থেকে ফিরছিলেন এক শিশুকন্যা আরোহী খাতুনের বাবা ইজাজ আহম্মেদ। টোটোয় তিনি একা ছিলেন। সাজুর মোড় থেকে বাঁদিকে সরু রাস্তায় নেমে মিনিট দশেক হাঁটলে তাঁর গ্রাম কাশিমনগর। টোটো আর এগতে চায়নি। ইজাজ নেমেছেন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন সেখানেই। পুলিশের ‘খেলা’ শুরু এরপর। 
‘‘আমার জামাইয়ের দেহ কিছুক্ষণ ওখানে পড়েছিল। তারপর পুলিশ তাকে জঙ্গিপুরের হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার শরীর থেকে বুলেট বের করা হয়। কিন্তু সেখানে রক্ত দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা ছিল না।’’ সোমবার দুপুরে একথা জানিয়েছেন ইজাজের শ্বশুর হাকিম শেখ। 
কিন্তু পুলিশ কী করল? অস্ত্রোপচারের পর প্রয়োজনীয় রক্তের বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব ছিল ‘অনুপ্রাণিত’ পুলিশের। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা রাজীব কুমার সেই সময়ে তা নিশ্চয়ই শিখেছেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তা হয়নি। ইজাজের মা সায়েমা বিবি এক উঠোন লোকের মধ্যে জানালেন, ‘‘পুলিশ বুলেট নিয়ে চলে গেল। রক্তের ব্যবস্থা করল না।’’
পুলিশের সেই বুলেট পকেটস্থ করতে এত তাড়া কিসের? গুলির দায় কার ঘাড়ে চাপিয়ে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছা ছিল পুলিশের? 
এখানেই শেষ নয়। 
স্বরাষ্ট্র (পুলিশ)-র মতোই মমতা ব্যানার্জি স্বাস্থ্য দপ্তরেরও দায়িত্বে। ইজাজের ‘খুন’ স্বাস্থ্য দপ্তরকে উলঙ্গ করে দিয়েছে। 
জঙ্গিপুর হাসপাতাল রক্তের ব্যবস্থা করতে পারেনি। গাড়ির ব্যবস্থাও করেনি। ইজাজের মা বলছেন, ‘‘আমরা গাড়ি চাইলাম একটা। আমার ছেলে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হাসপাতাল বলল, ‘গাড়ির ব্যবস্থা আপনাদের করতে হবে’। আমরা তিন হাজার টাকায় গাড়ি ভাড়া করে বহরমপুর নিয়ে গেলাম। আমার ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না।’’
এই কথা যখন মা বলছেন, পাশে বসা সালমা বিবির তখন দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কোলে শিশু ঘুমোচ্ছে। মায়ের চোখের জল ছোট্ট আরোহীর গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। সালমা বিবি তাঁর স্বামীর উপর সরকারের এই নির্মমতার বিবরণ কী মেয়ের থেকে লুকিয়ে রাখবেন? 
পারবেন না। এর দায় যে পুলিশের, সরকারের। 
অন্যদিকে, জাফরপুরে কী ঘটেছে? 
বৃহস্পতিবার থেকে সেখানে উত্তেজনা। রাত জাগছেন মানুষ। পুরুষরা রাস্তায়। মহিলারা বাড়িতে। নিহত চন্দন দাসের ভাগ্নে অভিজিৎ দাস বলছেন, ‘‘গ্রামের সবাই আইসি-কে ফোন করেছেন। আমরা চেয়েছিলাম পুলিশ আসুক। পুলিশের কোনও অফিসার ফোন ধরেননি। ফোন বেজে গেছে।’’
কেন পুলিশ ওই গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা দিতে আসেনি? পুলিশ কী জানত হামলা হবে? ঘটনা পরম্পরা বলছে, পুলিশ সব জানত। 
চন্দন দাসের ছোট ছেলে, ক্লাস ওয়ানের ছাত্র কুশল দাস কথা বলছে ধীরে, অস্ফুট সে উচ্চারণ। তার কথায়, ‘‘আমাকে পিছনে জ্যাঠার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল বাবা আগের দিন। বাবা বলেছিল, ভাল করে লেখাপড়া করিস বাবা।’’ সেটাই কুশলের জন্য তাঁর বাবার শেষ কথা। তার পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসী বৃন্দাবন পাল বললেন, ‘‘আমরা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেছি হামলা রোখার। পারিনি। বাড়ি বাড়ি ঢুকে লুট করেছে। ভাঙচুর করেছে। পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেছে বাসন। আমরা পুলিশকে ডেকেছিলাম। দু’জন মারা গেল। এত ক্ষতি হলো। পুলিশ আজও আসেনি।’’
কেন? জাফরাবাদের হিন্দু প্রধান গ্রামটির আশপাশে মুসলমান-প্রধান এলাকা। তাদের মধ্যে গত বেশ কিছু দিন কিছু মৌলবাদী শক্তি নানা প্রচার চালাচ্ছিল। তৃণমূলের কোনও নেতা এসে নিজেদের চুরি করার দুর্দান্ত ক্ষমতা দিয়ে সেই প্রচার থামিয়ে সম্প্রীতি বজায় রাখতে উদ্যোগ নেননি। অথচ অভিজিতের মতো অনেকেই বললেন, ‘‘আমরা কয়েক পুরুষ এখানে বসবাস করি। কিন্তু কোনও দিন এমন হামলা, খুন, হামলা, আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি।’’ 
বামফ্রন্ট সরকারে থাকলে আগুন জ্বলে না, জঙ্গিপুর তার প্রমাণ। 
সরকার চেয়েছে, তাই হামলা হয়েছে। পুলিশ এই হানাহানির চক্রান্ত বাস্তবায়িত করেছে। অখিল দাস কিংবা জাফর শেখ, জাফরাবাদ কিংবা কাশিমনগর, কথা এক— ‘‘এফআইআর করতে হলে সবার আগে পুলিশের বিরুদ্ধে এফআইআর করতে হবে।’’
দু’টি ঘটনাতেই বিডিও, জেলাশাসক, বিধায়ক, সাংসদরা প্রায় চার দিন কেটে যাওয়ার পরেও আক্রান্ত পরিবারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কোনও ঘটনাতেই পুলিশ আক্রান্তদের কোনও বয়ানও নেয়নি। কেন? 
ফুটানি মোড়ে সুশান্ত পালের যে পাইরুটির দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে হামলাকারীরা, তিনি বললেন, ‘‘আমার সব চলে গেছে। পুলিশ একবার আসেওনি। যারা পুড়িয়ে দেয়, তারা আমার দোকান থেকে রুটি কেনে, নুন কেনে।’’
দুষ্কৃতীদের নাম চায় না পুলিশ। তাই কোনও বয়ান নেওয়া হয়নি। অথচ ইজাজের গ্রামে ঢুকে, ঘরের দরজা লাথি মেরে খুলে যুবক ছেলেদের তুলে নিয়ে গিয়েছে এই পুলিশই। রহমতদের জিজ্ঞাসা, ‘‘আমাদের উপর এই জুলুম কেন?’’
উত্তর জানা— পুলিশ উত্তেজনা জিইয়ে রাখতে চাইছে, প্রতিহিংসা জাগাতে চাইছে নিরপরাধদের মনে। 
পুলিশ দাঙ্গাকারী বানানোর টেন্ডার নিয়েছে। টেন্ডার দিয়েছে? সরকার। লাভ কী? পালটা মারের মানসিকতাও বাড়বে। লাভ? আর এস এস, বিজেপি’র। গঙ্গার ওপারে, মালদহের বৈষ্ণব নগর ও কালিয়াচক থেকে যারা জঙ্গিপুরের উপর লক্ষ্য রাখছে। আপাতত চুপ। জল মাপছে। 
সিপিআই(এম)-ই একমাত্র রাজনৈতিক দল, যারা ঘটনাস্থলে গিয়েছে। সোমবার পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, পার্টির নেতা সোমনাথ ভট্টাচার্য, পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির সম্পাদক জামির মোল্লা প্রমুখ গ্রামগুলিতে গিয়েছেন। গিয়েছিলেন ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সভাপতি ধ্রুবজ্যোতি সাহা, রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জি প্রমুখও। তাঁরা আক্রান্ত পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলেছেন। মোটরসাইকেলে তাঁরা পৌঁছেছেন সেখানে। গ্রামবাসীরা তাঁদের পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছেন।
 

Comments :0

Login to leave a comment