ডাঃ পবিত্র গোস্বামী
এবার গঙ্গারামপুরে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে স্টুডেন্টস হেলথ হোমের রাজ্য উৎসব। প্রস্তুতির পর্বেই মিলেছে ব্যাপক সাড়া। কেন এই উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে, কেনই বা তা প্রয়োজন।
উৎসব মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দৈনন্দিন গতানুগতিক জীবনের একঘেয়েমি থেকে ক্ষণিক মুক্তি পেতে যুগ যুগ ধরে আয়োজিত হয়ে আসছে বহুবিধ উৎসব। এতে অর্থনীতির চাকাও একটু জোরে ঘোরে। কিন্তু সম্প্রতি অর্থনৈতিক লাভালাভিই যেন বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে গেছে উৎসবের সংখ্যা। উৎসব হয়ে উঠেছে প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা প্রদর্শনের যুৎসই মাপকাঠি। উৎসব আয়োজন ঘিরে তাই লাঠালাঠি, হানাহানি কিছুই বাদ যাচ্ছে না। কোথাও কোথাও উৎসবের অতি দাপটে জনজীবন অতিষ্ঠ। যা ছিল একঘেয়েমি থেকে সাময়িক মুক্তি লাভের উপায় তা নিজেই যেন এখন একঘেয়েমিতে পরিণত।
স্টুডেন্টস হেলথ হোমের পরিষেবার অধুনিক ব্যবস্থা
স্টুডেন্টস হেলথ হোম আয়োজিত উৎসব একদমই অন্যরকম। বহু বছর ধরে চলে আসা এই উৎসবের মূল লক্ষ্য বন্ধুত্ব মূলক প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে উৎসাহ প্রদান করা এবং গ্রামীণ প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের শহরকেন্দ্রিক ও স্বচ্ছল ছাত্রছাত্রীদের সাথে একই মঞ্চে বা একই খেলার মাঠে প্রতিযোগিতার সুযোগ করে দিয়ে তাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া, মেলবন্ধন ও ভাব বিনিময়ের সুযোগ করে দেওয়া। এই উৎসবে কোনো ধর্ম নেই, জাত নেই, নেই দলীয় রাজনীতি।
কী হয় এই উৎসবে? করোনার কারণে গত দু’বছর সেভাবে করা যায়নি, না হলে প্রতি বছরই আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়ে যায় এই উৎসব, আঞ্চলিক কেন্দ্র ভিত্তিক সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে। এ বছরও হয়েছে, সারা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্টুডেন্টস হেলথ হোমের আঞ্চলিক কেন্দ্র গুলিতে। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ, রানিগঞ্জ থেকে বসিরহাট, কলকাতা কিংবা শিলিগুড়ি সর্বত্র, গ্রাম্য আদিবাসী পরিবারের ছেলে মেয়ে থেকে শহুরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা মেতে উঠেছিল নাচ গান আবৃত্তি কুইজ, বসে আঁকো, যোগাসন ইত্যাদি বয়স ভিত্তিক প্রতিযোগিতায়। আয়োজনের অসুবিধা ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বিগত এক দশক ধরে উৎসব থেকে বাদ গিয়েছিল মেয়েদের খো খো ও ছেলেদের ফুটবল প্রতিযোগিতা।
স্টুডেন্টস হেলথ হোমে চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন অনেকেই
এ বছর খো খো ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সংগঠকদের ইচ্ছা রয়েছে আগামীতে ফুটবলকেও ফিরিয়ে আনার, কারন দলবদ্ধ খেলাধূলায় শুধু শরীর ভালো থাকে তাই নয়, মনরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খেলার মাঠে পড়ে যাওয়া ছেলে বা মেয়েটি যখন উঠে দাঁড়ায় মনের অবচেতনে তার বোধ তৈরি হয়, জীবনে পড়ে গেলেও উঠে দাঁড়ানো যায়। এমনই আরও অনেক অমূল্য শিক্ষা মেলে খেলার মাঠে যা বিদ্যালয় শ্রেণি কক্ষে বা বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে শত শাসনেও দেওয়া সম্ভব নয়। এছাড়াও খেলাধূলা বা ব্যায়ামে শরীরে নিঃসৃত হয় এন্ডোরফিন জাতীয় রাসায়নিক যা মনকে ফুরফুরে রাখে, পড়াশোনা ভালো মাথায় ঢোকে, অন্যান্য কাজে মন বসে, এ কথা আজ প্রায় সবাই জানেন।
আঞ্চলিক উৎসবের পর্ব এবারের মতো মিটেছে। ৩০ ডিসেম্বর প্রতি কেন্দ্রের প্রথম স্থানাধিকারীরা মিলিত হবে গঙ্গারামপুরে রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতার জন্য। খো খো ফাইনাল প্রতিযোগিতায় দক্ষিণবঙ্গ চাম্পিয়ন মেদিনীপুর খেলবে উত্তরবঙ্গ চাম্পিয়নের সঙ্গে। এটাই স্টুডেন্টস হেলথ হোমের রাজ্য উৎসব। এখানে প্রতিযোগিতায় না জিতলে জীবন শেষ নয়, বরং পা়ঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী, তাদের অভিভাবক এবং ছাত্র স্বার্থে নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক, চিকিৎসক ও সংগঠকদের এ এমন এক মিলন মেলা যেখান মেলে জীবনকে আরও অর্থবহ করে তোলার রসদ।
ওই ভরা শীতে উত্তরবঙ্গের এক মফস্বল শহরে এতগুলি মানুষের অনাড়ম্বর থাকা খাওয়াও তো চাট্টিখানি কথা নয়। প্রয়োজন অনেক অর্থ এবং বিপুল লোকবলের। এখন গঙ্গারামপুর শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে যে, সে উদ্যোগ বহুদিন আগেই শুরু হয়েছে। গঙ্গারামপুর স্টুডেন্টস হেলথ হোমের সম্পাদক, পেশায় প্রধান শিক্ষক, শ্রী অনিমেষ লাহিড়ীর নেতৃত্বে দিন রাত এক করে পরিশ্রম করছেন স্থানীয় সংগঠকেরা। আশীর্বাদ রয়েছে হোম অনুরাগী স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষদের। অর্থ সাহায্য আসছে অন্যত্র থেকেও, বিশেষত হোম অনুরাগী চিকিৎসকরা অনেকেই অর্থ পাঠিয়েছেন অনলাইনে। কারণ তাঁরা সবাই কবি শঙ্খ ঘোষের আহ্বান মেনে আরো বেঁধে বেঁধে থাকতে চান। গঙ্গারামপুরের উৎসব শেষে বাঁধা ছাঁদা শেষ হলে সবাই তাকিয়ে থাকবে হাবড়ার দিকে, কারণ আগামী বছর ওখানেই হবে স্টুডেন্টস হেলথ হোমের রাজ্য উৎসব। পাশাপাশি চেষ্টা চলবে এই উৎসবকে কি করে আরও বেশী প্রান্তিক পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণের উপযোগী করে তোলা যায়। সমাজে ক্রমবর্ধমান বিভেদ, বিদ্বেষের বাতাবরণ থেকে বাঁচিয়ে কিভাবে আরও বেশী ছাত্রছাত্রীকে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার এই আঙিনায় টেনে আনা যায়।
( ছবি অচ্যুৎ রায় )
Comments :0