এখনও নাকি মুখ্যমন্ত্রীর অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত হয়নি! পুজোর আগে থেকে শুরু হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর উৎসব। এখনও যে তার রেশ কাটেনি তা বোঝা গেলো গতকাল রেড রোডে তাঁর রঙিন মেজাজে! উৎসব শুরু করেছিলেন উদ্বোধনের পর উদ্বোধন দিয়ে। মণ্ডপে, মণ্ডপে ফিতে কেটে কিংবা অনলাইনে। সব মিলিয়ে বারোশোর ওপর উদ্বোধন, সেই সঙ্গে ভাষণ। একটি পুজো উদ্বোধনে বেরিয়ে মমতা ব্যানার্জি মন্তব্যও করলেন, ‘দু’-একটা ঘটনা কখনও ঘটে যায় বাংলায়।’ তাই বলে উৎসবে ব্যাঘাত কেন! কিন্তু তারপর মমতা কি দেখলেন বাংলায়! উৎসব ছিল, কিন্তু সেখানে মিশে গিয়েছিল বিষণ্ণতার সুর, প্রতিবাদের ঢেউ। দ্রোহকালের এক অনন্য উৎসব।
মমতা ব্যানার্জি চুটিয়ে পুজো ‘এনজয়’ করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, কোনোদিকে তাকাতে বারণও করেছিলেন। কোনোদিকে তাকাতে বারণ তো তাকে করতেই হবে, কারণ গোটা উৎসব পর্বে বাংলাজুড়ে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রাস্তায়, মিছিলে-সমাবেশে, গানে কবিতায় এমনকি খোদ উৎসবের আঙিনাতেই। এমন অভুতপূর্ব আন্দোলনের স্রোত বাংলার সমজ জীবনকে প্রবলভাবে নড়িয়ে দিয়েছে। মমতা ব্যনার্জি কোনোদিকে তাকাতে বারণ করছেন, কারণ কোনোদিকে তাকানোর সাহস তিনি নিজেই পাচ্ছেন না। আন্দোলনের এমন আবেগ, এমন জনস্পর্ধা তিনি আগে কখনও দেখেছেন কি! তাই তিনি নিজেই দিশাহারা। কখনও ফোঁস করতে বলেছেন, কখনও হুমকি দিয়েছেন অন্য ভাষায়, অন্য কথায়। তাঁর পারিষদ হুমকি চালিয়ে যাচ্ছে ততোধিক। কিন্ত পুলিশ লোকলস্কর কোনও কিছুতেই দমানো যায়নি এই দুর্বার গণজাগরণ। পুলিশের তরফে আন্দোলনের বিভিন্ন সংগঠকদের ধারাবাহিকভাবে হেনস্তা চলছে তো চলছেই। আসলে পাঠক্রমের বাইরের এই আন্দোলনের মোকাবিলায় হুমকি-সংস্কৃতিই ওদের চেনা পথ, একমাত্র জানা রাস্তা। শাসক যে প্রতিবাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে, প্রতিরোধকে ফাটকে পুরতে চেয়েছিল, সেই প্রতিবাদ-প্রতিরোধই আবার রাজপথে মিছিল-ধরনা-জমায়েতে ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’ ফিরে এসেছে বারেবারে। শাসকের রক্তচক্ষু, জুলুমের তোয়াক্কা না করেই। মমতা ব্যনার্জি তার এই অজানা বিপদ ঠেকাবেন কি করে?
আর জি কর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দু’মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এরমধ্যেই জয়নগরে উদ্ধার হয়েছে নয় বছরের বালিকার দেহ। ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগে উত্তাল হয়েছে সেই এলাকা এবং এ রাজ্যের মানুষ। পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুরে উদ্ধার হয়েছে নিখোঁজ গৃহবধূর দেহ। ধর্ষণ করে জোর করে বিষ খাইয়ে হত্যার অভিযোগ সামনে এসেছে। খোদ কলকাতার পার্ক স্ট্রিট থানায় মহিলা সিভিক পুলিশের ওপর শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্ত হয়েছে খোদ কলকাতা পুলিশেরই কর্মী। আর কৃষ্ণনগরের ঘটনা নতুন অভিঘাত তৈরি করেছে বাংলার সমাজ জীবনে। এরাজ্যের নারীদের ওপর শুধুমাত্র গত এক মাসেই একের পর অত্যাচারের আরও উদাহরণ আরও অনেক আছে। কিন্তু এরপরেও সব ছেড়ে উৎসবে মেতে থাকার ডাক দিতে যে শুধু মমতা ব্যানার্জিই পারেন, তা আরও স্পষ্ট করে বোঝা গেলো তাঁর উৎসবের কার্নিভালের জেদ থেকে।
কিন্তু কী দেখলো রাজ্য? ক্ষোভ থেকে উৎসারিত জেদের অনবদ্য কার্নিভাল। জাগরিত জনতার প্রতিস্পর্ধার উৎসব। সেখানে বিলাসবহুল মঞ্চ নেই, বৈভবের উদ্যাপন নেই। বাহারি নিয়নে মুখ ঢাকার প্রয়োজন হয় না সেখানে। ছিল দ্রোহকালের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ আলোড়ন, প্রতিবাদের সেই উৎসব আন্দোলিত করল এবাংলার হৃদয়।
মমতা ব্যনার্জি এখনও চুপ। এখনও কি তিনি উৎসবের ঢাল হাতে রেখেছেন? জুনিয়র ডাক্তাররা এখনও অনশনে। গোটা রাজ্য এখনও ফুঁসছে, আরও বড় আন্দোলন, আরও দীর্ঘ দ্রোহকালের প্রহর গুনছে বাংলা। কতদিন পালিয়ে বেড়াবেন মমতা?
Comments :0