শুভ্রা মিত্র
গত শনিবার, পয়লা মার্চ তৃণমূলকে যারা সমর্থন করেন এমন অধ্যাপকদের (ওয়েবকুপা) সভা এবং সম্মেলন ছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বক্তব্য রাখতে এসেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। সেখানে এসএফআই এবং আরও কিছু অতিবাম ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের কিছু দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। সভার কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটার দাবি করে তৃণমূল অধ্যাপক সংগঠন। এরপর শিক্ষামন্ত্রী সভা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে শুরু হয় হট্টগোল। ছাত্ররা বিভিন্ন গাড়ির ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে এবং সেই গাড়িগুলি দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে একাধিক ছাত্র আহত হয়। যাদবপুরের শিক্ষা এবং রাজনীতির যে বহুমাত্রিক রামধনু চরিত্র সেই নিয়ে বিশদ আলোচনায় অনেক সময় লেগে যাবে। আপাতত বিষয়ে আসা যাক।
এ নিয়ে কোন সন্দেহই নেই যে রাজ্যের আওতায় যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়, তার মধ্যে যাদবপুর একেবারে প্রথম সারিতে। অমিত শক্তিশালী বেশ কিছু রাজনৈতিক দল, যেমন কংগ্রেস, বিজেপি এবং তৃণমূল বহু চেষ্টা করেও এখানকার ছাত্রছাত্রীদের মনে কখনোই দাগ কাটতে পারেনি। ছাত্র ইউনিয়নে বাম এবং অতিবামদের মধ্যেই এখানে মূল লড়াই। সোজা কথায় বাম বলতে এসএফআই, আর রয়েছে অতিবাম। ২০০৭ সাল থেকে যখন এই রাজ্যে সিপিআই(এম)-র বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে তখন থেকেই এই অতিবাম সংগঠনগুলি তৃণমূলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে যুক্ত। এরা প্রাথমিকভাবে সিপিআই(এম) এবং বিজেপি’র বিরোধী। পড়ুয়াদের সম্পর্কে যে কথা শুরুতেই বলতে হয়, তা হল যাদবপুরের কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের কর্তৃত্ববাদ সামনে এসেছে মাঝে মাঝে। যেমন বিজেপির ছাত্র সংগঠন যখন একটি প্রোপাগান্ডামূলক ছবি দেখাতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদের বাধা দেওয়ার খবর সামনে এসেছিল। বর্তমান তৃণমূল মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় যখন বিজেপিতে ছিলেন তখন তাঁকে অপদস্থ করার অভিযোগ উঠেছিল। শেষে তাঁকে ‘উদ্ধার’ করতে চলে গিয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়, যিনি এখন দেশের উপরাষ্ট্রপতি। বছর দুই আগে র্যাগিং এর ঘটনায় একথা একেবারে পরিষ্কার যে অকাজের বহু অতিবাম নেতা হোস্টেল আঁকড়ে বসে থাকতেন এবং অল্পবয়সী ছাত্রদের ধমকাতেন। সাম্প্রতিক কিছু ছাত্রের মার্কশিটের গণ্ডগোল সামনে এসেছে এবং শীর্ষপদে দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ভাস্কর গুপ্ত বলেছেন, এরকম গোলমেলে বিষয় প্রশাসনের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তবু এইসমস্ত টুকরো গণ্ডগোলের বাইরে যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের এক ইতিবাচক পরিচয়ের ব্যপ্তি সারা পৃথিবীতে। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি অগভীর রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে আশ্রয় করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যাঁরা সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক আলোচনা করবেন তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে অবজ্ঞা করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। অবশ্যই এটা মানতে হবে যে তৃণমূলের সমর্থক অধ্যাপকদের সভায় ক্রমাগত উৎপাত করেছে একদল পড়ুয়া। রাষ্ট্রের বিপুল ক্ষমতায় সেখান থেকে সরিয়ে দিলে খুব বলার কিছু থাকতো না। অবশ্য তৃণমূলের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ‘দামাল ছেলেরা’ বিভিন্ন সময়ে এর থেকে অনেক বেশি হেনস্থা করেছে অধ্যাপকদের। ছাত্র সংঘর্ষে ২০১৩ সালে গুলি করে পুলিশকর্মীকে মেরে ফেলার ঘটনাও তো এই কলকাতায় ঘটেছে! পড়ুয়ারা গাড়ির বনেটে উঠেছে দেখে যে তৃণমূল নেতৃত্ব অবাক হলেন, তাঁদের অন্তত নেত্রীর ইতিহাস একবার পড়ে নেওয়া দরকার।
কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা কি দেখলাম? ছাত্রছাত্রীরা যখন প্রতিবাদী আন্দোলনের পথে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছে, তখন একাধিক গাড়ি তাদের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেওয়া হল। যে কোন সুস্থ সামাজিক যুক্তি বলবে যে এই আচরণ ভয়ঙ্কর কর্তৃত্ববাদী। হিংসার যদি কোন সূচক থাকে, সেক্ষেত্রে পড়ুয়াদের আচরণের থেকে এই পিষে দেওয়া অনেক ভয়ঙ্কর অপরাধ। তৃণমূলের বরিষ্ঠ নেতাদের উপস্থিতিতে এই ঘটনা ঘটেছে। তাঁরাই তো শাসক। ফলে গোটা ঘটনাটি তাঁরা সামলাতে পারেন নি বা চান নি, এটা একেবারে পরিষ্কার। তাঁরা ব্যক্তিগত আধিপত্যবাদী মানসিকতায় গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গেছেন কিনা এই প্রশ্ন হয়তো উঠতো না, কিন্তু দু-একজন তৃণমূল নেতা আবার বলছেন, তাঁরা থাকলে নাকি আরও জোরে গাড়ি চালিয়ে বেরোতেন। সেই প্রেক্ষিতে এই যুক্তি বারবার আসবে, রাষ্ট্রব্যবস্থা এক ভয়ঙ্কর ছবি এঁকেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ থাকে। তৃণমূল কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে এর থেকে তীব্রতর বিরোধিতা চালিয়েছে। বিধানসভার আসবাবপত্র ভাঙা থেকে পথ অবরোধ, বহু আন্দোলনকারী মানুষের মৃত্যু - এমন ঘটনা ঘটেছে তৃণমূল বিরোধী থাকাকালীন। সেই জায়গাটা শাসক হয়ে ভুলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ শাসকের চরিত্রে যে আধিপত্যবাদ, সেই চেহারা বারবার সামনে আনছে তৃণমূল। তাই ছাত্রদের আহত হওয়ার যে ছবি সংবাদমাধ্যমে সামনে আসছে, সেখানে শাসক তৃণমূলের আচরণকে একপেশে সমর্থন করতে গেলে বুদ্ধিজীবী মহলকে আয়নার সামনেই দাঁড়াতে হবে। তাঁদের দ্বিচারিতা সামনে আসে, যখন ভারতীয় রেল অভাবী মানুষকে উচ্ছেদ করতে গেলে তৃণমূল বিধায়ক বাধা দেন আবার বরানগরে বা রাজ্যজুড়ে বিশাল সংখ্যক নিম্নবিত্ত হকার উচ্ছেদের সময় সেই তৃণমূল নেতৃত্বই ঘুমিয়ে থাকে। এই পরিস্থিতিতে শাসকের গাড়ি ছাত্রের ঘাড়ে উঠলে সেই শাসকদলের নেতাদের হুঁশিয়ারি শোনানো আবশ্যক। সেই হুঁশিয়ারি অবজ্ঞা তাঁরা করতেই পারেন, তবে তা তৃণমূলকে আরও বেশি আধিপত্যবাদের দিকে ঠেলে দেবে।
তৃণমূলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাপক দুর্নীতি এবং দূর্বৃত্তায়নের অভিযোগ। আধিপত্যবাদ খুব ভালো মেলে সেই দুর্নীতি এবং দূর্বৃত্তায়নের সাথে। সেইখানেই এই গাড়ির ধাক্কা ভীষণভাবে প্রতীকী হয়ে উঠছে। শোনা যাচ্ছে আহত ছাত্রদের বিরুদ্ধেই নাকি মামলা দিয়েছে পুলিশ। অর্থাৎ গাড়ির মধ্যে যাঁরা ছিলেন একমাত্র তাঁদেরই আক্রান্ত বলে ধরা হচ্ছে। তাঁরা যে আক্রান্ত এই কথা সত্যি হলে আন্দোলনরত আহত ছাত্ররা অনেক বেশি আক্রান্ত। ছাত্রদের পক্ষ থেকেও সম্ভবত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে নেতাদের ব্যবহার করা গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা নিয়েও। এইখানেই আইনের শাসন এবং শাসকের আইন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠবে। একসময়ের প্রতিবাদী মুখ তথা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ভাস্কর গুপ্ত মহাশয় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে থেকে পুরো বিষয়টি দেখেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তিনি এইসময় শাসক তৃণমূল এবং প্রতিবাদী ছাত্রদের মধ্যে কিভাবে ভারসাম্য বজায় রাখেন সে বিষয়টিও আগামীদিনে রাজনৈতিক আলোচনায় উঠে আসবে।
যাদবপুরের রাজনীতির প্রেক্ষিতে তৃণমূল এবং অতিবামদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। চিকিৎসক আন্দোলন এবং যাদবপুরের ঘটনা - এই দুই ক্ষেত্রেই অতিবাম ছাত্রদের সঙ্গে তৃণমূলের দ্বন্দ্ব সামনে আসছে। তৃণমূলের যে আদর্শবাদী ব্যাপ্তি তা একদিকে দক্ষিণপন্থা থেকে অন্যদিকে অতি বামপন্থা পর্যন্ত বিস্তৃত। সিপিআই(এম)কে হারানোর সময় এরা সকলেই এক হয়েছিলেন। এখন তৃণমূল কিভাবে একাধারে অতিবাম এবং আরএসএসকে সামলাবে, সেই বিষয়টি বঙ্গ রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে যাদবপুরের গায়ে মুক্তাঞ্চলের যে লেবেল, সেই ভাষ্যে অন্তত বিজেপি-তৃণমূল একমত। তবে সামগ্রিকভাবে তার থেকেও বড় বিপদের ক্ষেত্র হল বঙ্গ রাজনীতিতে হিংসার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। সেইখানে শাসকের গাড়ির চাকায় যে রক্তের দাগ লাগলো তা সহজে মুছে যাওয়ার নয়। আর এক মন্ত্রীমশাই যেমন বলেছেন, সেই সত্য মেনে নিয়েই বলা যায়, আজকের দিনে গায়ের জোরে যাদবপুরের জমি দখল করে নিতে পারে তৃণমূল বা বিজেপি। কিন্তু সেখানকার পড়ুয়াদের মন দখল করে ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। আর সমাধানের পথ? গোটা রাজ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন বন্ধ রেখেছে তৃণমূল সরকার। ফলে ছাত্রদের প্রতিনিধিত্বের জায়গাটা পুরো গুলিয়ে দিয়ে একদলীয় আধিপত্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে এই রাজ্যে। সরল রাজনৈতিক কৌশল বলে, তৃণমূল ২০২৬ এর আগে এই নির্বাচনগুলি করতে চাইবে না, কারণ ছাত্রসমাজ সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠান বিরোধী। সেক্ষেত্রে এত বছর ধরে ছাত্র ইউনিয়নে নির্বাচন বন্ধ থাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেই যে যুবনেতা বা নেত্রীরা আগামীতে উঠে আসবেন, তাঁরা কেউ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সামনে আসতে পারবেন না এটা পরিষ্কার। কংগ্রেস বা বিজেপি কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আগ্রাসী মনোভাব সত্ত্বেও জেএনইউতে নির্বাচন বন্ধ করার কৌশল নিয়ে সফল হয় নি, আর সেখান থেকেই উঠে এসেছে দেশের রাজনীতিতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নাম। তৃণমূল নেতৃত্ব সেই বিষয়টা বিশেষভাবে যাদবপুর এবং সামগ্রিকভাবে গোটা রাজ্যের নিরিখে না ভেবে গণতন্ত্র ধ্বংসের যে পথে হাঁটছেন, তা আত্মঘাতী।
প্রসঙ্গক্রমে আর দুটি বিষয় সামনে আনা দরকার। এক, এসএফআই যে ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছিল সেখানে পরিষ্কার বলা ছিল যে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা এর আওতার বাইরে। তা সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন ভান করা হল যেন তাঁরা সেটা শুনতেই পান নি! ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামের ঘটনার পর মার্চ মাসে এরকমই পরীক্ষার মধ্যেই ধর্মঘট ডেকেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, সেই সময় তাঁর বক্তব্য ছিল যে কোন গোলমাল হলে তার দায়িত্ব তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে নিতে হবে। সময়ের সঙ্গে বদল অবশ্যই রাজনীতির একটি অংশ, তবে অতীতের ইতিহাস আজকাল খুব সহজেই অন্তর্জালে খুঁজে পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিষয়টি হল দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্রদের আহত হওয়ার ঘটনায় যে বিচলিত বা অনুতপ্ত নয় তা জানা গেল ঘটনার প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা পরে, সেই অন্তর্জালেই। যাদবপুরে যদি সত্যিই কখনো ছাত্র ইউনিয়নের নির্বাচন হয়, তখন অবশ্যই এই ঘটনার কথা, এবং তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায়। সে ইতিহাস লেখা হবে ভবিষ্যতেই।
Comments :0