ভেঙে পড়ছে বাড়ি, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ছেন মানুষ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা, গৃহহীন হয়ে পালাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। গত ১২ বছর ধরে এই দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সিরিয়া। কিন্তু এবার রকেট, বিস্ফোরণের আঘাত নয়, কামান-মেশিনগানের গোলা নয়। পরপর তিন বারের ভূকম্পে একই দৃশ্য ফিরে এসেছে।
গৃহযুদ্ধে প্রায়-বিধ্বস্ত সিরিয়ায় যখন একটু স্থিরতা, তখনই মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর কেঁপে উঠেছে উত্তর সিরিয়ার শহরগুলি। এককালের বাণিজ্য রাজধানী, সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর আলেপ্পো গৃহযুদ্ধ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। এমনিতেই ভাঙাচোরা, খণ্ডহরের ছবি শহরজুড়ে। এদিন আলেপ্পোতেই বড় ধাক্কা পড়েছে। আধা-ভাঙা বাড়িগুলি লুটিয়ে পড়েছে। কয়েকশত মানুষ শুধু আলেপ্পোতেই মারা গিয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দক্ষিণ তুরস্কের সীমান্ত থেকে আলেপ্পোর দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার। এই বৃত্ত জুড়েই ভূকম্পের প্রাবল্য সবচেয়ে বেশি। জিন্দারেজ, আজাজ, আতমার মতো ছোট শহরে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত উদ্ধারকারীরা পৌঁছাতেই পারেননি। লাতাকিয়া প্রদেশের প্রায় পুরোটাই ভূকম্পের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত। সব মিলিয়ে, ১ হাজারের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন, জখম আরও তিন হাজার।
গৃহযুদ্ধে সিরিয়া থেকেই ঘরছাড়া মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০১১ থেকে সিরিয়ার আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে তথাকথিত বিদ্রোহ শুরু হয়। দ্রুতই রাজনৈতিক বিরোধীদের হাত থেকে সেই বিদ্রোহ চলে যায় দেশ-বিদেশ থেকে জড়ো করা উগ্রপন্থীদের হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো এবং তুরস্কের মদতে অস্ত্র যায় এদের হাতে। এখন উত্তর ও উত্তর পশ্চিমের কিছু এলাকা ছাড়া প্রায় কোথাও এই বিদ্রোহীদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে লক্ষ লক্ষ সিরিয়ান ঘরহারা হয়েছেন। দক্ষিণ তুরস্কের গাজিয়ানতেপ, আন্তাকিয়া, খারামানমারাস, কিলিসই ‘ঘর’ হয়ে ওঠে এই শরণার্থীদের। এইসব শহরে অস্থায়ী আস্তানা রয়েছে, তাঁবু রয়েছে। ঠিক এইখানেই এদিনের ভূমিকম্প ধাক্কা মেরেছে। আরও কয়েক লক্ষ মানুষ শরণার্থীতে পরিণত হবেন। এমন এক সময়ে যখন শীতের ঝড় বইছে।
দারকুশের হাসপাতালে আহতদের স্রোত। কোনোক্রমে বেঁচেছেন ওসামা আবদুল হামিদ। কাছাকাছির গ্রাম আজমারিন থেকে এসেছেন। তাঁর প্রতিবেশীরা কেউ বেরোতে পারেননি। ‘চারতলা বাড়ির তিন তলার সবাই চাপা পড়ে গেছে’, কাঁদতে কাঁদতেই বললেন তিনি। হামিদরা ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎই সব কাঁপতে আরম্ভ করে। কোনোক্রমে বাড়ির বাইরে দৌড়ে বেরোনোর আগেই ভেঙে পড়ে বাড়ি। একটি বড় কাঠের দরজা তাঁদের কোনোক্রমে বাঁচিয়ে দেয়। হামিদের স্ত্রী, সন্তানরা মাথায় আঘাত পেলেও প্রাণে বেঁচেছেন। পশ্চিমের এই এলাকায় এখনও বিদ্রোহীদের দখল রয়েছে। হাসপাতালের দার্জন মাজদি আল-ইব্রাহিম বলেছেন, ‘যে বিপদ ঘটেছে তা আমাদের সামলানোর সাধ্যের বাইরে, এখনই জরুরি সাহায্য চাই’। তাঁর কথার মধ্যেই কম্বলে মুড়ে নিয়ে আসা হলো বেশ কয়েকজন শিশুকে, যাদের কেউই বেঁচে নেই। তুরস্কের মদতপ্রাপ্ত বিদ্রোহীদের প্রশাসনের ‘অর্থমন্ত্রী’ সাংবাদিকদের বলেছেন, একই সঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে, তীব্র শীত। অনেক এলাকায় বরফ পড়ছে। শরণার্থীদের বেশ কয়েকটি শিবির একেবারে ধুলোয় মিশে গেছে।
মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সিরিয়ায় কয়েকশত পরিবার ধ্বংস্তূপে চাপা পড়ে আছে। আলেপ্পো থেকে তুরস্কের দিয়ারবাকির পর্যন্ত হাজার হাজার বাড়ি ধসে পড়েছে। ইসকেনদ্রামে একটি গোটা হাসপাতাল ভেঙে পড়ে গেছে।
তুরস্ক-সিরিয়ার এই এলাকায় বহু প্রাচীন সৌধ ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রয়েছে। সেগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজিয়ানতেপের রোমান আমলে তৈরি বিখ্যাত দুর্গ ভেঙে পড়েছে। এটি ছিল অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ।
Comments :0