রাজ্যের সরকারি কর্মী ও শিক্ষকদের হকের দাবির আন্দোলন রুখে দিতে মারমুখী হয়ে উঠলো মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সরকার। ন্যায্য পাওনার দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ওপর বুধবার হিংস্র আক্রমণ চালালো পুলিশ। আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের লাথি, ঘুষি, ধরপাকড়, গ্রেপ্তার চললো নির্বিচারে, ঝরলো রক্তও। ১২জন মহিলা সহ মোট ৪৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাত পর্যন্ত তাঁদের ছাড়া হয় নি। লালবাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, ধৃতদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। ধৃতদের বৃহস্পতিবার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে পেশ করা হবে। এদিকে, এদিনের হামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাজ্যজুড়ে প্রতিটি দপ্তরে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন নেতৃবৃন্দ।
ন্যায্য ডিএ’র বকেয়া, শূন্যপদ পূরণ, স্থায়ীকরণের দাবিতে এদিন দুপুরে যখন একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে কর্মী ও শিক্ষকরা বিধানসভা অভিযানে এগোচ্ছেন, তখন পুলিশ লেলিয়ে সমবেত লড়াইকে বানচাল করার যাবতীয় চেষ্টা চালিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মেরে-ধরে টেনে-হিঁচড়ে ভ্যানে তুলে সরকারি কর্মী, মহিলা কর্মী, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অবসরপ্রাপ্তদের গ্রেপ্তার করে লালবাজারে নিয়ে গিয়েছে পুলিশবাহিনী। পুলিশের হামলায় জখম হয়েছেন কয়েকজন। সরকারি হামলার মুখেও আন্দোলনকারীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে হবে। এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না।’’
পুলিশি বর্বরতা এবং বেপরোয়া ধরপাকড়ের প্রতিবাদে এদিনই ধর্মতলায় রাণী রাসমণি রোডের তিনটি লেনই বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন সরকারি কর্মী ও শিক্ষকরা। বেশ কিছুক্ষণের জন্য ডোরিনা ক্রসিং স্তব্ধ করে দেন তাঁরা। উত্তাল সেই জনস্রোতের স্পষ্ট দাবি উঠলো, অবিলম্বে বকেয়া ডিএ দিতে হবে। প্রশ্ন উঠলো, ন্যায্য পাওনার আন্দোলনে হামলা চালিয়ে কেন গ্রেপ্তার করবে পুলিশ? ধৃত কর্মী ও শিক্ষকদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সোচ্চার ছিলেন সকলে।
সেই তুমুল উত্তেজনার মাঝেই আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আইন বলছে ডিএ দিতে হবে কর্মীদের। হাইকোর্টের অর্ডার রয়েছে। কতদিন ডিএ না দিয়ে থাকবে রাজ্য সরকার, তা আমরাও দেখবো। সরকার অন্যায় করছে। আবার কর্মীদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। প্রতিবাদে রাস্তা বন্ধ রেখেছেন কর্মী, শিক্ষকরা। ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন তাঁরা।’’
রাজ্য কোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিক, কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের যৌথ মঞ্চের ডাকে এদিন ছিলো বিধানসভা অভিযান আন্দোলন। কর্মী ও শিক্ষকদের সঙ্গে আন্দোলনে ছিলেন অস্থায়ী কর্মচারী ও অবসরপ্রাপ্তরাও। দাবি ছিল, বকেয়া সহ মহার্ঘভাতা দিতে হবে, স্বচ্ছতার সঙ্গে সমস্ত শূন্যপদ পূরণ করতে হবে এবং সমস্ত অস্থায়ী ও চুক্তিভুক্ত কর্মীদের নিয়মিত করতে হবে।
এদিন বেলা দু’টো নাগাদ পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার নিয়ে লেনিন মূর্তির নিচে সমবেত হন আন্দোলনকারীরা। এরপর রাজ্য কোঅর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজয়শংকর সিংহ, এবিটিএ রাজ্য সভাপতি কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য সহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে স্লোগান তুলে চৌরঙ্গী দিয়ে মিছিলের জনস্রোত আছড়ে পড়ে রাণী রাসমনি রোডে। সেখানে আগে থেকেই তিন পর্যায়ে ব্যারিকেড গড়ে রেখেছিল পুলিশ। কর্মচারী ও শিক্ষকদের সেই উত্তাল স্রোত পরপর দু’টি ব্যারিকেড উপড়ে ফেলে দেয় পুলিশের সামনেই। এরপর ‘ওপরতলার নির্দেশে’ মারমুখী হয়ে ওঠে পুলিশবাহিনী।
এর মধ্যেই শেষ ব্যারিকেডটি উপেক্ষা করে রাস্তার ধার দিয়ে রাজভবন পেরিয়ে বিধানসভার দিকে এগোতে থাকেন আন্দোলনকারীদের একাংশ। সেখানেও ওত পেতেছিল পুলিশ। হঠাৎই লাঠি উঁচিয়ে কর্মী-শিক্ষকদের ওপর হিংস্র হামলা চালাতে শুরু করে সেই বাহিনী। মারধর, লাথি থেকে ঘুষি, কিছুই বাদ যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুলিশের মারে এদিন বহু আন্দোলনকারীর রক্ত ঝরেছে, আহত হয়েছেন কয়েকজন। মহিলা সরকারি কর্মী ও শিক্ষিকাদের গায়েও হাত তুলতে ছাড়েনি পুলিশ। পুরুষ পুলিশরা মহিলাদের টেনে হিঁচড়ে ভ্যানে তুলছে, এমন দৃশ্যও চোখে পড়েছে। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, এর আগে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে পুলিশকে কামড়ে দিতে দেখা গিয়েছিল, এবার ঘুষি মারতে দেখা গেল পুলিশকে। প্রায় ৫০ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে নেতৃবৃন্দ জানান। পুলিশি হিংস্রতার খবর ছড়িয়ে পড়তেই গোটা রাণী রাসমনি রোডের তিনটি লেনই রুদ্ধ করে দেন ক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা। তাঁদের আরেকটি অংশ অবরোধ করেন ডোরিনা ক্রসিং।
পরে অবশ্য সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা ভেবে রাণী রাসমণি রোডের একটি লেন ছেড়ে দেন আন্দোলনকারীরা। ডোরিনা ক্রসিংয়ের অবরোধও তুলে নেওয়া হয়। রাণী রাসমনি রোডের বাকি দু’টি লেন জুড়ে সন্ধে গড়িয়ে রাত পর্যন্ত অবস্থান চলে। আটক কর্মী ও শিক্ষকদের না মুক্তি দেওয়া পর্যন্ত এই অবস্থান চলবে বলে জানানো হয় নেতৃবৃন্দের তরফে। বিজয়শংকর সিংহ বলেন, ‘‘ভয় দেখিয়ে আমাদের চুপ করিয়ে রাখা যাবে না। আমরা তো কোন অন্যায় করছি না। ন্যায্য পাওনা চাইছি। যাবতীয় অন্যায় করছে সরকার। উৎসবে বিলাসে আমোদ-প্রমোদে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। অথচ সরকারি কর্মী, শিক্ষক শিক্ষাকর্মীদের ৩৫ শতাংশ ডিএ দেওয়ার টাকা নাকি নেই সরকারের! কয়েক লক্ষ শূন্যপদে সরকার নিয়োগ দিচ্ছে না বেতন দিতে হবে বলে! অস্থায়ী কর্মীদের স্থায়ী করছে না একই কারণে। এই অনায্য ব্যবস্থা মেনে নেওয়া যায় না।’’
বিক্ষোভে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য, মোহন দাস পন্ডিত, সন্দীপ রায়, তপন দাস, মনিরুল ইসলাম, কল্যাণ সরকার, সুব্রত চক্রবর্তী প্রমুখ। তাঁরা বলেন, ১৪৪ ধারার মধ্যেই সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে কুকীর্তি চালাচ্ছে শাসকদলের নেতা মন্ত্রীরা। আর সেই ১৪৪ ধারার মধ্যে দিয়ে ন্যায্য পাওনা চাইতে গেলে মার খাচ্ছেন চাকরিপ্রার্থী থেকে শিক্ষক, সরকারি কর্মী ও অবসরপ্রাপ্তরা। এই বঞ্চনা কেন? হাউজ রেন্ট অ্যালাওয়েন্স কেটে তার থেকে একবার ৩ শতাংশ ডিএ দিয়ে সবার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেছে এই সরকার। পরিষ্কার মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে একটা সরকার চলছে। কতদিন সহ্য করবেন সবাই? নেতৃবৃন্দ এদিন স্পষ্ট বলেন, নিজেদের অধিকার বুঝে নেবেন রাজ্য সরকারি কর্মীরা, ন্যায্য অধিকার আদায় করবেন পেনশন প্রাপকরা। এক ইঞ্চি জমিও নবান্নকে ছাড়া হবে না। দাবি আদায়ে আগামী দিনে আরও বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
Government Employees Protest
সরকারি কর্মী-শিক্ষক আন্দোলনে হিংস্র হামলা পুলিশের, ধৃত ৪৮
×
Comments :0