দার আল-শিফা, ‘সুস্থ হয়ে ওঠার ভবন’, এখন নিজেই এক যুদ্ধক্ষেত্র। বন্দরের কাছে, গাজার রিমাল এলাকায় গাজা স্ট্রিপের বৃহত্তম এই হাসপাতাল তৈরি হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। দিনে দিনে বেড়েছে। সার্জিক্যাল, ইন্টার্নাল মেডিসিন, মহিলা ও প্রসূতিদের জন্য বিশেষ বিভাগ। ৮ অক্টোবর থেকেই আল শিফা শিরোনামে। হাসপাতাল খালি করে দেবার জন্য লাগাতার ইজরায়েলী চাপ, তারপর কাছেপিঠে বোমাবর্ষণ, প্রবেশদ্বারে বোমা, বিদ্যুৎ, জল, ওষুধ বন্ধ করে দেওয়ার পরে শুক্রবার রাত থেকে হাসপাতালকে ঘিরে ফেলেছে ইজরায়েলী বাহিনী। ট্যাঙ্ক দিয়ে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ভেতরে রয়েছেন রোগীরা, এছাড়াও হাসপাতালকে তুলনামূলক ভাবে নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নিতে আসা গৃহহীন মানুষ। আল-শিফা বিশ্বের কাছে আবেদন জানিয়েছে প্রতিদিন। কেউ কথা রাখেনি। কেউ তাদের বাঁচাতে আসেনি।
ভারতীয় সময় শনিবার রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময়ে তাঁর মোবাইলের ব্যাটারির শেষটুকু ব্যবহার করে হাসপাতালের অধিকর্তা জানিয়েছেন, আর কয়েক মিনিট পরে এই হাসপাতালেরই মৃত্যু হবে। হাসপাতালে প্রতি পাঁচ মিনিটে একজন রোগী মারা যাচ্ছেন। মৃত এবং আহত সকলেই হাসপাতালের প্রাঙ্গণে পাশাপাশি শুয়ে রয়েছেন। শিশুদের নিউ নেটাল বিভাগে শেষ কয়েকজনের হাত দিয়ে হৃদযন্ত্র চালু রাখার চেষ্টা চলছে। ওই বিভাগকে লক্ষ্য করেই ছুটে এসেছে ইজরায়েলী স্নাইপারদের গুলি। জানালা ভেদ করে এক নার্সকে জখম করেছে ঠিক ইনকিউবেটরের সামনে। এক কারিগরি কর্মীর ঘাড়ে গুলি লাগার পরে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান, চিকিৎসকরা বলছেন তাঁর মৃত্যু আসন্ন। হাসপতালের এক অংশে আগুন জ্বলছে। তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। গোটা হাসপাতালের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছে, পরিষ্কার করার কোনও উপায় নেই।
ইজরায়েলের বোমায় ধ্বংস হয়ে গেছে জেনারেটর। গাজায় এদিন যখন সন্ধ্যা নেমেছে অন্ধকারে ডুবে গেছে আল-শিফা। কেউ পালাতেও পারছেন না। যাঁরা পালাতে গিয়েছিলেন ইজরায়েলের গুলি ছুটে এসেছে তাঁদের লক্ষ্য করে। ‘কিছু নড়লেই ইজরায়েলী সেনারা গুলি করছে’, জানিয়েছেন ডাঃ আসরাফ আল-কুদরা। শুধু ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরাই নন, ডক্টর্স উইদাউট বর্ডারসের তরফেও জানানো হয়েছে, হাসপাতাল লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালানো হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কেউ মারা গেলে তাঁকে বাইরে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। হাসপাতালের মধ্যেই তৈরি করা হচ্ছে গণ সমাধিক্ষেত্র।
শুধু গুলি নয়, হাসপাতাল লক্ষ্য করে নিষিদ্ধ সাদা ফসফরাস বোমাও ছোঁড়া হয়েছে। রামাল্লায় প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাই আল-কাইলা বলেছেন, আন্তর্জাতিক ভাবে নিষিদ্ধ এই অস্ত্র ইজরায়েল ব্যবহার করলেও তাদের দায়ী করার কেউ নেই। অনিবার্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা।
ইজরায়েলের দাবি, ওই হাসপাতাল হামাসের একটি ঘাঁটি। দৃঢ়তার সঙ্গে তা অস্বীকার করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আবার বলেছে, একশ শতাংশ মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। যদিও শুধু ওই হাসপাতালকেই নয়, রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে শুক্রবার রাতে ইজরায়েলের প্রতিনিধি জিলাদ এরদান বলেছেন, ‘ওই হাসপাতালে সকলেই হামাস। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থার যারা আছে তারা হামাস। অ্যাম্বুল্যান্সের চালকরা সবাই হামাস। রাষ্ট্রসঙ্ঘের যে প্রতিনিধি রয়েছেন তিনি হামাস। হামাসের কথারই প্রতিধ্বনি করছেন রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব গুতেরেস।’ হাসপাতালে আক্রমণ না চালানোর যে নিয়ম যে কোনও যুদ্ধে মান্য করা হয়, ইজরায়েল তা প্রথম দিন থেকেই অগ্রাহ্য করেছে। ২১টি হাসপাতালে তারা আক্রমণ চালিয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থার তরফে ইজরায়েলের প্রতিনিধির মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে বলা হয়েছে, ‘আনরোয়া’-র কেউ হামাসের সদস্য নন। তাঁরা শিক্ষক, চিকিৎসক, নিকাশি কর্মী, সহায়তা কর্মী। রাষ্ট্রসঙ্ঘ শুধু তাঁদের অনুমোদন দেয়নি, এই তালিকা ইজরায়েলের হাতেও রয়েছে। ৭ অক্টোবর থেকে শরণার্থী সংস্থার ১০০জন কর্মী নিহত হয়েছেন।
গাজার পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার আরব লিগ ও ইসলামিক দেশগুলির সংগঠন ওআইসি একসঙ্গে বৈঠকে বসেছিল। আরব লিগ পৃথকভাবে বসলেও মতৈক্য হয়নি। দুই সংস্থার মিলিত বৈঠকে আরব দুনিয়ার দেশগুলি গণহত্যার নানা ভাষায় নিন্দা করলেও, যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও সেই লক্ষ্যে কোনও পদক্ষেপের কথা জানায়নি। ইজরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা, তেল সরবরাহ বন্ধের হুঁশিয়ারি দেওয়া, ইজরায়েলী বিমানের আকাশপথে নিষেধাজ্ঞা জারির মতো বিক্ষিপ্ত প্রস্তাব এলেও ঐকমত্য হয়নি। হামাসের মুখপাত্র বলেছেন, আরব দেশগুলির বৈঠকে কার্যকরী কিছু হবে না, আমরা জানতাম। ওদের উচিত এই মুহূর্তে ইজরায়েলী আগ্রাসন বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া। মানবিক সাহায্য পাঠানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু গত তিন দশক ধরে তথাকথিত শান্তি আলোচনা হয়েছে শুধু ইজরায়েলের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে, সেই জন্যই শান্তি প্রক্রিয়া কোনোদিন ফলপ্রসূ হয়নি।
বরং শনিবার লন্ডনে প্যালেস্তাইনের সমর্থনে বিশাল মিছিল হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধবিরতির স্মরণে ‘অস্ত্রবিরতি’ দিবস পালিত হয় প্রতি বছর ১১ নভেম্বর। এদিন কট্টর দক্ষিণপন্থীদের জমায়েত হয় তার স্মারকে। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সালি ব্রেভারম্যান প্যালেস্তাইনের সংহতিতে প্রস্তাবিত মিছিলকে ‘ঘৃণার মিছিল’ বলে বিতর্কিত ভাষণ দেবার পরেই এই অতি দক্ষিণপন্থীরা এদিন হাঙ্গামা শুরু করে। কিন্তু পরে গাজায় গণহত্যা বন্ধ ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে বিশাল মিছিল ও সমাবেশে লন্ডন শহরের বিস্তীর্ণ প্রান্ত ভেসে গেছে।
Comments :0