বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর কালে সাম্রাজ্যবাদের যাবতীয় চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যে উপায়ে তার অর্থনৈতিক আগ্রাসনের উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালাত সেই ধারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে পরিবর্তিত হল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দরুণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর কালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধীরে ধীরে কমজোরি হয়ে পড়ে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। মার্কিন কর্তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের স্বার্থে যে কলাকৌশল নিতে শুরু করে, তা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম সর্বাত্মক প্রতিরোধের মুখে পড়ে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দক্ষিণ এশিয়ায় তার আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সবথেকে নির্ভরযোগ্য বোড়ের চাল হিসেবে বেছে নিয়েছিল ধর্মান্ধ জাতীয়তার উপর ভিত্তি করে পাকিস্থান নামক দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল বলেই ।তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের একদম প্রথম যুগের শাসকেরা ,জিন্না, লিয়াকত আলী , এরা ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদ কে ভিত্তি করে একটি রাষ্ট্র নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্রিটিশ এবং হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তির সহায়তায় কায়েম করবার পর, ধর্মীয় বিভাজনকেই রাষ্ট্র পরিচালনার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ভেবে নিয়েছিল ।
পাকিস্তান সংবিধান সভায় জিন্নার যে লোক দেখানো ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আকাঙ্ক্ষা যুক্ত বক্তৃতা ,তা ছিল তার গোটা জীবনের রাজনৈতিক ভন্ডামীর অন্যতম সেরা উদাহরণ। লিয়াকত আলির হত্যার পর ধীরে ধীরে যেভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন যন্ত্র ফৌজি কর্তাদের হাতের মুঠোয় এসে পড়ে ,তার পেছনে যেমন একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদত ছিল ,অপরদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই সহায়তার সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ,পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা ,তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আর্থ -সামাজিক -সাংস্কৃতিক- ধর্মীয়, সমস্ত ক্ষেত্রেই পবিত্র ইসলামের নিজেদের মনগড়া ,বিকৃত ভাবনার অবতারণার ভেতর দিয়ে ,এক ধরনের অদ্ভুত ইসলামী য় সমাজের নাম করে, ধর্মান্ধ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে চায়।এই কাজ তারা করেছিল নিজেদের ফৌজি শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়ার তাগিদে।সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহের উপন্যাস ' লালসালু' ,আহমদ ছফার উপন্যাস' ওঙ্কার' বা তারেক মাসুদের ফিল্ম,' মাটির ময়না' তে পরিস্কার পূর্ব পাকিস্থানের জন্যে পশ্চিমের সামরিক শাসকেরা কি ধরণের সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে উন্মুখ ছিল।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে তখন সবথেকে বড় শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন ।আর এই সোভিয়েত ইউনিয়নকে পর্যুতস্ত করবার লক্ষ্যেই তারা তাদের যাবতীয় আগ্রাসন চালাতে বোড়ের চাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ফৌজি শাসকদের। পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যে ভাষা জনিত সংকট পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, তার মূল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল; পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক শোষণ। এই অর্থনৈতিক শোষণের সূচনা, পূর্ব পাকিস্তানের উপরে, পশ্চিম পাকিস্তান কাগজে-কলমে প্রথম শুরু করে জিন্নাহের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে 'জিন্না ফান্ড' নামক একটি তহবিল তৈরি করে, মুসলিম লীগ এবং মুসলিম সম্প্রদায়িক মৌলবাদী লোকেদের মাধ্যমে হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালি সমাজের উপর অর্থনৈতিক জুলুমবাজির ভেতর দিয়ে। এই জুলুমবাজির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ই কিন্তু সদ্য সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তানের মানুষের পক্ষে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ।
বঙ্গবন্ধুর নিজের জেলা আবিভক্ত ফরিদপুর জুড়ে এই' জিন্না ফান্ডে' র নাম করে সেই সময়ের মুসলিম লীগ নেতারা সাধারণ গরীব গুর্বো বাঙালির উপরে যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক অত্যাচার চালিয়েছিল ,তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়িয়ে ,পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ সম্পর্কে প্রথম বাঙালি কে সচেতন করবার ক্ষেত্রে '৪৭ সালের অব্যবাহিত পরেই, শেখ মুজিবুর রহমান যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন ,সেই ভূমিকাই কিন্তু মহান ভাষা আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে মানুষকে সঙ্ঘবদ্ধ করে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে লড়াইয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।
সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে '৪৭ সালে যেহেতু দেশভাগ হয়েছিল, সেইহেতু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, দক্ষিণ এশিয়ায় ,সেই সময়ের জাজ্জ্বল্যমান সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব খর্ব করে, নিজেদের প্রভাব বিস্তার করবার লক্ষ্যে ,সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার এবং প্রয়োগকে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উপকরণ হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সেই লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করতে তাদের কাছে সব থেকে আকর্ষণজনক দেশ ছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান এবং তাদের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল কারি ফৌজি শাসকেরা।
ভারতের সাথে যেহেতু সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ,তাই ভারতকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সোভিয়েট ইউনিয়নকে জব্দ করে, দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পথকে বিস্তৃত করা লক্ষ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিম পাকিস্তানকে '৪৭ উত্তর সময়কাল থেকেই মদত দিতে শুরু করে। আর পশ্চিম পাকিস্তানের ফৌজি শাসকেরা ,পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপর অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে, পশ্চিম পাকিস্তানকে শিল্পে, সম্ভ্রমে, বিলাসিতায় একটা বিশেষ উচ্চ শিখরে পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে ( রাওয়ালপিন্ডি শহর নির্মাণ যার একটি বড় উদাহরণ) পূর্ব পাকিস্তানের চালাতে শুরু করে বিভাজনের রাজনীতি। সেই বিভাজনের রাজনীতি কে তারা পরিচালিত করে দুটি সমান্তরাল ধারায় ।একটি হল; ভাষাভিত্তিক বিভাজন যেখানে তারা বাঙালি ও অ বাঙালির মধ্যে একটা বিভাজনের অক্ষরেখা টেনে, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার ভেতর দিয়ে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার পথকে শক্তিশালী করতে সচেষ্ট হয় ।
অপরদিকে তারা আগ্রাসী হয় সরাসরি ধর্মীয় বিভাজনের মাধ্যমে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিরোধ তৈরি করে, একদম ফ্যাসিবাদী কায়দায় ,পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দু শূন্য করে ,এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করতে। যে অরাজক অবস্থার ফলশ্রুতি ভারতের উপরে পড়বে, ভারতেও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি নতুন ভাবে দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক বিভাজনের লক্ষ্যে উৎসাহিত হবে ।ভারত থেকেও মুসলমান উৎখাতের প্রশ্নে ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি নতুন উদ্যমে তাদের মুসলমান বিরোধী অত্যাচার কে সক্রিয় করে তুলবে।
মহান ভাষা আন্দোলনের উপাদান হিসেবে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার লড়াই বিশেষভাবে আলোচিত হলেও, গোটা আন্দোলনের সুরটি কিন্তু বেঁধে দিয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ। পশ্চিম পাকিস্তান, নিজেদের অর্থনৈতিক শোষণকে আরও দানবিক করবার লক্ষ্যেই ,তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সেই সময়ের এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ভেতর দিয়ে আজ কিন্তু আমরা এই একুশ শতকের প্রায় মধ্যপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, সাম্রাজ্যবাদের শোষণের নানা ধরনের মাত্রাগুলোর গতিপ্রকৃতির একটা পূর্বতন ধারাকে উপলব্ধি করতে পারি।
আজকের ভারতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, তার অর্থনৈতিক আগ্রাসনকে আরো সুতীক্ষ্ণ করে তোলবার তাগিদ থেকেই, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরবর্তী সময়কাল থেকে ভারতের বুকে ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদত জুগিয়ে এসেছে একটা নতুন আঙ্গিকে।এটা ভুলে গেলে চলবে না যে ,সোভিয়েট ইউনিয়নের উপস্থিতির কালে কিন্তু হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি ,আরএসএস বা তার বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক সংগঠনগুলি ; হিন্দু মহাসভা, ভারতীয় জনসঙ্ঘ বা আজকের বিজেপি, ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাজে কিন্তু সফল হয়নি। আরএসএস- বিজেপি বা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাফল্য অর্জন করে কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরবর্তী জাতীয়- আন্তর্জাতিক স্তরের রাজনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ গ্রহণ করে।
এই পর্যায়ে টি এই কারণে আলোচনার মধ্যে আনা হচ্ছে যে, সাম্রাজ্যবাদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর কালে তাদের আগ্রাসনের যে ধারাটিকে অবলম্বন করে তৃতীয় বিশ্ব সহ ,দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ গুলিতে নখ দন্ত বিস্তারের চেষ্টা করে ,সেই চেষ্টায় তাদের প্রথম লক্ষ্য হয় সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র গুলির উপরে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিকভাবে বিভাজনকে স্থায়ী করা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ।এই কাজে জিন্না, লিয়াকত আলী থেকে ইস্কান্দার মির্জা ,আইয়ুব খান ইয়াহিয়া খান ,জুলফিকার আলী ভুট্টো-- কেউই ব্যতিক্রম ছিলেন না ।পূর্ব পাকিস্তানের উপর অর্থনৈতিক শোষণ চালিয়ে, পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধশালী করার লক্ষ্যে যে শোষণ প্রক্রিয়া জিন্না শুরু করেছিলেন ,সেই প্রক্রিয়ারই অঙ্গ ছিল রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে , প্রথম পাকিস্তান কায়েমের পর ঢাকায় এসে ,জিন্নার উর্দু ভাষার পক্ষে ওকালতি ।
পরবর্তীকালে পাকিস্তানের তথাকথিত গণতান্ত্রিক নেতা থেকে শুরু করে, ফৌজি শাসকেরা ,প্রত্যেককেই নিজের নিজের মতো করে ,নিজেদের শাসন ক্ষমতা কে দীর্ঘস্থায়ী করবার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সমাজের উপরে বিভাজনকে কায়েম করে গেছেন। সেই লক্ষ্য স্থির করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা এ কে ফজলুল হক , হোসেন শাহিদ সোহরাওয়ার্দির মত প্রবীণ নেতাদের উপর নানা ধরনের রাজনৈতিক সন্ত্রাস চালিয়েছে ।সেই সন্ত্রাসের অঙ্গ হিসেবেই কি পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে হোসেন শাহিদ সোহরাওয়ার্দির রহস্যজনক মৃত্যু ঘটেছে ? এই প্রশ্ন কিন্তু আজও অমীমাংসিত থেকে গেছে ।একটা বড় অংশের গবেষকদের অনুমান ; পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা শ্লো পয়জেনিং করে পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে হোসেন শাহিদ সোহরাওয়ার্দীকে হত্যা করেছিল পশ্চিমের শাসকেরা।
প্রসঙ্গটি এই কারণে এখানে উল্লেখ করা হলো যে ,তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্বহীন করবার লক্ষ্যে যেভাবে সোহরাওয়ার্দী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনা পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব করেছিল এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার পেছনে পাকিস্তান এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যে ভূমিকা, সেই ধারাপ্রবাহ কিন্ত মার্কিন- পাক মহলে আজ ও বজায় আছে।এই প্রবণতাতেই কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে এবং অবশ্যই পাকিস্তানের বর্তমান শাসক ও ফৌজি কর্মকর্তাদের অঙ্গুলী হেলনে প্রায় সব সময় চলে আসছে শেখ হাসিনাকে হত্যার নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র।
মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্র ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তান পর্যুদস্ত হওয়ার পর থেকেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের উপর নতুন ধরনের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে যৌথভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান ।পাকিস্তানের লক্ষ্য হয়, আন্তর্জাতিক দুনিয়াতে যাতে কোনোভাবেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে না পারে , সেই দিকে নজর দেওয়া ।আর সেই লক্ষ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চিনকে ও ব্যবহার করে ,সদ্যসাধীন বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করবার কাজটিতে পাকিস্তান বিশেষভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
এই কাজে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালেই বাংলাদেশের ভেতরে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতি করা একদল মানুষ বিশেষভাবে সক্রিয় থেকে ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে , সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকদের একটা বড় অংশ, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী অংশের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়েও ,মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধা চরণ করে গিয়েছিল ।কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে এই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতির লোকজনেরা প্রকাশ্যেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে গিয়েছিল। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলি যাতে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি, সহানুভূতিশীল না হন, তার জন্য যতখানি সক্রিয় ভূমিকা পালন করা তাদের পক্ষে সম্ভব , সেই ভূমিকা তারা পালন করে গেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী অংশ ;রাজাকার, আল-বাদার -আলসামমসেরা একটা আঙ্গিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। ইসলামীয় মৌলবাদের প্রতি নিজেদের আস্থা অক্ষুন্ন রেখে মহান মুক্তিযুদ্ধের যে ধর্মনিরপেক্ষ, সম্প্রদায়িক সম্প্রীতিমূলক চেতনা , তার বিরোধিতা করে ,পবিত্র ইসলামের এক বিকৃত উপস্থাপনায় বাংলাদেশকে একটি পাকিস্তানের ধর্মান্ধ উপনিবেশে পরিণত করতে চেয়েছে।
অপরপক্ষে এই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতির লোকজনেরা কোনরকম রাজনৈতিক যুক্তিতর্কের অবতারণা না করেই বাংলাদেশের বিরোধিতার প্রশ্ন আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীতার প্রশ্ন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের প্রশ্ন কে একাত্ম করে ,সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিন্যাসকে মাথায় রেখে ,সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চিনের মধ্যে যে বিরোধ ছিল, তাকে কাজে লাগিয়ে ,চিনকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ধরনের ভাবধারার বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছে ।এই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকদের প্ররোচনাকেই সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর জীবিত অবস্থায় পর্যন্ত চিন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে ন্যূনতম রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে শহিদ হওয়ার ঠিক পরের দিন ,খুনি মেজর চক্র ক্ষমতা দখল করবার পর ,চিন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
মহান বিজয় দিবসের পরবর্তী সময় থেকে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহিদ হওয়ার পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে সব রকম ভাবে বিধ্বস্ত করতে '৭৪ এর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি যেমন সক্রিয় ছিল ,তেমনি সক্রিয় ছিল বাংলাদেশের মধ্যে বসবাসকারী এই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতি সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজনেরাও।
বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার পর এই সংকীর্ণতাবাদী লোকজনেরা খুনি মেজরচক্রের সাথে প্রকাশ্যে আনন্দ উৎসব পর্যন্ত পালন করেছিল। বিজয় দিবসের অর্জনের পর ,সেই অর্জনকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে স্থায়ী করাটাই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ।নিজের জীবনকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় ।সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে জাতীয়- আন্তর্জাতিক স্তরে নানা ধরনের অপবাদ তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ভারত ,অবিভক্ত পাকিস্তান আমলে আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গার উপর ফারাক্কায় বাঁধ নির্মাণ করে, আন্তর্জাতিক নদীর প্রবাহমানতাকে বজায় রাখবার প্রশ্ন যে আইন কানুন রয়েছে ,তাকে লংঘন করে ,এক ধরনের অ বন্ধু সুলভ আচরণ প্রকাশ করেছিল।
সেই আচরণ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী রাজনৈতিক অবস্থাতেও ভারত বজায় রাখে ফারাক্কা বাঁধকে কেন্দ্র করে। অবিভক্ত পাকিস্তানের ফৌজি শাসক আইয়ুব খানের শাসনকালে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখবার তাগিদে যে ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা ভারত করেছিল( কপিল ভট্টাচার্যের মত নদী বিশেষজ্ঞেরা গঙ্গার গতিপথ বদল কে কেন্দ্র করে এই পরিকল্পনার যৌক্তিকতা নিয়ে তখন ই প্রশ্ন তুলেছিলেন) সেই পরিকল্পনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর বজায় রাখবার কোনো রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক যুক্তি কিন্তু ছিল না ।
ইন্দিরা গান্ধীর ফারাক্কা বাঁধকে ঘিরে যে জেদ , অচিরেই তাকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের উপর ভারতের একটা নয়া সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা হিসেবে দেখাবার চেষ্টা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান করবে এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ইসলামী য় ধর্মান্ধরা করবে --এটা না বোঝবার মতো রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা কিন্তু শ্রীমতি গান্ধীর ছিল না। খুব দুর্ভাগ্যের বিষয় , অবিভক্ত ভারতে আসাম বিধানসভায় যে মাওলানা ভাসানী একটা সময়ে অত্যন্ত প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন ,সেই মৌলানা ভাসানীই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতির অন্যতম প্রধান মুখপাত্র হয়ে, এই ফারাক্কা বাঁধকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অপবাদ বিস্তারের প্রধান মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করলেন।
বঙ্গবন্ধু শহিদ হওয়ার অব্যবাহিত পরে রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করার সময়ে কাগমারির ভাসানী নিজে বাংলাদেশে ফরাক্কা লং মার্চের ডাক দিয়েছিলেন। এই কর্মকান্ড ভারতের ক্ষেত্রে যেমন সুখপ্রদ হয়নি, তেমনি ই বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ও তা কোনো অবস্থাতেই সুখপ্রত হয়নি। মৌলানা ভাসানীর এই ফারাক্কা লং মার্চের ফলেই বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী যে অংশ তখনো মনেপ্রাণে চাইত , আবার বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাক এবং পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশ হিসেবে ই বাংলাদেশের অস্তিত্ব বজায় থাকুক, তারা ভাসানীর এই কর্মকাণ্ডে নতুনভাবে উৎসাহ লাভ করল বলা যেতে পারে।
বঙ্গবন্ধু নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর গোটা বাংলাদেশ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী ,পাকিস্তান প্রেমীদের সঙ্গবদ্ধ হওয়ার সুযোগ এই ফারাক্কা লং মার্চের ভেতর দিয়ে মাওলানা ভাসানী এনে দিয়েছিলেন , এটিই অচিরেই রাজাকারদের বাংলাদেশের আর্থ- সামাজিক -সাংস্কৃতিক, সবদিক থেকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান, স্বৈরাচারী এরশাদ বা পরবর্তীকালে খালেদা জিয়ার পক্ষে বিশেষ রকমের সহায়ক হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়কাল থেকে গোটা বাংলাদেশে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, ধর্মান্ধ মৌলবাদী চেতনা সম্পৃক্ত রাজনৈতিক এবং সামাজিক পটভূমিকা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে, সেই পটভূমিকার ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে, মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী পাকিস্তান প্রেমী ,রাজাকার আল-বাদার, যুদ্ধাপরাধীদের ভূমিকার পাশাপাশি সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতির লোকজনদেরও একটা বড় রকমের ভূমিকা রয়েছে। এই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকরা বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতির প্রকৃত গতিপ্রকৃতির প্রবাহমানতা কে অবরুদ্ধ করবার জন্য, বাজার চলতি নানা ধরনের শ্লোগান, কথাবার্তার অবতারণা করে। সেসব গুলি তারা পশ্চিমবঙ্গেও এমন ভাবে সার্কুলেট করে ,যার দ্বারা পশ্চিমবঙ্গে যারা বাংলাদেশ সম্বন্ধে খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ খবরা খবর রাখেন না, তারাও সেখানকার ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে ভুল ধারণার শিকার হন।
এই সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকদের বাংলাদেশ কর্মকাণ্ড কে পশ্চিমবঙ্গের একটা বড় অংশের মানুষ বাংলাদেশের বামপন্থীদের কর্মকাণ্ড বলে ভুল ধারণা করেন । সেই ভুল ধারণা থেকে তাদের বাংলাদেশের বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের সম্পর্কেও একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয় ।বিএনপি জামাতের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী শিবিরের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে, বাংলাদেশের সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতিকরা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে অগণতান্ত্রিক আক্ষায় ভূষিত করে, এমনভাবে গোটা দুনিয়ার কাছে উপস্থাপিত করতে চায়, যা আসলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধীদের ই শক্তি বৃদ্ধি করে।পাকিস্তানের পক্ষের শক্তিকে আমেরিকার তোষামদকারী শক্তিকে আবার বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন করবার একটি পদক্ষেপ ।বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের ছায়া উপনিবেশে পরিণত করবার একটি ভিন্ন প্রচেষ্টা ।
এই কাজে পশ্চিমবঙ্গের সংকীর্ণতাবাদী রাজনৈতিক দের সঙ্গে বাংলাদেশের সংকীর্ণতাবাদী রাজনৈতিক দের একটা অলিখিত বোঝাপড়া রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে সংকীর্ণতাবাদী রাজনীতির নাম করে নিজেদের লেখক শিল্পী হিসেবে তুলে ধরা একদল লোক , বঙ্গবন্ধুকে খাটো করবার তাগিদ থেকেই ,মওলানা ভাসানীকে নিয়ে একটা আশ্চর্য রকমের শোরগোল তুলছে ।বই লিখছে। আলোচনা করছে। সামাজিক গণমাধ্যমে লিখছে ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ সেই সময়ের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মানুষজন, বিভিন্ন বামপন্থী ব্যক্তিত্ব এবং সামাজিক ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যাঁরা মুক্তবুদ্ধির চেতনার বিকাশে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, যেমন; সুফিয়া কামাল, কলিম শরাফি, শামসুর রাহমান, কবীর চৌধুরী ,অনুপম সেন ,দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য বর্তমান সময়ের সুলতানা কামাল প্রমুখের ভূমিকা কে নস্যাৎ করে, বাংলাদেশের সমার্থক হিসেবে মাওলানা ভাসানীকে উপস্থাপিত করে ,একেবারে আরএসএস বিজেপির আদলে ,বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা বিকৃত অধ্যায় রচনা করতে চায়।
বাংলাদেশ বসে এই ধরনের বিকৃত ইতিহাস রচনা বিএনপি- জামাত করে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। ঠিক সেই আদলেই এপারের বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সম্পর্কে বা তাঁর কন্যা ,বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে একটা বিকৃত ধারণার, অনৈতিহাসিক ধারণার ভেতর দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী, পাকিস্তান প্রেমী ,মার্কিন প্রেমী, একটা ধ্যান ধারণা তারা গেঁথে দিতে চায়। আসলে তাদের মূল উদ্দেশ্য সি এ এ, এন আর সি ইত্যাদির নাম করে আরএসএস- বিজেপি যেভাবে ভারতকে মুসলিমশূন্য দেশে পরিণত করতে চায়, বিএনপি-জামাত যেভাবে বাংলাদেশকে হিন্দু-শূন্য দেশে পরিণত করতে চায়, সেই জঘন্য মানবতাবিরোধী কার্যক্রমকেই শক্তি যোগান দেওয়া।
Comments :0