শুধুমাত্র কর্মচারীদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাজ্য সরকার পূরণ করেনি তা নয়, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে যে অজস্র প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটাই পূরণ করা হয়নি। সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে যে দাবিটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো মহার্ঘভাতার দাবি। ২০১১ সালে যখন রাজ্যে রাজনৈতিক ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটে, তখন সংশ্লিষ্ট অংশের বকেয়া মহার্ঘভাতার পরিমাণ ছিল ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে ১০ শতাংশ মহার্ঘভাতা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে বিধানসভায় পেশ করা ভোট অন অ্যাকাউন্ট বাজেটে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ প্রকৃত বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬ শতাংশ। রাজ্যে পট পরিবর্তনের পরে, নব নির্বাচিত রাজ্য সরকার পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করে। কিন্তু সেখানে কর্মচারীদের মহার্ঘভাতা সম্পর্কে কোনও কথা বলা হলো না। নির্দিষ্টভাবে মহার্ঘভাতার জন্য যে অর্থের সংস্থান পূর্ববর্তী বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল, সেই অর্থে মহার্ঘভাতা না দিয়ে কোন খাতে খরচ হলো, তাও জানা গেল না। অর্থাৎ শুরু থেকেই মহার্ঘভাতা সম্পর্কে বৈরী মনোভাব নিয়ে সরকার চলতে শুরু করল। দিন, মাস, বছর পেরনোর সাথে সাথে এই বৈরী মনোভাব বেড়েছে, কমেনি। ফলত বকেয়া মহার্ঘভাতার পরিমাণও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এই সরকার কি একেবারেই মহার্ঘ্যভাতা দেয়নি? হ্যাঁ দিয়েছে। কিন্তু সেই দেওয়ার মধ্যেও ‘অধিকারের স্বীকৃতি’-র পরিবর্তে এক ধরনের দাক্ষিণ্যের ব্যঞ্জনা রয়েছে। কারণ রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে মহার্ঘ্যভাতা প্রদানের দেশব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি হলো, কেন্দ্রীয় হারকে অনুসরণ করা এবং কেন্দ্রের মতোই বছরে দু’বার (জানুয়ারি ও জুলাই মাস ধরে) মহার্ঘ্যভাতা ঘোষণা করা। যেহেতু মহার্ঘ্যভাতা সরাসরি ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচকের সাথে সম্পর্কিত এবং সারা দেশে খাদ্যশস্য সহ বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের গড় মূল্যবৃদ্ধির ভিত্তিতে মূল্যসূচক নির্ধারিত হয়। স্বভাবত তা সারা দেশের ক্ষেত্রেই এক। আবার মূল্যসূচকের ওপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় সরকার মহার্ঘভাতার হার নির্ধারণ করে। মূল্যসূচকের সমতার কারণেই মহার্ঘ্যভাতার হারের সমতা বিধান জরুরি। কেন্দ্রীয় সরকার ভোগ্যপণ্যের মূল্য সূচকের ভিত্তিতে যেভাবে মহার্ঘভাতার হার নির্ধারণ করে তার মধ্যেও কারচুপির সম্ভাবনা থাকে। এতদ্সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় হারকে অনুসরণ করেই সমস্ত রাজ্যের সরকার স্ব স্ব রাজ্যের কর্মচারীদের মহার্ঘ্যভাতা প্রদান করে। ব্যতিক্রম পশ্চিমবাংলা।
এটা ঠিক মহার্ঘভাতার বিষয়টি নিয়ে মিডিয়া আগের অনেক বেশি সরব। একদিকে আদালতে মামলা, অপরদিকে কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘভাতার দাবিতে রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটি সহ বিভিন্ন সংগঠনের উপর্যুপরি আন্দোলন মিডিয়াকে এদিকে দৃষ্টি ফেলতে বাধ্য করেছে। কিন্তু মহার্ঘভাতাকে কেন্দ্র করে মিডিয়ার প্রচারের ধরন কখনও কখনও জনমানসে এমন ধারণা তৈরি করে যে, সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীরা বুঝিবা তাঁদের বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছে। কিন্তু মহার্ঘভাতা মানে তো বেতন বৃদ্ধি নয়। মূল্যবৃদ্ধির কারণে সংশ্লিষ্ট অংশের ক্রয়ক্ষমতার যে ক্ষয় ঘটে, তাকে পূরণ করার জন্যই দেওয়া হয় মহার্ঘভাতা। এই প্রসঙ্গে যা উল্লেখ করা দরকার তা হলো, এরাজ্যের সরকারি কর্মচারি, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের বামমনস্ক সংগঠনগুলি একটি বিষয়ে ভীষণভাবে সচেতন, তা হলো মহার্ঘভাতার মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির কোপ থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়ার সুযোগ সীমিত অংশের পেশাজীবীদের রয়েছে। জনসমাজের সিংহভাগ অংশের মহার্ঘভাতা পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তাই কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের বামমনস্ক সংগঠনগুলি মহার্ঘভাতার দাবির সাথে মূল্যবৃদ্ধি রোধের দাবিও জানায়। বৃহত্তর জনসমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার এ এক অনুপম নিদর্শন। আর এই কারণেই রাজ্য কোষাগার থেকে বেতন প্রাপ্তদের সাথে, সংগঠিত-অসংগঠিত অপরাপর অংশের ঐক্যের বাতাবরণ ছিল এরাজ্যের বৈশিষ্ট্য।
বর্তমান শাসকদল এই ঐক্যটাকেই কৌশলে ভাঙার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন সময়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য একথাও বলা হচ্ছে যে, কর্মচারী, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা নন, অপরাপর অংশের মানুষের স্বার্থ রাজ্য সরকারের অগ্রাধিকার মুখে একথা বলা হলেও কোনও অংশের মানুষের সমস্যার সুরাহা করার কোনও গঠনমূলক উদ্যোগ রাজ্য সরকারের নেই। কৃষি-শিল্প-পরিষেবার হতশ্রী দশাই তার প্রমাণ। রাজ্যের কোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত কর্মচারী, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা নিজেদের মহার্ঘভাতার দাবি জানানোর পাশাপাশি রাজ্য প্রশাসনে, সরকারি ও সরকার-পোষিত বিদ্যালয়গুলিতে কয়েক লক্ষ শূন্যপদ পূরণের দাবিও বার বার করেছে। জনসমাজের অপরাপর অংশের দ্বার্থই যদি রাজ্য সরকারের অগ্রাধিকার হতো, তাহলে এই দাবি এতদিনে মান্যতা পেত। কিন্তু পায়নি। তবে বর্তমান সময়ে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে যেভাবে দুর্নীতির ঝাঁপি জনসমক্ষে খুলে যাচ্ছে, তাতে শুধু নিয়োগ নয়, স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগের প্রসঙ্গটিও সামনে চলে আসছে।
একদিকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত, কর্মক্ষম বেকার যুবক-যুবতীদের মজুত বাহিনী, অপরদিকে লক্ষ লক্ষ শূন্যপদ। অথচ স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক অনিয়মিত নিয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনকে সচল রাখা হচ্ছে। বেকারি ও দারিদ্রের মরণফাঁদে আটকে থাকা এরাজ্যের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিতান্ত বাধ্য হয়েই এই অমানবিক শোষণের জাঁতাকলে নিজেদের সঁপে দিচ্ছেন। কারণ রোজগারের এই খড়কুটোটাকেও ছেড়ে দেওয়া মানে অভুক্ত বা অর্ধভুক্ত থাকা।
মহার্ঘভাতাকে কেন্দ্র করে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিভিন্ন অপমানজনক মন্তব্য, স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে চুক্তি নিয়োগ বা বিভিন্ন লোক দেখানোর অন্তঃসারশূন্য প্রকল্পের ঘোষণাকে এক বন্ধনীর মধ্যে এনে বিচার করলে বোঝা যায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল অন্তর্বস্তুটাই পালটে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হলো শাসক ও অধিকারবোধসম্পন্ন নাগরিকের আন্তঃসম্পর্ক। কিন্তু রাজ্যের বর্তমান শাসকদলের লক্ষ্য হলো অধিকারবোধসম্পন্ন নাগরিকদের রাজা (রানি)-র আনুকূল্যের ওপর নির্ভরশীল প্রজায় পরিণত করা। যেখানে প্রজা একজন ‘মসীহা’-র দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে দিনগুজরান করবে। তাই অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে রক্ষা করার লড়াই।
নিজেদের অধিকার রক্ষা, অপরাপর অংশের স্বার্থকে সুরক্ষিত করা এবং গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার ত্রিবিধ লক্ষ্য নিয়েই ২৩ নভেম্বরের বিধানসভা অভিযানের কর্মসূচি। রাজ্য কোষাগার থেকে বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারী, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের সম্মিলিত রোষে উত্তাল হবে কলকাতার রাজপথ। স্বৈরশাসকের বুকে কাঁপন ধরাতে শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি।
Comments :0