শুভম শর্মা
একটি বিখ্যাত তুর্কি প্রবাদ আছে; ‘যখন একজন জোকার একটি রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে, তখন সে রাজা হয় না, বরং রাজপ্রাসাদটি একটি সার্কাস হয়ে যায়’। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক হোয়াইট হাউস প্রাসাদের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প পশ্চাৎপদ, নিষ্ঠুর, বর্ণবাদী এবং উত্তেজক প্রচারের মাধ্যমে আমেরিকার ৪৭তম রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তার প্রচারে সবচেয়ে বড় প্রতারণা ছিল, তিনি নাকি ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ এবং ‘ধনী অভিজাতদের’ বিরুদ্ধে, অথচ তিনি নিজেই অভিজাত শ্রেণীর এবং তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬.১ বিলিয়ন ডলার। তবুও প্রচারের ঝড় তুলে তিনি আমেরিকান শ্রমিকদের বোকা বানিয়ে তাদের ভোট পেতে সফল হয়েছেন। বর্তমানে, ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রপতি, এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৪৬০ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে একা এলন মাস্কের ব্যক্তিগত সম্পদ ৪০০ বিলিয়ন ডলার। এই হলো তাঁর ধনী অভিজাত বিরোধী অবস্থানে প্রকৃত স্বরূপ।
আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে, জনমুখী ফাঁকা স্লোগান দিয়ে একজন অতি ধনী ব্যক্তির রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা বিরল ঘটনা। বেশিরভাগ সময়, অতি ধনীরা পর্দার আড়াল থেকে পুতুল নাচের ওস্তাদের ভূমিকা পালন করে এবং সুতোর টানে পুতুলদেতর নাচায়। ভারতবর্ষের মোদী এর সেরা উদাহরণ। সমগ্র বিশ্ব জানে যে ভারতীয় বৃহৎ বুর্জোয়ারা মোদীকে অভূতপূর্ব পরিমাণে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য দিয়েছে এবং দেয়, তবুও মোদী নিজেকে একজন দরিদ্র চা-বিক্রেতা, একজন ওবিসি, একজন ভবঘুরে ব্যাচেলর এবং একজন ‘তপস্বী’হিসাবে তুলে ধরেন। দারিদ্র্য এবং কষ্টের জীবন যাপনের একটি আবরণ তৈরি করেন। তিনি আসলে তার পৃষ্ঠপোষকদের আড়াল করার জন্যই এই ভেক্ ধরেন।
ট্রাম্প আবার এই রেসিপি অনুসরণ করেন না। তিনি তার সম্পদ সর্বসমক্ষেই সদর্পে ঘোষণা করেন। তিনি কর্পোরেট ধাঁচেই যে কোনও কাজ করে ফেলায় তার দক্ষতা ও ক্ষমতা নিয়ে গর্ব করে প্রচার করেন। তিনি ব্যবসায়ীদের মতোই আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন। আমেরিকান জনগণ এই সবকিছু ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে। কেন? আমেরিকা এমন একটি দেশ, যেখানকার মানুষ সুপারমার্কেটে গিয়ে পঞ্চাশ রকম ব্র্যান্ডের টুথপেস্ট দেখে তবেই কেনে, কিন্তু দুটি মাত্র রাজনৈতিক দলের মধ্যেই নিজেদের পছন্দকে সীমায়িত করে রাখে। ১৯৭০-এর দশক থেকে, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাজের অগ্রাধিকারগুলি প্রায় একইরকম। বিদেশে আমেরিকান আধিপত্য বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি এবং দেশে নব্য-উদারতাবাদ, এই দুটিই এই দুই দলের নীতিসমূহের মূল ভিত্তি ।
১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানের কারণে মার্কিন কোম্পানিগুলিকে তাদের উৎপাদন বিদেশে স্থানান্তরিত করতে শুরু করে, মূলত চীনে উৎপাদন খরচ আমেরিকার তুলনায় অনেক কম হওয়ার জন্য। এর ফলে আমেরিকায় উৎপাদন ক্ষেত্রের কর্মসংস্থান বিপুল পরিমাণে কমে যায়। ২০০০ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ক্ষেত্রে চাকরির সংখ্যা এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ ৩০.৬ লক্ষ কমে যায়। ১৯৯০ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে মার্কিন উৎপাদন ক্ষেত্রে কাজ হারানোর এক চতুর্থাংশ এবং ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ব্রিটেনের এক পঞ্চমাংশ থেকে এক তৃতীয়াংশ কমে যাওয়া কারণ ছিল, মূলত চীনে এসব দেশের উৎপাদন কেন্দ্রগুলি চলে যাওয়া। এই পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল কর্পোরেট সংস্থাগুলির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ কমে যাওয়ায় অনেক বেশি মুনাফা বৃদ্ধি। সস্তা ও দক্ষ চীনা শ্রমিক পাওয়ায় ওইসব দেশ থেকে উৎপাদন কেন্দ্রগুলি চীনের অভিমুখে চলে গেছে। নিজেদের দেশে প্রতিযোগিতাহীন উৎপাদন ব্যবস্থা ছেড়ে চলে যাওয়ায় মার্কিন উৎপাদকরা দ্বিবিধ সুবিধা লাভ করে। উচ্চ-মূল্যের পণ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করার সুযোগ পায় এবং একই সাথে, বিশেষ করে আমদানি করা বস্ত্র এবং ইলেকট্রনিক্স জাতীয় পণ্যের উপকরণ কম দামে পেতে শুরু করে। শ্রমবাজার আরও মেরুকৃত হওয়ার সাথে সাথে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্পশিক্ষিত পুরুষ এবং মহিলারা ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ে। ১৯৭৯ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ বিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ছাড়া ব্যক্তিদের প্রকৃত মজুরি ১৬ শতাংশ কমে যায়, যেখানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী পুরুষদের আয় ২৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। গত বছর আমেরিকানদের মধ্যে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী ভোটার ছিল ৪৩ শতাংশ। সেই গোষ্ঠীর মধ্যে, ৫৫ শতাংশ কমলা হ্যারিসকে ভোট দিয়েছেন এবং ৪২ শতাংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। যারা স্নাতক নয়, তাদের ক্ষেত্রে ভোটদানের চেহারাটা ঠিক উলটো ছিল, ৪২ শতাংশ হ্যারিসকে ভোট দিয়েছেন এবং ৫৬ শতাংশ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ট্রাম্প কিছু ভোটারদের শত্রু চিহ্নিত করে প্রচার করেছিলেন, তারা মূলত উদার অভিজাত, যারা আমেরিকান শ্রমিকদের কাজের বাজার থেকে পুঁজিকে চীনে স্থানান্তরিত করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে যে পুঁজিবাদীরা চীনে তাদের উৎপাদন কেন্দ্রগুলিকে স্থানান্তরিত করেছিল তাদের দোষ দেওয়া হয়নি, কারণ তাহলে আমেরিকাতে এদের বিরুদ্ধে শ্রেণিযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত।
দ্বিতীয় উদ্বেগের বিষয় হলো, ট্রাম্পের বিশ্বদৃষ্টি এবং যারা এটির বাস্তবায়ন করছেন তাদের প্রকৃত স্বরূপ। ট্রাম্পের প্রতিরক্ষা সচিব, পিট হেগসেথ একজন অতি-দক্ষিণপন্থী উন্মাদ, যিনি নিজেকে একজন খ্রিস্টান যোদ্ধা হিসাবে প্রচার করেন। তিনি বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে মধ্যযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। উদাহরণস্বরূপ, তার বই আমেরিকান ক্রুসেড-এ হেগসেথ লিখেছেন, ‘‘আমেরিকা উন্নতির শিখড়ে পৌঁছাবে। বামপন্থীদের নির্বাসিত করা হবে... কমিউনিস্ট চীন শেষ হয়ে যাবে এবং তারপর আরও দু’শো বছর ধরে তারা পতনের ক্ষত নিরাময়ে ব্যস্ত থাকবে। ইউরোপ আত্মসমর্পণ করবে এবং ইসলামবাদীদের আগেভাগেই বোমা মেরে ৭ম শতাব্দীর আগের অবস্থায় পাঠানো হবে। ইজরায়েল এবং আমেরিকা মুসলমান এবং আন্তর্জাতিক বামপন্থার অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াই করে আরও দৃঢ় বন্ধন তৈরি করবে।” ৫ মার্চ, হেগসেথ ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আমেরিকা চীনের সাথে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত।’’ হেগসেথ ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জ্ঞানার্জনের সাথে যুক্ত সমস্ত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে। তার যৌবনে, হেগসেথ খ্রিস্টান পুনর্গঠন নামক একটি অতি-রক্ষণশীল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এই গোষ্ঠী পরিবার, সমাজে মহিলাদের ভূমিকা এবং রাষ্ট্রে ধর্মের ভূমিকা সম্পর্কে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করত। এই আন্দোলনের অনুসারীরা প্রাচীন বাইবেলের আইন আরোপ করে আমেরিকাকে একটি খ্রিস্টান জাতিতে পরিণত করার লক্ষ্য ঘোষণা করেছিল। ২০২৪ সালের নভেম্বরে, হেগসেথ একটি দক্ষিণপন্থী চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, “অতীত ঐতিহ্য মেনে খ্রিস্টান স্কুলগুলির গোপন সেনাবাহিনী গড়ে তোলার জন্য তরুণদের নিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করা জরুরি, যাতে প্রয়োজনে যুদ্ধ করেই ‘খ্রিস্টান আমেরিকা’ গড়ে তোলা যায়।
ট্রাম্পের আরেকটি বিপজ্জনক নিয়োগ হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে মার্কো রুবিও। রুবিও কিউবার নির্বাসিত এক প্রতিক্রিয়াশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যারা কিউবা থেকে ফ্লোরিডায় স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। রুবিওর রাজনৈতিক জীবন জুড়ে, লাতিন আমেরিকার বামপন্থী নেতাদের প্রতি অত্যন্ত বিদ্বেষ মনোভাবাপন্ন ছিলেন। এদের তিনি স্বৈরাচারী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন বলে মনে করেন। রুবিও ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোর সরকারের বিরুদ্ধে আরও কঠোর নীতি গ্রহণের সমর্থক ছিলেন। ২০১৯ সালে তিনি মাদুরোকে "শাসন পরিবর্তন" হুমকি দিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভেনেজুয়েলার মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির সময়কালে, মাদুরো সরকারের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার সাথেসাথে রুবিও সামাজিক মাধ্যমে ‘নিহত এবং বন্দি স্বৈরশাসক’দের (কল্পনাপ্রসূত) বেশ কয়েকটি ছবিও পোস্ট করেছিলেন। রুবিও’র ব্যক্তিগত চরিত্র অনেকটা গিরগিটির মতো। তিনি প্রায়শই তার রাজনৈতিক রং পরিবর্তন করেন। ২০১৬ সালে, তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘গুন্ডা’বলেছিলেন, আবার এখন তিনিই ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চল রাশিয়াকে দিয়ে যুদ্ধ শেষ করার জন্য পুটিনের সাথেই আলোচনা করছেন। তিনি রাশিয়াকে চীন থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার কৌশলও তৈরি করছেন এবং সাম্রাজ্যবাদী মিত্রদের মাধ্যমে চীনকে বিচ্ছিন্ন ও ঘেরাও করার চেষ্টা শুরু করেছেন।
অনিশ্চয়তার এই বিশ্বে, ভারতের অবস্থান কোথায়? ভালো অবস্থায় নেই। আমরা দেখেছি, যখন ট্রাম্প আমেরিকান পণ্যের জন্য বেশি শুল্ক হারের জন্য ভারতকে তিরস্কার করেছিলেন, তখন মোদী কেমন নিশ্চুপ বোবা হয়ে ছিলেন। স্কুলের অধ্যক্ষের সামনে কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে যেমন একজন নার্ভাস স্কুল ছাত্র বসে থাকে, তেমনই অবস্থা হয়েছিল মোদীর। ট্রাম্প প্রশাসন ওবামা এবং বাইডেনের ‘এশিয়াকে কবজায় রাখার’নীতি অনুসরণ করবে এবং চাইবেই ভারতের মতো দেশগুলি আমেরিকার চৌকিদার হিসাবে কাজ করুক।
একে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। ট্রাম্পকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। তার এবং তার মন্ত্রীসভার চীন বিরোধিতা এবং যুদ্ধ বাধানোর মনোভাব, ভারত এবং সমগ্র বিশ্বকে খুব কঠিন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। আমেরিকান শাসকরা মিত্রদের পরিত্যাগ করার অভ্যাসে অভ্যস্ত বরাবরই। প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ‘সাক্ষাৎ শয়তান’ হেনরি কিসিঞ্জার একবার বলেছিলেন, ‘‘আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, কিন্তু আমেরিকার বন্ধু হওয়া আরও মারাত্মক”। মোদীর এই বিষয়টি মনে রাখা উচিত।
(প্রাবন্ধিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের … বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানের গবেষক)
Comments :0