এশিয়াতে হওয়া দু’টো বিশ্বকাপই ঢুকল লাতিন আমেরিকার ক্যাবিনেটে। ইউরোপকে ফিরতে হলো খালি হাতেই। কিন্তু আর্জেন্টিনা ফ্রান্সের বিশ্বকাপ ফাইনাল যথার্থই বিশ্বকাপ ফাইনাল হয়ে উঠল। বারবার উত্তেজনা, বিশেষত ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ম্যাচকে অন্য মাত্রা এনে দিল। নির্ধারিত ও অতিরিক্ত সময় যোগ করলে ৬টা গোল ও টাই ব্রেকারে আরও ৬টা গোল। মোট এক ডজন গোল হলো ম্যাচে। পেনাল্টি শুটআউটে স্বপ্নভঙ্গ হতেই ফ্রান্সের রাস্তায় শুরু বিক্ষোভ। সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াল পুলিশ, চলল লাঠি। কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয় বলেও দাবি সমাজমাধ্যমে। গ্রেপ্তার হন অনেক বিক্ষোভরত সমর্থক।
রবিবাসরীয় ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেন কিলিয়ান এমবাপে। কিন্তু তারপরও জয় অধরাই থাকলো লাল গোলাপের দেশের। ফরাসি কোচ ফ্রান্সের ১০ নম্বর জার্সির বিষয়ে বলেন, “কিলিয়ান সত্যিই এই ফাইনালে তার ছাপ রেখে গেছে। দুর্ভাগ্যবশত সে যেভাবে পছন্দ করতেন সেভাবে শেষ করতে পারেননি এবং সে কারণেই সে সব খেলোয়াড়ের মতো ম্যাচ শেষে হতাশ হয়েছিল।’’ ম্যাচের শেষে ফুটবলারদের উদ্দীপ্ত করার চেষ্টা করেন কোচ দিদিয়ের দেশঁ। তিনি বলেন, ‘‘আমরা দু’বার খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছি। তবু আমাদের চ্যাম্পিয়ন হতে না পারার আক্ষেপ থাকবে। অনুশোচনা থাকবে। আমরা অনেকটা দেরিতে বল ধরে খেলতে পেরেছি। ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকার পর ০-৩ ব্যবধানে যদি আমরা হেরে যেতাম, তা হলে সেটা আলাদা বিষয় হত। অবশ্যই আর্জেন্টিনার কৃতিত্ব হত। কিন্তু আমরা যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছি।’’
ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরিস বলেছেন, “এটি একটি বেদনাদায়ক গল্প। যে কোনও ক্ষেত্রে যা এক বেদনাদায়ক উপায়ে শেষ হয়। এটা সত্যি যে আমরা আমাদের প্রথমার্ধে কিছু করে উঠতে পারিনি। সঠিক ভাবেই এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। দ্বিতীয় পর্বের মাঝামাঝি সময়ে, কিলিয়ানের প্রতিভায় ২-২-এ ফিরে এসেছিল। এটা একটা বক্সিং ম্যাচের মতো ছিল, ব্লো ফর ব্লো।”
ফ্রান্সকে ফুটবলার এবং কোচ হিসাবে বিশ্বকাপ দেওয়া দেশঁ আরও বলেন, ‘‘আগের ম্যাচগুলোয় আমরা যতটা শক্তি নিয়ে খেলেছিলাম, ফাইনালে ততটা ছিল না। যদিও যাদের নিয়ে খেলা শুরু করেছিলাম, তাদের সক্ষমতা নিয়েও আমার কোনও সংশয় ছিল না। পুরো স্কোয়াড কিছু সময়ের জন্য এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। সম্ভবত শারীরিক বা মানসিক প্রভাব ছিল। কিন্তু যারা ম্যাচ শুরু করেছিল তাদের নিয়ে আমার কোনও উদ্বেগ ছিল না: তারা ১০০% ফিট ছিল।’’ উল্লেখ্য, বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফ্রান্সের একাধিক ফুটবলার ‘কোল্ড ভাইরাসে’ অসুস্থ হয়ে পড়েন। কয়েক জনের খেলা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছিল। “শেষ ম্যাচ থেকে আমাদের মাত্র চার দিন ছিল তাই কিছুটা ক্লান্তি ছিল, সম্ভবত। এটা অজুহাত নয়, আমাদের আগের ম্যাচের মতো একই শক্তি ছিল না এবং সেই কারণেই, প্রথম ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় ধরে আমরা ম্যাচে ছিলাম না। অথচ আমরা বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছি। এমন একটা দল সামনে ছিল, যাদের অনেকেই প্রথম বার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলছে। আমাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা তেমন ছিল না।’’
দেশঁ জানান যে তিনি খেলার পরে রেফারি সিজাইমন মার্সিনিয়াকের সাথে কথা বলেছেন। ‘‘আমাকে সতর্ক থাকতে হবে - আপনারাও দেখেছেন যেমন আমি দেখেছি। এটা আরও খারাপ হতে পারত। এই ম্যাচের আগে আর্জেন্টিনা কিছুটা ভাগ্যবান ছিল। কিন্তু আমি তাদের কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিতে চাই না। তাদের সম্পূর্ণরূপে শিরোনাম প্রাপ্য। এটা নয় যে আমরা কোনও সিদ্ধান্তে ভুগেছি। আমি খেলার পরে রেফারির সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি কিন্তু বিস্তারিত বলতে চাই না।’’ ভবিষ্যৎ নিয়ে অবশ্য পরিষ্কার কিছু বললেন না ফরাসি কোচ। এবিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এদিন তিনি জানান, ‘‘যদি আমরা জিততাম, তাহলেও আমি আজ রাতে (এই বিষয়ে) উত্তর দিতাম না। আমি আমার খেলোয়াড় এবং কর্মীদের জন্য খুব দুঃখিত। আমি আগামী বছরের শুরুতে (ফরাসি ফুটবল ফেডারেশনের) সভাপতির সাথে একটি বৈঠক করব এবং তারপরে আপনারা জানতে পারবেন।”
দেশ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠতেই কাতারে চলে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ । কিলিয়ন এমবাপেরা পর পর দু’বার বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। রবিবার লুসাইল স্টেডিয়ামের ভিআইপি বক্সে বসে দেখেছেন দলের হার। তবু দলের খেলায় খুশি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। পরে সাজঘরে গিয়ে এমবাপেদের উদ্দীপ্ত করেন ম্যাক্রঁ। ফুটবলারদের তিনি বলেন, ‘‘বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও আমি তোমাদের অভিনন্দন জানাতে চাই। দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছ তোমরা। খেলোয়াড় সুলভ মানসিকতা নিয়ে লড়াই করেছ তোমরা। আশা করেছিলাম তোমরাই চ্যাম্পিয়ন হবে। তবু তোমাদের কৃতিত্ব কোনও ভাবেই কম নয়।’’ পর পর দু’বার বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ হাতছাড়া হলেও ফ্রান্সের জাতীয় দলকে নিয়ে আশাবাদী প্রেসিডেন্ট।
একসময় ১৯৯৮ সালে প্রথম বার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে পর পর দু’বার বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি ফ্রান্স। তার আগে বিশ্বকাপে ফ্রান্সের সেরা পারফরম্যান্স ছিল ১৯৮৬ এবং ১৯৫৮ সালে তৃতীয় স্থান। ১৯৯৮ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে বদলে গিয়েছে ফ্রান্সের ফুটবল। যে বদলের হাত ধরে ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন এবং ২০০৬ সালে রানার্স হয়েছিল তারা। কী ভাবে বদলে গেল ফ্রান্সের ফুটবল?
এক দিনে নয়। বরং দীর্ঘ পরিকল্পনার ফসল ফ্রান্সের ফুটবলের পরিবর্তন। যে পরিবর্তনের হাত ধরে শেষ ৭টি বিশ্বকাপের ৪টিতেই ফাইনালে উঠল তারা। ফ্রান্সকে বলা হয় আধুনিক ফুটবলার তৈরির কারখানা। প্রতি বছর বিশ্বমানের নতুন ফুটবলার তুলে আনাই লক্ষ্য ফ্রেঞ্চ ফুটবল ফেডারেশনের। সারা বছর ফেডারেশনের প্রতিনিধিরা ঘোরেন দেশের প্রান্তে প্রান্তে। যে কোনও ফুটবল প্রতিযোগিতার কথা শুনলেই তারা চলে যান দেখতে। যদি কোনও প্রতিভার খোঁজ পাওয়া যায়। কাউকে চোখে পড়লে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ফুটবল স্কুলে। ঠিক যে ভাবে প্যারিসের উত্তর শহরতলির একটি উদ্বাস্তু শিবির থেকে খুঁজে আনা হয়েছিল কিলিয়ন এমবাপে, পল পোগবাকে।
শুধু প্রতিভা খুঁজে বের করলেই তো হবে না। তাদের প্রতিপালনের জন্য দরকার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। প্যারিসের উপকণ্ঠে গড়ে তোলা হয়েছে ১৪টি ফুটবল স্কুল। রয়েছে প্রায় ১০০টি ক্লাব। স্কুল শেষ হওয়ার পর ক্লাবের জন্য চিন্তা করতে হয় না। স্কুলগুলি থেকেই পছন্দের ফুটবলারদের বেছে নেয় ক্লাবগুলি। অনেকটা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ের আদলে খেলা শেখার পর রোজগারের জন্য চিন্তা করতে হয় না উঠতি ফুটবলারদের। এমবাপের প্রথম ক্লাব এএস বন্ডি তেমনই একটি ক্লাব। যেখান থেকে তাঁকে নেয় মোনাকো। এই পরিকল্পনার সুবাদে ফ্রান্সের উদ্বাস্তু শিবিরের অভিভাবকরা অনেকেই মনে করেন পড়াশোনার থেকে ফুটবল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই সন্তানদের তাঁরা স্কুলে না পাঠিয়ে খেলার মাঠে পাঠান।
Comments :0