বিলকিসের ধর্ষকদের ‘সংস্কারি ব্রাহ্মণ’ বলা বিধায়ককেই গোধরা থেকে ফের প্রার্থী করেছে বিজেপি। সেই বিধায়ক চন্দ্রসিং রাউলজির কথায় ‘সংস্কারি ব্রাহ্মণ’ ওই এগারো ধর্ষককে ক্ষমতায় এলে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে কংগ্রেস। শনিবার আমেদাবাদে নির্বাচনী ইশ্তেহার প্রকাশ করে কংগ্রেস জানিয়েছে, ভোটে জিতে সরকার গড়লে ওই এগারোজনের মুক্তির ব্যাপারে বর্তমান রাজ্য সরকারের দেওয়া ক্ষমার অনুমোদন ফিরিয়ে নেওয়া হবে।
কংগ্রেসের এই প্রতিশ্রুতির মধ্যেই গুজরাট ভোটে নারোদা কেন্দ্রে বিজেপি’র ঘোষিত প্রার্থীকে নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। গুজরাট গণহত্যায় ৯৭জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে-কুপিয়ে মারায় অন্যতম দোষী সাব্যস্ত মনোজ কুকরানির মেয়ে বছর তিরিশের পায়েল কুকরানিকে এবার নারোদায় প্রার্থী করেছে বিজেপি। পায়েলের নাম ঘোষণার পর থেকেই নারোদায় তাঁর বাড়িতে মিডিয়ার ভিড়, সঙ্গে বিজেপি’র নেতা-কর্মীদেরও আসা-যাওয়া লেগেই রয়েছে। সেই সাক্ষাৎপ্রার্থীদের দেখভাল ও সামলানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন পায়েলের মা রেশমা, আমেদাবাদের সাজপুর বোঘা ওয়ার্ড থেকে জয়ী বিজেপি’র কর্পোরেটার। আর পৌর প্রতিনিধি স্ত্রীকে সেই ‘সামলানোর কাজে’ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহায্য করছেন তাঁর স্বামী মনোজ। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর ‘ব্রেন ক্যানসারের রোগী পুরোপুরি শয্যাশায়ী’ মনোজ হাইকোর্টের রায়ে জামিনে বাড়িতেই রয়েছেন। প্রার্থী হয়ে আপ্লুত মনোজের মেয়ে পায়েল কৃতজ্ঞতা স্বীকারে ভরিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে। পায়েল কৃতজ্ঞ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ও বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি সিআর পাতিলের প্রতিও।
গোধরা হোক বা নারোদা, প্রার্থী বাছাইয়ে বিজেপি এবারও যথেষ্টই সাবধানী পদক্ষেপ নিয়েছে। দলবদলুদের জায়গা করতে গিয়ে অনেক জায়গাতেই দলের বিধায়কদের জায়গা হয়নি প্রার্থী তালিকায়। সঙ্গে খেয়াল রাখা হয়েছে বিভাজনে পটু প্রার্থীদের ব্যাপারেও। তাই হিসাব কষেই গোধরায় ধর্ষকদের হয়ে গলা ফাটানো চন্দ্রসিংয়ের জায়গা হয়েছে। আবার গণহত্যার ক্ষতে বিভাজিত নারোদায় এক দাঙ্গাবাজের মেয়েকেই বেছে নেওয়া হয়েছে প্রার্থী হিসাবে। গোটা দেশ যে নারোদা গণহত্যায় শিউরে উঠেছিল, সে অপারেশনে সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তখনকার বিজেপি’র স্থানীয় বিধায়ক মায়া কোদনানি। পেশায় চিকিৎসক কোদনানির গেম প্ল্যান মতোই সেদিন নারোদা পাটিয়া আর পাশের নারোদা গাম অবরুদ্ধ করে গর্তে ফেলে কুপিয়ে মারা মুসলিমদের পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছিলেন সেদিনের ভয়ানক হিংসায় বেঁচে যাওয়া মানুষজন। এরপরও বিজেপি কোদনানিকেই নারোদায় প্রার্থী করেছিল। কারণ সিন্ধ্রি নিবিড় নারোদায় বরাবরই বিজেপি’র দাপট। আর গণহত্যার পর বিরুদ্ধ স্বর সংখ্যালঘুরা তো গোটা গুজরাটেই ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’। তাই ১৯৯৮-র পর ২০০২ আর ২০০৭— আরও দু’বার সেখান থেকেই জিতেছেন মায়া। এমনকি ‘পুরস্কার স্বরূপ’ তখন মুখ্যমন্ত্রী মোদীর মন্ত্রীও হয়েছেন। আর মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ‘অসুস্থ’ মায়া কোদনানি আবার জেল থেকে ছাড়াও পেয়ে গেছেন।
তাই হিসাব বুঝেই নারোদায় বিজেপি এবার প্রার্থী করেছে মায়া কোদনানির সঙ্গে একই সঙ্গে দাঙ্গা করায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে যাওয়া মনোজ কুকরানির মেয়েকে। বর্তমান বিধায়ক বলরাম থাওয়ানিকে সরিয়ে। কারণ বিজেপি’রই বেশ কিছু কর্মীরই অভিযোগ, সিন্ধ্রি সম্প্রদায়ের বাইরের মেয়েকে বিয়ে করায় বলরাম আর তাদের সম্প্রদায়ের লোক নয়। সিন্ধ্রি ভোট ধরে রাখা, সঙ্গে বিভাজনকে স্পষ্ট রাখতেই তাই একেবারে নারোদাকাণ্ডে জেলে যাওয়া দাঙ্গাবাজের মেয়েকেই প্রার্থী করা হয়েছে।
গত পঁচিশ বছর রাজ্যে ক্ষমতায় না থাকা কংগ্রেস তাই ইশ্তেহারে এখন বিলকিসের ধর্ষকদের জেলে পাঠানোর কথা বলছে। সঙ্গে সরকারি ও আধা সরকারি দপ্তরে দশ লক্ষ চাকরি, ১০লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিখরচায় চিকিৎসা, ৫০০টাকায় রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার এমনকি প্রতি মাসে ৩০০ইউনিট পর্যন্ত নিখরচায় বিদ্যুতের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। এছাড়া পুরানো পেনশন প্রকল্প ফিরিয়ে আনা, বিধবা-বয়স্ক-গরিবদের ভাতা থেকে স্কুল ফি কমানোর মতো প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের মন কাড়ার চেষ্টায় নেমেছে কংগ্রেস। সঙ্গে প্যাটেল তাস খেলতে আমেদাবাদের মোতেরায় নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামের নাম বদলে সর্দার প্যাটেল স্টেডিয়াম করার ঘোষণাও রয়েছে। নবকলেবরে সেজে ওঠা মোতেরা স্টেডিয়ামের নাম বদলে নিজের নামে করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর এদিন গুজরাট ভোটের জন্য নির্বাচনী ইশ্তেহার প্রকাশ করে কংগ্রেসের সিনিয়র অবজার্ভার অশোক গেহলট ঘোষণা করলেন, ‘আমাদের সরকারের মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকেই আমরা স্টেডিয়ামের নাম বদলে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নামে করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি’।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট বিভাজিত সমাজে হিন্দু-মুসলিম ভাগাভাগি ছেড়ে ভোটারদের পেট-রুজির প্রশ্নে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস কতটা ঠেলে দিতে পারে তাই দেখার। কারণ নারোদা গণহত্যায় সাজা পাওয়া অপারেশনে পটু চিকিৎসক মায়া কোদনানি নারদা-বিভাজন উসকেই বারবার বিধায়ক হয়েছেন, এমনকি মন্ত্রীও। এবার সেই কাণ্ডে আরেক দোষী সাব্যস্তের অ্যানাসথেসিস্ট মেয়ে পায়েল ভোটার-মনকে কতটা বেঘোরে পাঠাতে পারে, তার জবাব মিলবে সেই ৮ ডিসেম্বর— ফল ঘোষণায়।
Comments :0