পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন ৮০০ কোটি। এই সংখ্যা ২১৪ বছর আগেও ছিল মাত্র ১০০ কোটি। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭০০ কোটি। অনুমান আগামী ২১ বছরের মধ্যেই এই সংখ্যা হবে ৯০০ কোটি আর তার ১৬/১৭ বছরের মধ্যেই পৌঁছে যেতে পারে ১০০০ কোটিতে।
এদিকে ভূপৃষ্ঠে স্থলভাগ কি বাড়ছে? না বাড়ছে না, বাড়ার তেমন সম্ভাবনাও আছে বলে শোনা যায় না। তাহলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের থাকার জায়গা কোথায় হবে। এদের খাওয়ার যোগান দেওয়ার চাষের জমি কোথায় পাওয়া যাবে? এদের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়ি, বস্ত্র, কাজের সংস্থান করার জন্য পৃথিবী কি প্রস্তুত?
এখন প্রশ্ন হ'লো জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এই পৃথিবীতে মানুষের খাওয়া-পরা বাসস্থান স্বাস্থ্য শিক্ষা কাজের ব্যবস্থা হবে কী ভাবে?
কে পারবে? একদল বলছেন ঈশ্বর যখন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, তখন তিনিই ব্যবস্থা করবেন। কেউ কেউ আবার বলছেন – যে পারবে সে বাঁচবে। অর্থাৎ অর্থের অভাবে যে না খেয়ে বা বিনা চিকিৎসায় মরবে, বা স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে পারবে না, তাদের দায়িত্ব কোনও দেশের সরকার বা রাষ্ট্র নেবে না। তারা অযোগ্য তাই খেতে পাননা, বিনা চিকিৎসায় মরে, অশিক্ষিত থাকে।
তাহলে কি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবে আধুনিক সভ্যতা? সত্যিই কি ঈশ্বর (অনেকেই বিশ্বাসী ঈশ্বরে) চান না সবাই খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সব মানুষ? না কি যারা দরিদ্র তারা কেবলই নিজেদের অযোগ্যতায় দরিদ্র?
রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে পৃথিবীতে না খেতে পাওয়া মানুষের সংখ্যা ছিল ৮১ কোটি ১০ লক্ষ। এছাড়াও আরও ২২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের প্রতিদিন খাবার পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অর্থাৎ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩০% মানুষের প্রতিদিন খাবার জুটবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ৫বছরের নিচে থাকা ৪০ কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। পৃথিবীর ১৫ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ রাস্তায় রাত কাটায়। এটা জনসংখ্যার ২%। অনুমান করা হচ্ছে ২০৫০ সালে ৩০০ কোটি মানুষের কোনও বাসস্থান থাকবে না। ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে বেকারত্বের গড় হার ছিল ৬.৩-৬.৫%। যদিও এর মধ্যে কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হওয়া বা যোগ্যতার তুলনায় কাজ না পাওয়ার হিসাব নেই। একই রকম ভয়াবহ চেহারা স্বাস্থ্য শিক্ষা বস্ত্র চাকরি সব ক্ষেত্রেই। এই প্রশ্নে আফ্রিকা মহাদেশ সহ ভারতের চিত্র সবচেয়ে খারাপ।
এখন বিশ্বের জনসংখ্যার দরিদ্রতম অংশ যারা মোট জনসংখ্যার অর্ধেক, তাদের হাতে আছে পৃথিবীর মোট সম্পদের মাত্র ২%। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী যারা বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ১০%, তারাই পৃথিবীর মোট সম্পদের ৭৬% এর মালিক।
২০১৯ সালে বিশ্বের ধনীতম, যারা বিশ্ব জনসংখ্যার মাত্র ১%, তারা ভোগ করছে বিশ্বের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশেরও বেশি এবং নিচের দরিদ্রতম অংশ যারা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, তারা ভোগ করেছে মাত্র ১৩%।
শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিসংখ্যান কী বলছে? ২০২১ সালের জুন মাসের তুলনায় ২০২২ সালে সেখানে প্রকৃত মজুরি কমছে ৩.৫%। সাধারণ মজুরি বেড়েছে হয়তো, কিন্তু প্রবল মুদ্রাস্ফীতির জন্য প্রকৃত আয় কমেছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, প্রকৃত মজুরি যেসব দেশে সবচেয়ে কমেছে বিগত এক দশকে, তার মধ্যে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ অন্যতম। মজুরিতেও লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট। মোট মজুরির ৩৫ শতাংশেরও কম (শ্রমিক আয়) মহিলাদের অংশ ।
একজন জার্মান মানুষের লেখা একটা বই ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত হলো - দি জার্মান আইডিওলজি। এই বইয়ে একটা সংক্ষিপ্ত নোট ছিল। নাম – থিসিস অন ফয়েরবাখ। ফয়েরবাখের লেখা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি এখানে এমন একটা বাক্য লিখেছিলেন, যা মানব সভ্যতার গতিমুখ অনেকটাই পালটে দিয়েছে—
‘‘দার্শনিকরা নানাভাবে এই জগৎটাকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথা হলো একে পরিবর্তন করা।’’ এই পরিবর্তন মানে নিছক, এক দল শাসকের পরিবর্তে আর এক দল শাসকদের রাষ্ট্র ক্ষমতা বা সরকারে আসা নয়। একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে আর একটা সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা তৈরি করা, যা চালাবে এতদিন ধরে যে শ্রমিক কৃষক নিপীড়িত হয়েছে, তারাই। অতীতের অন্যান্য বিপ্লবের মতো একই সামাজিক অর্থনৈতিক শোষণমূলক ব্যবস্থা বজায় রেখে অন্য আর একজন বা অন্য গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় আনার পরিবর্তন নয়। এই পরিবর্তন মানে, প্রচলিত শোষণমূলক অসাম্য বৃদ্ধির ব্যবস্থার উচ্ছেদ ঘটিয়ে এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি করা - যা পরিচালিত হবে শোষণ ও অসাম্যের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে। এই নতুন সমাজতন্ত্রের কথাই অসংখ্য রচনার মাধ্যমে মার্কস ও তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু ও কমরেড এঙ্গেলস যুক্তি সহকারে পৃথিবীর সামনে উপস্থিত করেছিলেন।
এই পরিবর্তনের প্রথম প্রচেষ্টা হয়েছিল ফ্রান্সের প্যারিস শহরে ১৮৭১ সালে। যদিও শ্রমিকদের এই সরকারের মেয়াদ ছিল মাত্র ৭১ দিন। ২০হাজার বিপ্লবী শ্রমিককে হত্যা করে, রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্যারিস শহর।
এর পর ১৯১৭ সাল। তৎকালীন রাশিয়া বা সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে। সমগ্র বিশ্বকে চমকে দিয়ে সেই সময়ে ইউরোপের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ, বিশ্বের সবচাইতে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশে রূপান্তরিত হয়েছিল।
বিপ্লবের পূর্বে রাশিয়াকে বলা হতো ইউরোপের পিছনের উঠোন, অর্থাৎ সবচাইতে পশ্চাদগামী দেশ। সেই সময় সেদেশের ৮০ শতাংশ মানুষই ছিল নিরক্ষর। ১৯১৭ সালে সেদেশের ৯১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১লক্ষ ১২ হাজার। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৪১ সালে অর্থাৎ মাত্র আড়াই দশকের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮০০, যেখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিল ৬ লক্ষ ৬৭ হাজার।
১৯৩০ সালে অর্থাৎ বিপ্লবের মাত্র ১৩ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া ভ্রমণ করে তাঁর অভিজ্ঞতা সঞ্জাত ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছিলেন - “আপাতত রাশিয়ায় এসেছি— না এলে এজন্মের তীর্থ দর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত।’’ তিনি আরও লিখেছিলেন - “দেখতে পাচ্ছি, বহুদূরব্যাপী একটা ক্ষেত্র নিয়ে এরা একটা নূতন জগৎ গড়ে তুলতে কোমর বেঁধে লেগে আছে। দেরি সইছে না ; কেননা জগৎ জুড়ে এদের প্রতিকূলতা, সবাই এদের বিরোধী - যত শীঘ্র পারে এদের খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে— হাতে হাতে প্রমাণ করে দিতে হবে, এরা যেটা চাচ্ছে সেটা ভুল নয়, ফাঁকি নয়। হাজার বছরের বিরুদ্ধে দশ-পনেরো বছর জিতবে বলে পণ করেছে।’’
সে দেশের জনশিক্ষা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন - “আমি নিজের চোখে না দেখলে কোনও মতেই বিশ্বাস করতে পারতুম না যে, অশিক্ষা ও অবমাননার নিম্নতম তল থেকে আজ কেবলমাত্র দশ বৎসরের মধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষকে এরা শুধু ক খ গ ঘ শেখায়নি, মনুষ্যত্বে সম্মানিত করেছে। শুধু নিজের জাতকে নয়, অন্য জাতের জন্য এদের সমান চেষ্টা।’’
সেই সময়ের পৃথিবীতে প্রথম দীর্ঘস্থায়ী সমাজতন্ত্র দেখিয়েছিল, পুঁজিবাদের বিকল্প ব্যবস্থা সম্ভব এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুঁজিবাদের চাইতে অনেক উন্নততর সভ্যতা তৈরি করতে সক্ষম। পরবর্তীতে পূর্ব ইউরোপের অনেকগুলো দেশের সমাজতন্ত্র, অতীতের পুঁজিবাদের চাইতে অনেক উন্নত অর্থনীতি গঠন করেছিল। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবার সমাজতন্ত্র সেই দেশগুলোর অর্থনীতিকে কতটা উন্নত করেছে, তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ আজও বিদ্যমান।
কিন্তু এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ১) তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ পূর্ব ইউরোপের এতগুলো দেশে সমাজতন্ত্রের এই ভয়ানক বিপর্যয় ঘটল কেন, ২) আজকের পৃথিবীতে সেই একই ধাঁচার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বর্তমান সময়ের এই গভীর সঙ্কটের মোকাবিলা করতে কি আদৌ পারবে, ৩) পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ফিরে আসায় কি একথা প্রমাণ হয় না, যে এটাই একমাত্র স্থায়ী অর্থনৈতিক মডেল।
শেষ থেকে শুরু করা যাক।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বারেবারে সঙ্কট আসে কেন? আর এই সঙ্কটে পুঁজিপতিরা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় কেন সাধারণ দরিদ্র মানুষই?
এর উত্তর পেতে গেলেও সেই মার্কসেরই শরণাপন্ন হতে হবে। পুঁজির চরিত্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ক্যাপিটাল গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের ৩১নং অধ্যায়ের পরিশেষে একটি ফুটনোটে উল্লেখ করেছিলেন অর্থনীতিবিদ টি.জে. ডানিংয়ের একটি বক্তব্য।
‘‘যথেষ্ট মুনাফা পেলে পুঁজি খুবই সাহসী হয়। ১০% মুনাফা নিশ্চিত জানলে সে যে কোনও জায়গায় ব্যবসা করতে পারে। ২০% মুনাফায় তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। ৫০% মুনাফা তৈরি করে পুঁজির ঔদ্ধত্য। ১০০% মুনাফা মানবিকতার সব নীতিগুলিকে পদদলিত করবার সাহস জোগায়। ৩০০ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত জানলে, যে কোনও অপরাধ করতে প্রস্তুত থাকে পুঁজি, এমনকি নিজের মালিককে ফাঁসিকাঠে পর্যন্ত ঝোলাতে পারে।’’
পুঁজিবাদ ব্যক্তি মুনাফার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়। সমাজের বা মানব সভ্যতার অগ্রগতি ঘটানো তার লক্ষ্য নয়, এটা দিনের আলোর মতোই আজ স্পষ্ট। সম্পদের ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীভবনই যে অসাম্য ও দারিদ্র বাড়ার মূল কারণ, সেটা ঘোর পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাও স্বীকার করেন।
তাহলে অসাম্য বা দারিদ্র দূরীকরণে, সমাজের কল্যাণে, মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে কি বিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের যে মডেল সাফল্য দেখিয়েছিল, সেই একই মডেল কাজ করবে? তা কখনই নয়। বিগত এক শতাব্দীতে সমাজ, অর্থনীতি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, চাহিদা, প্রযুক্তি সবই পালটে গেছে অনেক। তার সাথে সাযুজ্য বজায় রেখেই সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ করতে হবে। গণতন্ত্রের ধারণা অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছে বিগত এক শতাব্দীতে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের পতনের পর অনেকেই বলেন, মার্কসের মতবাদ ও সমাজতন্ত্র অচল, সেটা এই বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। এই ধরনের মন্তব্যর পরিপ্রেক্ষিতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়ক বলেছিলেন - তাজমহল ভেঙে গেলে কি পৃথিবীর থেকে ভালোবাসা শেষ হয়ে যাবে? এটা হয় না। প্রয়োগের ব্যর্থতায় তত্ত্ব বাতিল হয় না বিজ্ঞানে। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা তো তাদের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে, এমনকি কোভিড ১৯ সংক্রমণের সময়েও। এখন ব্যাপক ছাঁটাই চলছে আমেরিকা ইউরোপের অনেক তথাকথিত উন্নত অর্থনীতির পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। কিন্তু এমন ঘটনা তো এই দেশগুলোর ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে না। মজুরিও কমাচ্ছে পুঁজিবাদী দেশগুলো ব্যক্তি মালিকদের মুনাফা আরও বাড়াবার জন্য। কিন্তু তাও তো তেমনভাবে ঘটছে না চীন, ভিয়েতনাম, কিউবায়।
আজকের বিশ্বজোড়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও অসাম্য, দারিদ্র দূরীকরণ, সকলের জন্য সমান শিক্ষা চিকিৎসার সুযোগ তৈরি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে পথ দেখাচ্ছে তো এই গুটিকয়েক সমাজতান্ত্রিক দেশই। লাতিন আমেরিকার অনেকগুলো দেশ আবার তেল, খনি, ভূমি সংস্কারের মতো সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে, বিশ্ব লগ্নি পুঁজির উদারীকরণের রাস্তা ছেড়ে।
বাজার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও থাকে। বাজার না থাকলে কোনও দ্রব্যের কত চাহিদা, কত জোগানের প্রয়োজন, তা মাপা যাবে কি ভাবে? পণ্যের মূল্যই বা নির্ধারণ করা যাবে কি ভাবে? (যদিও পণ্যের মুল্য নির্ধারণে শ্রমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অঙ্ক কষে দেখিয়েছেন মার্কস।) আধুনিক অর্থনীতিতে বাজারই এইসব মাপকাঠি নির্ধারণে মূল ভূমিকা পালন করে। এখন প্রশ্ন হলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে কে - নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কয়েকটা মাত্র ধনী পুঁজিপতি? না কি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার ভিত্তিতে সমাজের প্রয়োজনে বাজার পরিচালিত হবে? সমাজতন্ত্রে বাজার পরিচালিত হয় মূলত সমাজের চাহিদা পূরণের জন্য, কেবলমাত্র কয়েকজন শিল্পপতির মুনাফার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে নয়। চীন, কিউবা, ভিয়েতনাম এই নীতির ভিত্তিতেই বাজার সাজাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশ্ব লগ্নি পুঁজিকে ঢুকতে না দিয়ে বা বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, অন্যান্য পুঁজিবাদী দেশগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাঁচা তো সম্ভব নয়। তাই তাদের লাগবে, কিন্তু সাথে সতর্কও থাকতে হয় প্রতিপদেই, কে কাকে কতটা ব্যবহার করতে পারবে। কতটা ছাড়বে জমি, কোথায় ছাড়বে জায়গা এটার কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা হয় না। চলতে চলতে নিজেদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতির বিচারেই নির্ধারণ করতে হয়, কোনও সমঝোতায় কতটা লাভ, কতটা ক্ষতি দেশের সাধারণ মানুষের। এই লড়াই নিরন্তর চালিয়ে যেতে হয়।
আজকের ৩/৪ টে মাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশকে ঘিরে রেখেছে বিশ্ব লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত দেশগুলো। আজকের লগ্নি পুঁজির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এরা রাতারাতি পুঁজির স্থানান্তর ঘটিয়ে যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তছনছ করে দিতে পারে এক রাতেই। তাই চাইলেও ইচ্ছেমতো নিজস্ব নিয়মের নিগড়ে এদের বেঁধে রাখা খুবই দুঃসাধ্য। বাঁধতে গেলেই এরা পুঁজিপাটা নিয়ে পাততাড়ি গোটায়, বিপদে পড়ে অর্থনীতি। তাই দর কষাকষির কাজটা শুধু দক্ষতা দিয়ে হয় না, তার জন্য দরকার সমাজতন্ত্রিক অর্থনীতির মজবুতি আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লাগাতার লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশের মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি। দ্বিতীয় কাজটা না করা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম কারণ। যেদিন ১৯৬০ এর দশকে ক্রুশ্চেভ সাম্রাজ্যবাদকে কোটের বোতামের সাথে তুলনা করে এর বিরুদ্ধে জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার কাজকে অবহেলা করা শুরু করেছিলেন, সেদিনই হয়েছিল শেষের শুরু।
পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত
আজকের পৃথিবীতে এটা আলোচ্য বিষয় নয়, যে সমাজতন্ত্রের মৃত্যু হয়েছে কি হয়নি, বরং পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎই এখন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে, এমনকি পুঁজিবাদের প্রবল সমর্থক চিন্তাবিদদের কাছেও।
পুঁজিবাদের প্রবল সমর্থক প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং দার্শনিক ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা, যিনি একদা সমাজতন্ত্রের মৃত্যু নিশ্চিত বলে ঘোষণা করেছিলেন, তিনিই সাম্প্রতিককালে (১৭ অক্টোবর, ২০১৮) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “সামাজিক সাম্যের প্রশ্নে বর্তমান বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থা শ্রমিক সংগঠনগুলিকে ভীষণভাবে দুর্বল করেছে, যার ফলে তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা কমেছে এবং এক শ্রেণির ধনিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, যারা সর্বত্র রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কার্যত নিয়ন্ত্রণ করছে।”
এখন প্রশ্ন এই মুষ্টিমেয় ধনিক গোষ্ঠীর হাতে পৃথিবীকে ছেড়ে দেওয়া হবে, না কি এদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার লড়াই চলবে? বিকল্প আছে পুঁজিবাদের - আর সেই বিকল্প হলো একুশ শতকের সমাজবাদ। যতদিন শোষণ বঞ্চনা অসাম্য থাকবে ততদিন মুক্তির লড়াই চলবেই। আর এই লড়াইয়ে আজও প্রেরণা ১০৫ আগে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর মাসের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লব।
Comments :0