Kalighater kaku

এমএ পাশ চাকরিপ্রার্থীই তৃণমূলী চক্রব্যুহে শেষে হয়ে গেল ‘কালীঘাটের কাকু’র ‘ডেলিভারি বয়’!

রাজ্য

সাধারণ পরিবারের সন্তান। সরকারি স্কুলে শিক্ষকতার স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে পা রেখেছিল। শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তৃণমূলের চক্রব্যুহে ঢুকে সেই যুবক নিজের পরিবার, প্রাণ বাঁচাতে শেষমেশ টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির এজেন্টে পরিণত হতে বাধ্য হলো।
এই দুর্নীতির শিকড় কীভাবে একটা প্রজন্মকে শেষ করেছে, বাধ্য করেছে দুর্নীতির পাঁকে ডুবতে, তারই এক মর্মান্তিক ছবি সামনে এসেছে নিয়োগ দুর্নীতিতে চাকরি বিক্রির এজেন্টদের জেরায়। 
কোটি কোটি টাকায় চাকরি বিক্রি হয়েছে। জেলায় জেলায় এজেন্ট চক্র গড়ে এই দুর্নীতির কারবারকে প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার যোগ্য মেধাবী চাকরিপ্রার্থীর স্বপ্নকে খুন করা হয়েছে। এরাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির চেহারা কেবল এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়।
এরাজ্যে শাসক তৃণমূলের সৌজন্য এই নিয়োগ দুর্নীতির পরিণাম একটা গোটা প্রজন্মকে কোন বাঁকে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে, তার নিদারুণ দলিল হয়ে উঠতে পারে সিবিআই’র কাছে পশ্চিম মেদিনীপুরের এক এজেন্টের বয়ান। টাকার বিনিময়ে খালি ওএমআর শিট জমা দিতে লিখিত পরীক্ষায় বেমালুম পাশ করেছিলেন সেই যুবক। তারপর কী পরিণতি?
সিবিআই’র জেরায় এই যুবকের বয়ান এরাজ্যের নিয়োগ দুর্নীতির এই মর্মান্তিক পরিণতির সাক্ষ্য হয়ে উঠতে পারে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এই যুবকের সঙ্গে ২০১৫ সালে তৎকালীন তৃণমূল নেতা অরুণ হাজার ওরফে চিনু হাজরার যোগাযোগ হয়। বর্তমানে বিজেপি নেতা এই চিনু হাজরা চাকরি বিক্রির চক্রের অন্যতম মাথা। নিয়োগ দুর্নীতিতে একাই ৭৮ কোটি টাকা তুলেছিল। তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটে তাকে অভিযুক্ত হিসাবে দেখিয়েছে সিবিআই। চিনু হাজরা ২০২৪’র লোকসভা ভোটে বিজেপি-তে যোগ দেয়। এক বন্ধু বকুল বিশ্বাস তাকে সে সময় উচ্চ প্রাথমিকে চাকরি পাইয়ে দেবে বলে চিনু হাজরার ডেরায় নিয়ে যায় ওই যুবককে। বলা হয় আট লাখ দিলেই মিলবে উচ্চ প্রাথমিকে চাকরি, চিনু হাজরা সব ব্যবস্থা করে দেবে। প্রথমে চার লাখ, পরে বাকি টাকা। সে একা নয়, আরও তিন-চারজন বন্ধুকে জোগাড় করে বকুল বিশ্বাস তাঁদের নিয়ে যায় চিনু হাজরার কলেজ স্কোয়ারের বাড়িতে। চিনু হাজরা জানায়, অজিত পাঁজা, গনি খান চৌধুরির মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগের সুবাদে তিনি রেল, পৌরসভা সহ বিভিন্ন সরকারি চাকরি পাইয়ে দিতে পারেন। বর্তমান রাজ্য সরকারের কোনও চাকরিই টাকা ছাড়া পাওয়া যায় না। আরও বলেন, ‘বস’র মাধ্যমে সে করে দেবে বলে রেট কম, অন্য কেউ করে দিলে আরও টাকা বেশি নেব। এই বস হলো ‘কালীঘাটের কাকু’, সেটাও জানায় চিনু হাজরা।
সিবিআই’র কাছে জেরায় পশ্চিম মেদিনীপুরের সেই যুবক বলেন, ‘‘এত টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। তখন চিনু হাজরার তরফে প্রস্তাব দেয় যে সে আগে লিখিত পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবে। তারপরে ঘুষের টাকা দিতে হবে। সেই প্রস্তাবে রাজি হই। অ্যাডমিট কার্ড সহ সব ডকুমেন্ট দিই। আমাদের বলা হয় খালি খাতা জমা দিতে। সেটাই নাকি সংকেত! লিখিত পরীক্ষায় খালি খাতা জমা দিই। সাদা খাতা দিয়েও একজন বাদে প্রত্যেকে পরীক্ষায় পাশ করেন।’’ এরপরেই তৎকালীন তৃণমূল নেতা চিনু হাজরার ক্ষমতা আছে, এই বিশ্বাস জন্মায় তাদের মধ্যে। ইন্টারভিউয়ের আগে কোনোমতে প্রায় ৫ লক্ষ টাকা জোগাড় করে তাকে দেয় মেদিনীপুরের ওই যুবক। কিন্তু চিনু হাজরা হুমকি দেয় বাকি টাকা যদি ইন্টারভিউয়ের আগে না দেওয়া হয়, তবে তার নাম বাদ দিয়ে অন্য কারও নাম তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। 
এরপর থেকেই ঘটনা বাঁক নিতে শুরু করে।
টাকা দেওয়ার আর ক্ষমতা নেই জানানোর পরে সেই চিনু হাজরা প্রস্তাব দেয়, ‘‘এক কাজ কর, তুই আরও কিছু চাকরিপ্রার্থী জোগাড় কর, প্রাইমারি বা এসএসসি’র, সরকারে অন্য দপ্তরের চাকরি প্রার্থী হলেও হবে। তাদের কাছ থেকে টাকা তোল, সেখান থেকে যে কমিশন দেবো, তাতে তোর নিজের টাকা শোধ হয়ে যাবে।’’  তা করতে বাধ্য হয় ওই যুবক। ইতোমধ্যে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। কিন্তু বারেবারে কলেজ স্কোয়ারে চিনু হাজরার কাছে হত্যে দিলেও দেখা যায় ঐ যুবকের চাকরি আর হয়নি, যদিও তার বন্ধু সেই বকুল বিশ্বাসের চাকরি হয়ে যায়। হতাশ হয়ে সে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যায়। এরপর কিছুদিন পরেই সেই তৎকালীন তৃণমূল নেতা চিনু হাজরা তাকে ফোন করে বলে, ‘‘কলকাতায় চলে আয়, বকুল চাকরি পেয়ে গেছে, আমার একটা লোক লাগবে এই সব চাকরিপ্রার্থীদের টাকার হিসাব, ক্যান্ডিডেটদের লিস্ট তৈরির জন্য। ৪০ হাজার টাকা মাসে দেবো, আরও বাকি সুবিধা।’’ এমনকি এক মন্ত্রীকে বলে সাপুরজি’র আবাসনে এক ফ্ল্যাটও দেওয়া হবে বলে চিনু হাজরা। 
এমএ পাশ করে স্কুলে শিক্ষাকতার স্বপ্ন দেখা সেই যুবক এরপর হয়ে উঠলো চিনু হাজরার চাকরি বিক্রি চক্রের এজেন্ট। ক্যান্ডিডেট ধরে আনতে পারলে অতিরিক্ত  কমিশন। চিনু হাজরার নির্দেশেই এরপর বেহালায় কালীঘাটের কাকুর বাড়িতে, নিউ আলিপুরে লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র অফিসে চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে তোলা কোটি কোটি টাকা দিয়ে আসতে হতো তাকে।
কালীঘাটের কাকুর হয়ে জনৈক নিখিল মাইতির কাছেও টাকা দিতে হতো। কবে কত টাকা দিয়ে আসতে হতো সেই হিসাব ডায়েরিতে লিখে রাখতো সেই যুবক, যা এখন সিবিআই’র হাতে। ততদিনে চিনু হাজরা এসএসসি’র গ্রুপ-ডি’র জন্য ২০০ জন, গ্রুপ-সি’র চাকরির জন্য ৫০ জন, নবম-দশমের জন্য ২১ জন, একাদশ-দ্বাদশের জন্য ১২ জন, প্রাইমারিতে ১৮০ জন, শারীর শিক্ষা ও কর্মশিক্ষার জন্য ২০০ জনের কাছ থেকে টাকা তুলেছে। ৭৮ কোটি টাকার বেশি। সুজয় ভদ্র আবার সেই টাকার একটা অংশ চিনু হাজরার ছেলের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতো বলেও সিবিআই-কে জানিয়েছে। এমনকি, একদিন কয়েক কোটি টাকা কালীঘাটের কাকুকে দেওয়ার সময় সে ভিডিও করেছিল। তা বুঝতে পেরে কালীঘাটের কাকু সেই মোবাইল কেড়ে নিয়ে ভেঙে ড্রেনে ফেলে দেয়, প্রাণনাশের হুমকি দেয়।
সেই শেখ সালাম নামে ওই যুবক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মাস্টার্স ডিগ্রি করার পর তৃণমূলের চক্রে পড়ে টাকা দিয়েও চাকরি না পাওয়ার পরে শেষমেশ ফাঁদে পড়ে চাকরি বিক্রির এজেন্টে পরিণত হলো শাসক তৃণমূলের নেতাদের চাপেই।
জেরায় শেখ সালামের মতো এজেন্টদের বয়ান সমাজের ক্ষতকেই বেআব্রু করেছে। তৃতীয় অতিরিক্তি চার্জশিটে চাকরিপ্রার্থী তথা এজেন্টদের জেরায় স্বীকার করা এমন বয়ান যুক্ত করেছে সিবিআই।

Comments :0

Login to leave a comment