Post Editorial

অর্ধশতবর্ষে স্মরণ বল্লভপুরের মাটি ভিজে‍ গিয়েছিল একদিনে তিন শহীদের রক্তে

সম্পাদকীয় বিভাগ

অনুপ মিত্র

১৯৭৩ সালের ২৬ নভেম্বর একইদিনে রানিগঞ্জের বল্লভপুরে তিনজন শ্রমিককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল তৎকালীন কংগ্রেসের আততায়ী ও দুষ্কৃতীবাহিনী।  রক্তে ভিজে গিয়েছিল বল্লভপুর পেপারমিলের মাটি। সেদিন এই ঘাতকদের হাতে খুন হয়ে গিয়েছিলেন কমরেড মনসুর আলি, কমরেড নিখিল বোস এবং কমরেড রবীন সেন (ছোট)। এঁরা সবাই সিআইটিইউ পরিচালিত বেঙ্গল পেপারমিল মজদুর ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। আচমকা এই ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন কর্মরত শ্রমিকরা এবং বল্লভপুরের আপামর মানুষ। কারখানার ভিতরে কর্মরত অবস্থায় এই ধরনের নৃশংস হামলার ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। তিনজন শ্রমিককে হত্যার পরবর্তী দিনগুলিতেও গোটা বল্লভপুরে পুলিশ এবং কংগ্রেসের বাহিনী যৌথভাবে সাধারণ মানুষের ওপর  বর্বর অত্যাচার চালায়। এবারের ২৬ নভেম্বর এই ঘটনার পঞ্চাশ বছর।
ঘটনার দিন নৃশংসতা
আর পাঁচটা দিনের মতো সেদিনও পেপারমিলের শ্রমিকরা কারখানায় যে-যাঁর বিভাগে নি‍‌জেদের কাজ করছিলেন। বেলা আনুমানিক তিনটে থেকে তিনটে পনের মিনিট নাগাদ সশস্ত্র কংগ্রসের দুষ্কৃতীবাহিনী পেপারমিলের মূল বড় গেট দিয়ে অনায়াসেই কারখানার ভিতরে ঢুকে যায়। নিরাপত্তারক্ষীরা কারখানার গেট খুলে দেয়। চলে এলোপাতাড়ি আক্রমণ। কমরেড ‍‌ রবীন সেন (ছোট) মেকানিক্যাল বিভাগের কর্মী, তাঁর কাজের জায়গায় অবস্থিত একটি কলে জল খাচ্ছিলের। সেখানেই তাঁকে কোপানো হয়। বিটার হাউসে কর্মরত শ্রমিক কমরেড মনসুর আলিকে কংগ্রেসের দুষ্কৃতীরা তাড়া করে জোনাল অফিসের সামনে নিয়ে এনে পরপর ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকে। একইসাথে রাবনেশ্বর গড়াই সহ একাধিক শ্রমিককে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। তাঁরা সবাই গুরুতর আহত হন। কমরেড রবীন সেন (ছোট) এবং কমরেড মনসুর আলি শহীদের মৃত্যুবরণ করেন।
আরেকজন শ্রমিক, যিনি ইউনিয়নের কর্মকর্তাও ছিলেন, তিনি কমরেড নিখিল বোস। পেপারমিলে অফিস কর্মচারী ছিলেন। তিনি যখন কারখানা থেকে সন্ত্রস্ত অবস্থায় সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন একটি ট্যাক্সি করে কয়েকজন কংগ্রেসী আততায়ী রাস্তার ওপর তাঁকে ফেলে ছুরিকাঘাত করতে থাকে। মৃত্যু হয়েছে ভেবে তাঁকে ফেলে রেখে যায়। ২৯ নভেম্বর হাসপাতালে কমরেড নিখিল বোসের মৃত্যু হয়। একইদিনে শহীদ হয়ে যান বল্লভপুর বেঙ্গল পেপারমিলের তিনজন শ্রমিক। যাঁরা কখনও ভাবতে পারেননি কারখানার কাজ করতে করতে তাঁদের খুন করা হতে পারেন।
আক্রমণ আরও বাড়তে থাকে
দুর্বৃত্ত আর পুলিশবাহিনীর আক্রমণ এখানেই থেমে থাকলো না। ঘটনার আকস্মিকতায় শ্রমিকরা প্রথমে হতচকিত হয়ে গে‍‌লেও, তাঁরা কারখানা থেক বাইরে বেরিয়ে তাঁদের নিরাপত্তার দাবি করতে থাকেন। খুনিদের নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হয়, কিন্তু পুলিশ কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। অন্যদিকে ঐদিনই একটি অরাজনৈতিক খুনের ঘটনায় যার সাথে শ্রমিকদের কোনও সম্পর্কই ছিল না, সেই মিথ্যা মামলায় পুলিশ কাগজ কারখানার পনেরো জন শ্রমিককে গ্রেপ্তার করে। অপরদিকে ষোলো জন আরও শ্রমিকদের কুখ্যাত মিসা আইনে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। নিখিল বোসের হত্যার প্রত্যক্ষদর্শীদের কয়েকজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীদের ‍‌পুলিশ ভয় দেখাতে থাকে সেই সময় রানিগঞ্জের একজন কুখ্যাত পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে কংগ্রেসী দুষ্কৃতীবাহিনীর যৌথ আক্রমণ শুরু হয় বল্লভপুরের শ্রমিক ধাওড়া বস্তি অঞ্চল এবং বিভিন্ন এলাকায় প্রথমেই তারা আক্রমণ করে রঘুনাথচক এলাকায়। ‍‌ পেপারমিলের বিটার হাউসের কর্মী গোরাখ দুসাদ এবং মপসি দুসাদকে রাইফেলের বাট দিয়ে অমানুষিকভাবে মারধর করে। ‍বিটার হাউসের রামপিয়ারী দুসাদকে বাড়িতে না পেয়ে তাঁর স্ত্রীর ওপর আক্রমণ চালায়। পালপাড়াতে একই রাতে বাড়ি বাড়ি ঢুকে আক্রমণ চালাতে থাকে। লালু বাউরি, ধীরেন বাউরি, ফল্গু বাউরি, সাধন মণ্ডলকে তারা গুলি করে। নারাণ গোরের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। মহিলাদের ওপরই ব্যাপক আক্রমণ হয়। পুলিশ ও গুন্ডারা নূপুর কলোনির বাড়ি বাড়ি ঢুকে হামলা চালায়। গোবিন্দ দে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ তাঁকেই গ্রেপ্তার করে। গোটা রাত বল্লভপুরে শুধুমাত্র বোমা-গুলির আওয়াজ আসতে থাকে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বহু ঘরবাড়ি। পরেরদিন নূপুর কলোনিতে আবার আক্রমণ হয়। পুলিশ ও কংগ্রেসী সমাজবিরোধীরা ভট্টাচার্যপাড়ার নারায়ণ ভট্টাচার্যকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর গর্ভবতী স্ত্রীকে পুলিশ ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। ষাট বছরের বৃদ্ধা চপলাবালা মণ্ডলকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। প্রবীর ভাণ্ডারির ওপর আক্রমণ চালায়। তাঁর মাথায় আঘাত করা হয়। ‍ পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা ত্রিভঙ্গবালা ভাণ্ডারির গলা টিপে আঘাত করা হয়। পুলিশ ঐদিনই আঠারো জনকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে। এইভাবে একের  পর এক আক্রমণ ও পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে থাকে। লক্ষ্য ছিল একটাই— বল্লভপুরের বেঙ্গল পেপারমিলের সিআইটিইউ ইউনিয়নকে শেষ করে দেওয়া। সত্তরের ভয়াবহ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বল্লভপুরের মানুষের ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলনকে ধ্বংস করা। এই নারকীয় হত্যার ঘটনার আটমাস আগে ১৯৭৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল পেপারমিলের বদলি শ্রমিক, সিআইটিইউ ইউনিয়ন ও সিপিআই (এম)’র সক্রিয় কর্মী গণশক্তি পত্রিকার এজেন্ট কমরেড কৈলেশ্বর হাজমকে হত্যা করা হয়েছিল।
সিপিআই (এম) সংসদীয় দলের পর্যবেক্ষণ
একইদিনে তিনজন কারখানার শ্রমিককে খুন করার ঘটনায় তোলপাড় পড়ে যায় সমগ্র বর্ধমান জেলায়। তীব্র সন্ত্রাসের মুখে দাঁড়িয়েও বল্লভপুরের মানুষজন লাল ঝান্ডার নেতৃত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই প্রতিরোধে বল্লভপুরের প্রান্তিক গরিব মহিলাদের অবদান ভোলার নয়। এই নারকীয় হত্যার ঘটনার পর সন্ত্রস্ত বল্লভপুরে আসেন সি‍‌পিআই (এম)’র পাঁচজনের এক সংসদীয় প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে ছিলেন দীনেন ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন রায়, রবীন সেন,  মহম্মদ ইসমাইল এবং কৃষ্ণচন্দ্র হালদার। এই প্রতিনিধিদল সন্ত্রাস-কবলিত বল্লভপুরের বিভিন্ন বস্তি, শ্রমিক ধাওড়া, পাড়া-মহল্লায় পুলিশ ও কংগ্রেসীবাহিনীর হাতে আক্রমণের এবং শহীদ কমরেডদের পরিবারের সাথে দেখা করেন। তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন। আক্রান্ত শ্রমিকরা এবং তাঁদের পরিবারবর্গ নারকীয় ঘটনার যে বিবরণ সংসদীয় দলের কাছে দেন— তার কিছু অংশ উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে হয়। ‘‘আক্রান্তরা বর্ণনা করেন, ২৬ নভেম্বর নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর রানিগঞ্জ থানার এক  পুলিশ অফিসারের নেতৃত্বে ঘাতকবাহিনীর তাণ্ডবে বহু মানুষ তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। এমনকি মহিলা ও শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। সংসদীয় দল যখন বল্লভপুরে যান, তখনও পুলিশের আক্রমণে আহত গোরখ দুসাদ এবং মপসি প্রসাদ হাসপাতালে। এমনকি তাঁরা বসতেও পারছিলেন না। মহিলারা একযোগে অভিযোগ জানান, পুলিশ প্রতিদিন তাঁদের বাড়িতে এসে  তাঁ‍‌দেরকে হুমকি দিচ্ছে। রঘুনাথচক বস্তির বহু মানুষ এবং মহিলা এও অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁদের হুমকি দিচ্ছে— কেন তাঁরা সিআইটিইউ করে। সংসদীয় দল যখন বল্লভপুর পালপাড়ায় পরিদর্শন করেন, তখন প্রায় চার শতাধিক মহিলা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এবং তাঁরাও একই অভিযোগ করতে থাকেন। তাঁরা একথাও বলেন, তাঁদের কোনও খাবার এবং কোনও নিরাপত্তা নেই। রাত্রিতে তাঁরা নিরাপত্তার অভাবে বাড়িতে থাকতে পারেন না। একইভাবে সংসদীয় দল যখন বেলুনিয়া গ্রামে যান, তখন প্রায় তিন শতাধিক মহিলা পুলিশি অত্যাচারের বহুবিধ ঘটনা তাঁদের জানান। জনৈক মহিলা তাঁর উপর পুলিশি অত্যাচারের বিবরণ দেন। সিআইটিইউ সদস্য তারক দাসের পঞ্চাশ বছরের মা’কে কংগ্রেসী গুন্ডারা শাসাতে থাকে। তারক দাস কোথায় আছে, তা তাদের বলে দেবার জন্য। যদি তা না হয়, তাহলে তাঁর ছেলেকে এমনকি তাঁকে ও খুন করা হবে বলে ভয় দেখায়।’’ উপরোক্ত অভি‍‌যোগগুলি থেকেই বোঝা যায়, কি ধরনের ভয়ঙ্কর অত্যাচার সেদিন বল্লভপুরের বুকে নামিয়ে আনা হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের পঞ্চাশ বছর
১৯৭৩ সালের ২৬ নভেম্বর বল্লভপুরের মাটি ভিজে গিয়েছিল তিনজন শহীদের রক্তে। এই নারকীয় ঘটনার আজ পঞ্চাশ বছর। শহীদ মনসুর আলি, শহীদ নিখিল বোস, শহীদ রবীন সেন (ছোট)-এর আত্মবলিদান বৃথা যায়নি। তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালে দু’বছরের মধ্যেই বেঙ্গল পেপারমিলের পঁচাত্তর জনের মতো শ্রমিককে কুখ্যাত মিসা আইনে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে বল্লভপুরের কাগজে কারখানার শ্রমিকরা লাল ঝান্ডাকে  নিয়েই বল্লভপুরের মাটিকে রক্ষা করেছিলেন। কংগ্রেসীবাহিনী পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে যে সন্ত্রাস সংগঠিত করেছিল, তা স্থায়ী হয়নি।
বর্তমান সময়েও আমাদের রাজ্যে একই পরিস্থিতি। গণতন্ত্রকে হত্যা করা  হচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিকদলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আজ  আক্রান্ত। বামপন্থীদের উপর বিশেষ করে সি‍‌পিআই (এম) কর্মীদের ওপর আক্রমণ বেড়েছে। একইসাথে মানুষের আন্দোলনও তীব্র হচ্ছে। এই আন্দোলনকে আরও তীব্র করে অনেক বেশি মানুষকে জোটবদ্ধ করার লড়াই চলছে। এই লড়াইকে সফল করে তুলতে হবে।
 

Comments :0

Login to leave a comment