দেবাশিস মিথিয়া
গত ১২ ফেব্রুয়ারি যখন মোদী ওয়াশিংটন ডিসি’তে পৌঁছান, ট্রাম্প প্রশাসনের তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসক তাঁকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে এমনকি হোয়াইট হাউসের বারান্দায়ও আসেননি। ইজরায়েল, জাপানের নেতারা যে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন, তা কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রীর জোটেনি। কূটনৈতিক মহলের বক্তব্য, মোদীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বরং তিনি সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন এবং সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানেয়াহু, জাপানের শিগেরু ইশিবা এবং জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহর পর, ট্রাম্পের দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে তাঁর সাথে দেখা করা চতুর্থ রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারত ‘আবার’ জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে— অতুলপ্রসাদের গানের এই লাইনটিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আমেরিকানদের সামনে তুলে ধরেছেন। তবে অন্যভাবে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন ‘মেক ইন্ডিয়া গ্রেট এগেন’বা ‘মিগা’। তবে প্রধানমন্ত্রী অতুলপ্রসাদের নামও শোনেননি, আর তাঁর গানেও অনুপ্রাণিত হননি। বরং অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের স্লোগান ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’বা ‘মাগা’ থেকে। মোদী আরও বলেছেন, দুই দেশের ‘মাগা’ এবং ‘মিগা’ মিলিত হয়ে ভারত ও আমেরিকার সমৃদ্ধি বহুগুণ বাড়াবে। উন্নয়নের লক্ষ্যগুলিকে নতুন মাত্রা দেবে।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’
২০১৬ এবং ২০২৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ এই শব্দগুচ্ছকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল এর মাধ্যমে আমেরিকার অতীত ‘গৌরব’ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে নস্টালজিয়ার বোধ জাগিয়ে তোলা এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক আধিপত্য পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া। তবে এই স্লোগানের একটি ইতিহাস রয়েছে। ‘এগেন’ বলার পিছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। ১৯৮০ সালে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রোনাল্ড রেগন ‘মেক আমেরিকা গ্রেট’ স্লোগানটি ব্যবহার করেছিলেন। কারণ সেই সময় আমেরিকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ২.৯ শতাংশে নেমে গিয়েছিল যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বৃদ্ধির হারের (৪ শতাংশ) চেয়েও কম। মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। বেকারত্বের হারও ৭.৫ শতাংশ হয়ে যায়। স্থবির অর্থনীতি, চরম মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি সঙ্গে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি— সব মিলিয়ে আমেরিকা জেরবার ছিল। রেগন তাঁর শাসনকালে অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন। ট্যাক্সের হার কমিয়ে এবং বিদেশ নীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৩.৫ শতাংশে নিয়ে যান। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের হারও যথাক্রমে ৪.১ শতাংশ ও ৫.৫ শতাংশে নামিয়ে আনেন। এধরনের কিছু পদক্ষেপ সেসময়ে খানিকটা স্বস্তি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রেকে, তবে তা ছিল নেহাতই সাময়িক। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে আমেরিকা যুদ্ধ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে গিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে আবারও দুর্বল করে ফেলে। রেগনের সেই পুরানো স্লোগানকে ব্যবহার করে ট্রাম্প নির্বাচনে মানুষের মন জয় করতে চেয়েছিলেন।
সমালোচকরা অবশ্য এই স্লোগানের পিছনে অন্য যুক্তি দেখিয়েছেন। তাদের মতে, এই শব্দগুচ্ছের মধ্যে ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী এবং জেনোফোবিক (বিদেশীভীতি) মনোভাব লুকিয়ে রয়েছে। তিনি যে ‘গৌরব’ পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন, তা আসলে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের আধিপত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার একটি প্রচেষ্টা।
‘মেক ইন্ডিয়া গ্রেট এগেন’ ও ভারত-মার্কিন চুক্তি
মোদী আমেরিকায় তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, ভারত, ‘বিকশিত ভারত– ২০৪৭’ এর লক্ষ্যের দিকে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই দেশের উন্নয়নের জন্য ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েকটি কৌশলগত চুক্তি হয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
১) বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে, ২০৩০ সালের মধ্যে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ৫০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া হবে। ২) ভারতের ক্রমবর্ধমান এনার্জি চাহিদা মেটাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল ও গ্যাস আমদানির পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৫বিলিয়ন ডলার করা হবে। ৩) ভারত, আমেরিকা থেকে এফ-৩৫ স্টেলথ যুদ্ধ বিমান সহ অন্যান্য আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম কিনবে। দুই দেশের মধ্যে ১৪.৭৯ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ৪) ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ দুই দেশ যৌথভাবে ‘এ আই’ গবেষণা, পরিকাঠামো ও নীতি সংক্রান্ত একটি রোডম্যাপ চূড়ান্ত করবে। যা প্রযুক্তি-চালিত অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে।
নরেন্দ্র মোদীর ধারণা, এই চুক্তি ভারতকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করবে। তবে তিনি তাঁর ১১ বছরের শাসনকালে ভারতবর্ষের অতীত গরিমাকে ছুঁতে পারেননি বলেই কী তাঁকে 'এগেন' শব্দটি উচ্চারণ করতে হয়েছে? অবশ্য তিনি ভারতীয় অর্থনীতির স্বর্ণযুগ বলতে কোন সময়টাকে ভেবেছেন তা অবশ্য খোলসা করেননি।
ভারত–মার্কিন চুক্তিতে বিপদ
মোদী এবং ট্রাম্পের চুক্তিতে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলি তালিকার একেবারে শীর্ষে রয়েছে। সেগুলি তালিকার ১ থেকে ৬ নম্বরে জায়গা পেয়েছে। চুক্তির শুরুতেই প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়, এটিকে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বলেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পাশাপাশি অর্থনীতিবিদরাও কয়েকটি আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়াতে ভারত আমদানি শুল্ক কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকান দ্রব্যের আমদানি শুল্ক কমলে ভারতীয় বাজারে আমেরিকান পণ্য সস্তায় ছেয়ে যাবে। তখন দেশীয় পণ্য, আমেরিকান পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে বাজার থেকে ছিটকে যাবে। ক্রমে দেশীয় শিল্প সংকুচিত হবে। কমবে দেশীয় বিনিয়োগও। পাশাপাশি বিদেশি দ্রব্যের উপর ভারতের নির্ভরতা এমন জায়গায় পৌঁছবে, যেখানে দেশের স্বনির্ভরতা মার খাবে। আমদানি শুল্কের ছাড় দু’দেশের মোট বাণিজ্যের আয়তন বাড়ালেও তা ভারতের অনুকূলে যাবে না।
এমনিতেই ২০২৪-২৫ আর্থিক বর্ষের প্রথমার্ধে, ভারতের অপরিশোধিত তেলের জন্য আমদানি ব্যয় ৭১.৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। যা গতবারের তুলনায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন ভারত মুখ্যত রাশিয়া, ইরান সহ অন্যান্য দেশ থেকেই জ্বালানি আমদানি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনার অর্থ জ্বালানির ক্রয়মূল্য বেড়ে যাওয়া। কারণ ডলারের অনুপাতে টাকার মূল্য তলানিতে এসে ঠেকেছে মোদী সরকারের দাক্ষিণ্যে। ওরা তেল বেচে মুনাফা করবে, আর জ্বালানির জন্য বাড়তি দাম গুনতে হবে দেশের আপামর সাধারণ মানুষকে। ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল গ্রাহক, দেশের চাহিদার ৮৫% এরও বেশি আমদানি করতে হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী এবং এলএনজি’র শীর্ষ সরবরাহকারী দেশ। অবশ্য কোভিড ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতে অপরিশোধিত তেল আমদানিতে মার্কিন দেশের অংশ ২০১৯ সালে ৪.৫% থেকে কমে ২০২৪ সালে ৩.৪% হয়েছে। ডলারের তুলনায় টাকার ক্রমহ্রাসমান মূল্যমানের জন্য এর ফলে লাভবান হয়েছে আমাদের দেশ। এখন ট্রাম্প সেদেশের তেল কোম্পানিগুলোর মুনাফা বাড়াবার লক্ষ্যে আবার অতিরিক্ত ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তেল আমদানি করতে বাধ্য করছেন ভারতকে, আর অনুগত বাধ্য মোদী দেশের মানুষের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে জো হুকুম বলে তা মেনে আসলেন কার স্বার্থে?
এছাড়াও আমদানিকৃত তেল ও গ্যাসের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল হলে, দীর্ঘমেয়াদে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। জীবাশ্ম জ্বালানির উপর এই পরনির্ভরতা, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের ৫০০ গিগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি সৃষ্টির লক্ষ্যকে বাধা দেবে। এর ফলে পরিবেশগত উদ্বেগ আরও বাড়বে।
আমেরিকা থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের আমদানি বাড়ানোর অর্থ, প্রতিরক্ষা বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর ভারতের অত্যধিক নির্ভরশীলতা, যা দেশীয় প্রতিরক্ষা শিল্পগুলিকে অবলুপ্তির পথে নিয়ে যাবে। এবং ভবিষ্যতে ভারতের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করবে। যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেই মোদী এলন মাস্কের সাথে সভা করেন। সেই মাস্কই ২০২৪ সালের নভেম্বরে তার নিজস্ব সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে একটি পোস্টে, লখিড মার্টিন কোম্পানির তৈরি এফ ৩৫ স্টেলথ যুদ্ধবিমানকে ব্যববহুল এবং অপ্রচলিত বলে অভিহিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন ড্রোনের যুগে এর কোনও অর্থ হয় না। আনুমানিক ৯,৫০০ কোটি টাকার এই যুদ্ধ বিমান কেনার যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা তো নরেন্দ্র মোদীকে দিতে হবে।
এইসব আশঙ্কা সত্যি হলে দেশের ঘোরতর বিপদ!
সমৃদ্ধির নামে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি
মোদী যদি বলতেন ‘মেক ইন্ডিয়া গ্রেট’ তাহলেও মনে হতো কিছু একটা করতে চাইছেন। আশা জাগত দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাড়বে। মনে হতো সরকার বিনিয়োগ বাড়িয়ে বেকারত্ব, দারিদ্র্য কমাতে চাইছে, মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের জীবনকে কিছুটা সুস্থির করতে সচেষ্ট হচ্ছে। কোথায় সে সব? দেশের কৃষির উন্নতি ঘটলে কৃষকের আয় বাড়ে। অর্থনীতিতে কার্যকরী চাহিদা সৃষ্টি হয়, যা বাজারকে চাঙ্গা করে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মোদী সরকার সেকাজেও চরম ব্যর্থ। সমৃদ্ধির নামে শুধুই গালভরা কথা আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি।
ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় এসেই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে ২০ লক্ষ ভারতীয়কে চিহ্নিত করেছে। খবরে প্রকাশ, এর মধ্যে ২০ হাজার ভারতীয়কে ইতিমধ্যেই বন্দিশিবিরে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়েছে। চূড়ান্ত অমানবিকভাবে এদের হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে মালবাহী বিমানে পশুদের মতো ফেরত পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সেবাদাস নরেন্দ্র মোদী নির্লজ্জের মতো মার্কিন প্রশাসনের এই কাজে সহমত হয়ে এসেছেন। কোন দেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করতে গেছেন তিনি? আদানির কৃপাধন্য মোদী আহ্লাদিত কারণ, মার্কিন মুলুকে ট্রাম্প আসার পর রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে আদানির বিরুদ্ধে সেদেশে চলা ঘুষের মামলা স্থগিত করে দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্নের প্রাপ্তি বোধহয় এটাই। কিন্তু দেশে সাধারণ মানুষের কি লাভ হবে কি চুক্তিতে সেটা এখনও কেউই বলতে পারছেন না।
আসলে ভারত–মার্কিন এই চুক্তি হলো আমেরিকার কাছে দেশকে সমর্পণের মোদীর মরিয়া চেষ্টা।
Comments :0