Post Editorial

পথ বন্ধুর, সময়তো লাগবেই বন্ধু!

উত্তর সম্পাদকীয়​

post editorial on science

অরুণাভ মিশ্র

বিজ্ঞান মানব কল্যাণের কাজ করে। এও জানি তার নিয়ন্ত্রকরা তাকে মানব ও প্রকৃতির ক্ষতিকর আর বিধ্বংসী কাজেও ব্যবহার করেন। কৃষিসমাজ আর শিল্পসমাজের বাঁধন থেকে বিজ্ঞানের পূর্ণ মুক্তি ঘটলেই কেবল তাকে শ্রেণি শোষণের কাজে বাধ্য করা যায় না। যায় না হত্যা আর ধ্বংসের যুদ্ধের উপকরণ বানানোর ভার নিতে বাধ্য করতে। তখন বিজ্ঞান পরিপূর্ণভাবে মানব কল্যাণে যুক্ত হতে পারে। বিজ্ঞানকে মানবহিতৈষীর কাজে পূর্ণ ভাবে লাগানোর লক্ষ্যে যারা অনলস, তারাই 'জনবিজ্ঞান আন্দোলনের' সংগঠক ও কর্মী। তারা অন্ধত্বের বিরুদ্ধে অনলস। মানব কল্যাণের উপযোগী বৈজ্ঞানিক নীতির জন্য লড়াই যেমন তারা করে, তেমনি বিজ্ঞানকে পূর্ণ শক্তিতে পাওয়ার পথে বাধাগুলোকেও সামনে তুলে ধরে। বিজ্ঞান সংস্কৃতির ধারাবাহিক বিকাশ, বৈজ্ঞানিক মননের উন্মেষ আর যুক্তিবাদী চিন্তা ও চেতনা গড়ে তোলার মাধ্যমে মুক্তমনা মানুষ তৈরিই তাদের লক্ষ্য। সমাজে এই শক্তির উদয় নতুন সমাজ তৈরির উপযোগী পরিবেশ আনে। সে সমাজে থাকে না অন্যায়, অসমতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস। অপব্যবহার হয় না বিজ্ঞানের। ধর্মমোহের আগুনে মানুষ পোড়ায়না মানুষকে। আজকের সমাজের বুকে নতুন সমাজ, এই পৃথিবীর বুকে নতুন পৃথিবী, তাই এতটাই কাঙ্ক্ষিত!
ভারতবর্ষে জনবিজ্ঞান আন্দোলনের গড়ে ওঠা
স্বাধীন ভারতের প্রথম জনবিজ্ঞান সংগঠন হলো বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। ১৯৪৮ সালে এর সূচনা বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর হাতে। এর আগে ১৯৩৬ সালে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন। সায়েন্স অ্যা ন্ড কালচার পত্রিকার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে তারা বিজ্ঞানকে পৌঁছে দিত। বিজ্ঞান পরিষদের বিধিতে  বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের সঙ্গে ‘সমাজকে বিজ্ঞান সচেতন করার’প্রশ্নটি স্পষ্টভাবে উল্লেখিত রয়েছে। মানুষের মাঝে বিজ্ঞানকে নিয়ে যাওয়ার কথা না হয় বিজ্ঞানীদের মনে আসতে পারে, কিন্তু সমাজকে বিজ্ঞান সচেতন করার এই ধারণাটি পরিষদ প্রতিষ্ঠাকারের মধ্যে এল কি করে? এক্ষেত্রে আমার অনুমান, ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত জে ডি বার্নাল এর ‘সোশাল ফাংশন অব সায়েন্স’ বইটি সত্যেন্দ্রনাথ পড়েছিলেন এবং তাতে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিজ্ঞানের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা, সেখানেই প্রথম দেখি আমরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে কেমব্রিজে ১৯৩২ সালে ‘কেমব্রিজ সোশালিস্ট অ্যান্টি ওয়ার গ্রুপ’তৈরি করে বিধ্বংসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের সামাজিক ভূমিকার বার্তা ছিল বার্নালের। পরে যে বই লিখলেন তা পড়ে সত্যেন্দ্রনাথ প্রাণিত হননি, বলা যায় না!
এরপর একে একে জন্ম নিতে থাকে ‘আসাম সায়েন্স  সোসাইটি’ (১৯৫৩), ওড়িশায় ‘বিজ্ঞান প্রচার সমিতি’(১৯৬০), এবং  ‘কেরল শস্ত্র সাহিত্য পরিষদ’ (১৯৬২)। পর পর অন্যরা। ১৯৮৬ সালের ২৯ নভেম্বর জন্ম নেয় আমাদের প্রিয় সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ। আজ সেই সংগঠনের চার দশক উদ্‌যাপনের মুহূর্ত!
১৯৮৪ সালে ভুপাল গ্যাস দুর্ঘটনা ধনবাদী সমাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপপ্রয়োগ কি বীভৎসা ডেকে আনতে পারে তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। প্রতিবাদে ১৯৮৫ সালে ব্যাঙ্গালোর থেকে দিল্লি এক জাঠা মিছিল করে বিজ্ঞান সংগঠনগুলি।  জাঠার সফল রূপায়ণ বিজ্ঞান প্রচারে ভারত জন বিজ্ঞান জাঠা (BJVJ) সংগঠিত করতে উৎসাহ জোগায়। ব্যাপকভাবে সফল হয় তা। তারপর ২৬ টি সংগঠন ১৯৮৮ সালের ১১ এবং ১২ ফেব্রুয়ারি কেরালার কান্নুরে এক কংগ্রেসে মিলিত হয়। সেখানেই 'সারা ভারত জনবিজ্ঞান নেটওয়ার্ক' (AIPSN) নামে এক সর্বভারতীয় সংগঠনের জন্ম দেয় তারা। দেশে বিজ্ঞান মনস্কতার বিকাশ, প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও সংরক্ষণ, মানব কল্যাণকামী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতির জন্য সংগ্রাম, স্বনির্ভরতা, জনস্বাস্থ্য ও জনশিক্ষার সুব্যবস্থা এবং বিজ্ঞানকে ধ্বংস ও অপপ্রয়োগের কাজ থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট থাকার সিদ্ধান্ত নেয় এরা। 
প্রতিক্রিয়ার শক্তি থেমে ছিল না
প্রতিক্রিয়ার শক্তি কিন্তু থেমে ছিল না। ১৯৮৮ সালে AIPSN  তৈরি হওয়ার চার বছরের মধ্যেই ১৯৯১ সালের ১১ ও ১২ অক্টোবর নাগপুরে এক সভার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় সঙ্ঘের বিজ্ঞান শাখা 'বিজ্ঞান ভারতী'। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষনায় ২২টি রাজ্যে শাখা এবং আরও চারটি রাজ্যে যোগাযোগ গড়ে তুলেছে তারা। মুখ্য কাজ, স্বদেশি বিজ্ঞানের বিস্তার। ‘Science with Swadeshi spirit’ তাদের স্লোগান।  Rationality র বদলে spirituality সেই  বিস্তারে তাদের অস্ত্র। Basic Science বা মৌলিক বিজ্ঞানের সঙ্গে spirituality মিলিয়ে তারা স্বদেশি বিজ্ঞানের গতিপথ স্থির করে। তাদের যুক্তি, 'East is east, west is west. West is rational but east is spiritual’ । ভারত ভাববাদ, রহস্যবাদ ও আধ্যাত্মবাদের দেশ। তাই বিজ্ঞান হবে তার প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে! বিজ্ঞান যে দেশভেদে আলাদা হয় না, তার প্রকৃতি যে আন্তর্জাতিক, তা এই গোঁড়াদের কে বোঝাবে? 
বিজ্ঞানের সেকুলার ও বস্তুবাদী প্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে এক গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী বিজ্ঞান সংস্কৃতি উপহার দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। এর বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই আজকের বিজ্ঞান আন্দোলনের মুখ্য উপজীব্য।
আমরা কি কেবল ভাববাদী আর আধ্যাত্মবাদী?
ভারতবর্ষে যে প্রবল বস্তুবাদ চর্চা অতীতেও ছিল তা আজ প্রমাণিত। চার্বাকদের মুক্তবুদ্ধি চর্চায় একটা কথা ছিল, ‘মৃত্যু সকলেরই হবে, কেউ অমর নয়, আর মৃত্যুর পর ভস্মীভূত দেহ কিছুতেই আর ফেরত আসে না’। এসব কথায় তারা আসলে আত্মা, পরজন্ম-পূর্বজন্ম, স্বর্গ-নরক, কর্মফল, ইহলোক-পরলোক, এইসব অপ্রত্যক্ষ জগৎকে নস্যাৎ করেছিলেন। ব্রাহ্মণরা জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞে পশুবলিকে বৈধতা দিতে বলতেন, এতে পশুরা সরাসরি স্বর্গে চলে যায়। চার্বাকদের যুক্তি, এত সহজে চিরকাঙ্ক্ষিত স্বর্গে পাঠানো গেলে যজমানেরা নিজের বাবাকে বলি দেয় না কেন? প্রাচীন ভারতের এই যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী ধারা অগ্রাহ্য করবেন কিভাবে?
গীতা হিন্দু ধর্মশাস্ত্র। সেই গীতায় কর্তব্য বিষয়ে শাস্ত্রের কথা মেনে চলতে বলেছে। তার প্রতিবাদে বৃহস্পতি সংহিতা শাস্ত্রকে অন্ধ অনুসরণ না করে যুক্তবিচার করে কর্তব্য স্থির করতে বলেছে। বশিষ্ঠ সংহিতা আরও একধাপ এগিয়ে বলেছে, ‘অন্যদের (যুক্তিহীনদের) তৃণবৎ ত্যাগ করা উচিত’। 
ঋগবেদ কর্মকাণ্ডের যুগের। সেখানে কৃষি শুরুর আগে যজ্ঞ হতো, আর যজ্ঞে হবি বা ঘি দেওয়া হতো ইন্দ্রকে। প্রজাপতি সুক্তে নেম ঋষি প্রশ্ন তুললেন, কে ইন্দ্র? কে দেখেছে তাকে? ঋক স্তোত্রকারদের অনেকে বললেন, ‘অন্ন উৎপাদনের জন্য জনগণের প্রচেষ্টাই পর্যাপ্ত, এজন্য ইন্দ্রের স্তুতি অবান্তর’!
এমন আরও যুক্তি এবং বস্তুবাদী কথা চরক আর সুশ্রুত সংহিতার পদে পদে ছড়িয়ে আছে। এসব ভারতীয় ঐতিহ্য আধ্যাত্মবাদীরা জানেন তো?
অন্ধ জাতিগর্ব জাগানিয়া উন্মাদনা রোখো 
ভারতে জাতি ও বর্ণভেদ ব্যবস্থার অবসান চেয়েছিলেন আম্বেদকর। সংবিধান তৈরির সময় সকলের সমান রাজনৈতিক সমানাধিকার আনা গেলেও সামাজিক আর অর্থনৈতিক অধিকার আনা যায়নি। তাই জাতি ও বর্ণভেদ থেকে গেল। বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ নিচুজাতের জন্য সামাজিক নিয়মবিধি কঠিন করলো। বিরক্ত আম্বেদকর সদলে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেন। বুদ্ধের বাণীকে সমসাময়িকতায় মুড়ে বলেছিলেন-
"নিজেই তোমার পথপ্রদর্শক হও
আশ্রয় নাও যুক্তির কাছে
আশ্রয় নাও সত্যের কাছে"
বর্ণ-বিভাজনের নৈতিকতা নিয়ে যুক্তিবাদীরা প্রশ্ন তুলতে পারে। তাই মনু স্পষ্ট বিধান দিয়ে যুক্তিবাদীদের সমাজ থেকে বহিষ্কারের নিদান দিয়েছেন। এই যুক্তিরোধী মনুস্মৃতিকেই হিন্দুত্ববাদীরা আজ ভারতের সংবিধান করতে চাইছে।
হিন্দুত্ববাদীদের দর্শন সম্পূর্ণতঃ ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শন। বেদান্তের শংকর ভাষ্য, ‘ব্রহ্মই জগৎ, জগৎ জুড়ে ব্রহ্মের প্রকাশ’। সেই ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের জন্ম। ক্ষত্রিয়ের বাহু, বৈশ্যের উরু এবং শুদ্রের পা থেকে। তাই জন্ম থেকেই ব্রাহ্মণেরা শ্রেষ্ঠ। তারা ব্রহ্মজ্ঞান দান করে বেদ পাঠ। অন্যদের বেদ পাঠ নিষিদ্ধ, তাই ব্রহ্মজ্ঞান পাওয়ার সুযোগ নেই। 
বেদান্ত দর্শনের এই উচ্চমার্গীয় বিচারধারাকে লৌকিক যুক্তি দিয়ে আঘাত করে সরহপাদরা বলেছিলেন, 'ব্রাহ্মণ ব্রহ্মার মুখ হইতে হইয়াছিল, যখন হইয়াছিল তখন হইয়াছিল, এখন তো অন্যেও যে রূপে হয় ব্রাহ্মণ সেই রূপেই হয়, তবে আর ব্রাহ্মণত্ব রহিল কি করিয়া? যদি বলো বেদ পড়িলে ব্রাহ্মণ হয় তাহাও পড়ুক। আর তাহা পড়েও তো, ব্যাকারণের মধ্যে তো বেদের শব্দ আছে। ... বেদ তো আর পরমার্থ নয়, … বেদ কেবল বাজে কথা বলে।'
লেনিনের কথায়, প্রত্যেক জাতীয় সংস্কৃতির মধ্যে দুটো ধারা থাকে। একটি মনন এবং নন্দনের উঁচু দরের ধারা, যাকে বলা হয় বড় ঐতিহ্য বা ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাডিশন’। আরেকটি হলো লৌকিক বা জনসংস্কৃতির ছোট ঐতিহ্য বা ‘দ্য লিটল ট্র্যাডিশন’। বড় ঐতিহ্যের থাকে লিখিত রূপ, আর তাকে নিয়ে বুদ্ধিজীবীগোষ্ঠীর চর্চার পরম্পরা। অপর পক্ষে ছোট ঐতিহ্য মুখে মুখেই প্রচারিত হয় ও ছড়িয়ে পড়ে। লেখক নয় সেখানে বাচকই মুখ্য। সরহপাদদের ধারা তেমনই ‘লোক ঐতিহ্য’।
বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের লৌকিক ধারার কথা বলি। এরা বৈদিক ধর্মের সঙ্গে কোনোভাবেই আপস করেননি। বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ উচ্চারণ –
'অধরা মানুষ ধরবে যদি 
আগে ছাড়ো বৈদিক বিধি 
তবে মিলবে রত্ন নিধি।'
যুক্তি বুদ্ধি আর ইতিহাসবোধ না থাকলে জাত ধর্ম ভেঙে মানুষকে এক করে দেখার এই চেতনা আপনা থেকে আসতে পারে না। উনিশ শতকে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য বিধি সবলে নস্যাৎ করে একত্রিত হওয়ার সাহস দেখিয়েছিল বলাহাড়িরা। ‘সাহেবধনী’ সম্প্রদায়ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের চূড়ান্ত বিরোধী ছিলেন। তাদের একটি গানে আছে -
‘মানুষে কোরো না ভেদাভেদ 
করো ধর্ম যাজন মানুষ ভজন 
ছেড়ে দাও রে বেদ।’ 
হিন্দু ধর্মে উচ্চবর্ণের মানুষরা ছাড়া মানুষ হিসাবে অন্য মানুষদের কোনও মর্যাদা নেই দেখে লোকায়ত এই সাধকরা মানুষকে এক করতে চেয়েছিলেন। আজ যখন হিন্দুত্বের সংস্কৃতি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভুলিয়ে, অন্ধ জাতগর্বে কাটোয়ার গীথগ্রাম আর নদীয়ার দেবগ্রামের মতো ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে, তখন মানুষের সংস্কৃতির এই ধারাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচারে আনতে হবে।
ধর্মদ্রোহিতা নয়, মরমী মানবতা ও বস্তুবাদিতা আশ্রয় হোক
আদর্শগত লড়াইতে আর একটি সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। তা হলো ধর্ম। ধর্ম যে বিশ্বাসী মানুষকে পরলোকে হলেও দাসত্বের শৃঙ্খল আর জীবনযন্ত্রণার দুর্দশা মুক্তির দিশা দেখায় তা মর্মে অনুভব করতে হবে। বুঝতে হবে, প্রতিটি ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিল উচ্চবর্গের প্রচলিত সামাজিক নিয়মের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় মানুষদের বিদ্রোহ হিসাবে। বিজ্ঞান আন্দোলনের অগ্রণী কর্মী বা নেতৃত্ব যারা, তারা প্রমাণভিত্তিক যুক্তি, বিশ্লেষণী মনোভাব নিয়ে চলেন। তারা আত্মা, পরলোক, প্রভৃতিতে স্বভাবতই প্রত্যয় রাখেন না। প্রত্যয় রাখেন না ঈশ্বরে, শাস্ত্রের অন্ধ অনুশাসনে। কিন্তু সমাজের অধিকাংশ মানুষ ধার্মিক প্রকৃতির, ঈশ্বর বিশ্বাসী। তাদের এড়িয়ে চলার কথা ভাবাটাই অন্যায়। বরং হিন্দুত্ববাদী স্লোগান যখন ভারতের বহুত্ববাদী ভাবনাকে ফালাফালা করে বিভেদ বাড়াতে চাইছে, তখন মানুষকে কাছে টানতে হবে। আমাদের শক্তিই হলো একতা। ঈশ্বরদ্রোহিতা বা ধর্মদ্রোহিতা সেখানে বিভেদকামীদের স্বার্থকেই রক্ষা করবে।

ধর্মবিশ্বাস অর্থনৈতিকভাবে ধনবাদের দেওয়া। তার জগতটা ওলটানো। ধনবাদী সামন্তবাদী সমাজ না হটিয়ে ধর্মবিশ্বাস হটানো যাবে না। ওলটানো জগতে চেতনা সোজা করার কাজ কঠিন। ধনবাদ হটিয়ে জগৎটা সোজা করে দিতে পারলে সেকাজ সহজ হয়ে যাবে। ধর্মীয় আবেগে আঘাত করার কাজ সযত্নে এড়িয়ে মোহমুক্তি ও জ্ঞানপ্রচারের কাজ করে যেতে হবে। অসমতা, অন্যায়, ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইকে জ্ঞান বিজ্ঞান বিকাশের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
শুধু লেনিন নয়, সাবলটার্ন শ্রেণি বা নিম্নবর্গের ধর্ম ভাবনা যে উচ্চ বর্ণের চেয়ে আলাদা হয়ে থাকে তা বলেছেন ইতালির বিপ্লবী চিন্তানায়ক আন্তোনিও গ্রামসি। জাতধর্মের মুখোশ ছিঁড়ে মুক্তবুদ্ধির সুবাতাস ছড়িয়ে লালন তাই গাইতে পারেন -
আল্লা হরি ভজন পুজন
সকলই মানুষের সৃজন।।
মানুষই আল্লা হরি সৃষ্টি করে শ্রেণি বিভক্ত সমাজে শ্রেণিভেদ জাতিভেদ ও ধর্মভেদ বাঁচিয়ে রাখে, নিজেদের শাসন কর্তৃত্ব জিইয়ে রাখার প্রয়োজনে। তাই মানুষের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত না করে ধর্মপালনের নামে বিজ্ঞান বিরোধিতা ও পরধর্ম অসহিষ্ণুতার প্রকৃতির বিরুদ্ধে আপসহীন থাকতে হবে।
আন্দোলনের সূচিমুখ 
পরিবেশ ও জলবায়ুর বদল রোধ, তাপ প্রবাহ, প্রাকৃতিক সম্পদ লুট, জনস্বাস্থ্য সমস্যা, অবৈজ্ঞানিক শিক্ষানীতি আর তাতে ভরে দেওয়া ভারতীয় জ্ঞানতত্ত্বের নামে পুরাণ ও ধর্মচর্চা, স্বনির্ভরতা, ক্ষুদ্র শিল্পদ্যোগ ও কৃষি নির্ভর শিল্প, কৃষকের হাতে কৃষির প্রযুক্তি আর জমি, মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় উৎসাহ, গবেষক সংখ্যা ও তাদের ভাতা বৃদ্ধি, কৃত্রিম মেধার  নিয়ন্ত্রিত ও উপযোগী ব্যবহার প্রভৃতি নানা প্রশ্ন আজ সামনে আছে বিজ্ঞান আন্দোলনের। আছে রাজ্যে আর দেশে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার বিরোধী আইনের দাবি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মননকে দার্শনিকভাবে ভাববাদ, জাতিগর্ব ও ধর্মীয় আবেগে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টাকে দার্শনিক ভাবেই প্রবল প্রতিরোধে রুখে দিতে হবে। আদর্শগত এই লড়াইকে মিলিয়ে দিতে হবে মানুষের প্রতিদিনের যাপনের দাবিগুলির সঙ্গে। মনে রাখতে হবে, এটা দূরপাল্লার দৌড়, ম্যারাথন। স্প্রিন্টারের মতো কয়েক সেকেন্ডেই ফল আসবে না। তাই ধৈর্য ধরে, আঘাত সয়ে টিকে থাকতে হবে এই লড়াইতে। আর টিকে থাকার জন্য শিখতে হবে, শেখাতে হবে প্রতিদিন।
বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের লক্ষ্য নিয়ে চলা লড়াইতে জয় আসতে সময়তো লাগবেই!

Comments :0

Login to leave a comment