editorial

৭৫-র চৌকাঠ

সম্পাদকীয় বিভাগ

নিজেকে অবতার বানিয়ে হিন্দুত্ববাদী তথা অন্ধ ভক্তদের পূজনীয় হবার বড়ই বাসনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। একেবারে আটঘাট বেঁধে নিখুঁত পরিকল্পনা করে নিজেই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমে পড়েছিলেন গত লোকসভা নির্বাচনের আগে। এক বিশেষ একান্ত সাক্ষাৎকারে নিজেকে অতিমানবীয় হিসেবে তুলে ধরে বোঝাতে চেয়েছেন তিনি আদৌ সাধারণ মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে পড়েন না। মানব শিশুর জন্ম যে জৈবিক প্রক্রিয়ায় হয় তাঁর জন্ম নাকি সেভাবে হয়নি। পিতা-মাতার মিলনে মাতৃগর্ভে জন্ম নেয় মানব শিশু। মোদী বলেছেন ঐভাবে মাতৃ গর্ভে তার জন্ম হয়নি। স্বয়ং বিষ্ণু তাঁকে স্বর্গ থেকে মর্তে পাঠিয়েছেন ভারতের জন্য নির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পন্ন করার জন্য। সে কাজ শেষ হয়ে গেলে বিষ্ণুই নাকি তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মতো তাঁর মৃত্যু হবে না। নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন হবার আগে বিষ্ণুও তাঁকে ফিরিয়ে না নেবারই কথা। অবশ্য কি সেই নির্দিষ্ট কাজ মোদী সেটা স্পষ্ট করে বলেননি।
নির্বাচনের আগে নিজেকে অতিমানব অবতার বানাবার এই প্রয়াসের মধ্যে গোটা নির্বাচনী প্রচারকে মোদীময় করে তোলা হয়েছিল। দল তথা বিজেপি’কে ছাড়িয়ে মোদীকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল অনেক উপরে। স্লোগান তোলা হয়েছিল ৪০০ পারের। অর্থাৎ নির্বাচনে বিজেপি ৪০০-র বেশি আসনে জেতার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ৪০০ তো বহুদূর, ২৪০-র বেড়া ডিঙোনোই অসম্ভব হয়ে যায়। নির্বাচনে এই বড়সড় ধাক্কা মোদীর অবতার বা কাল্ট হয়ে ওঠা বিশবাঁও জলে চলে যায়। কিছুটা হতাশ, হতোদ্যম ও মনমরা হয়ে পড়েন প্রথম ধাক্কায়।
এইভাবে একমেব অদ্বিতীয়ম বানিয়ে এবং অবতার সাজিয়ে নিজেকে ক্ষমতার শীর্ষে স্থায়ীভাবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে ফেলবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষ তাঁর সেই বাড়া ভাতে ছাই ফেলে দিয়েছে। অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকার আর একটি কাঁটা বয়স। এ মাসেই তিনি ৭৫ বছরে পদার্পণ করেছেন। আরএসএস’র পরামর্শে বিজেপি’তে অলিখিত বিধি চালু আছে ৭৫ বছর হলে শীর্ষ বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে অবসর নেবেন। এই বিধি অনুযায়ী এক সময়ের দাপুটে নেতা লৌহমানব এলকে আদবানিকে সব দায়িত্ব ছেড়ে মার্গদর্শক বা বানপ্রস্থে যেতে হয়েছিল। একই পরিণতি হয়েছিল মুরলীমনোহর যোশীরও। আদবানিকে বিধির ফাঁদে ফেলে সরানো না হলে মোদীর পক্ষে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ আসত না। এখন সেই বয়স বিধির ভূত মোদীর রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। বিশেষ করে কয়েক মাস আগে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছিলেন ৭৫-এ পা দেবার অর্থই হলো, অবসরের সময় এসে গেছে। তারপর থেকেই মোদী প্রহর গুনতে শুরু করেন কখন নাগপুর থেকে অবসরের ফরমান আসে। তবে আশার আলো ছিল একই সময়ে ভাগবতেরও বয়স ৭৫ হওয়ায়। মোদীকে বানপ্রস্থে পাঠানো হলে ভাগবতের অবসর নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। কয়েকদিন আগে মোদী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন ভাগবতের এক মন্তব্যে। তিনি বলেছিলেন ৭৫ হলেই কাউকে অবসর নিতে আমি বলিনি।
এদতসত্ত্বেও মোদী ঝুঁকি নেননি। ভাগবতের ৭৫তম জন্মদিনে এই প্রথম তাঁর প্রশস্তি গেয়ে প্রবন্ধ লিখে দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছেন মোদী। তাতে শত বর্ষের মধ্যে ভাগবতকে শ্রেষ্ঠ প্রধান হিসেবে জাহির করেছেন। আচমকা ভাগবতকে এমন মাত্রাতিরিক্ত তোষামোদ দৃষ্টিকটু মনে হলেও মোদীর পক্ষে সেটা জরুরি ছিল। ভাবমূর্তি অনেকটা ফিকে হয়ে যাওয়ায় মোদীর পক্ষে আগের দাপট দেখানোর উপায় নেই। তেমনি আরএসএস’র এখন মোদীকে সমঝে চলার দায় নেই। সেজন্যই কি ভাগবতের জন্মদিনে মোদী তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেও মোদীর জন্মদিনে ভাগবত একটি শব্দও ব্যয় করেননি।

Comments :0

Login to leave a comment