যে কেউ নিজেদের টাকায় ধর্মীয় উপাসনাস্থল বানাতেই পারেন, কিন্তু সরকারি টাকায় জগন্নাথ মন্দির ও দুর্গাঅঙ্গন কেন? সোমবার সালারে এসএফআই’র জেলা সম্মেলন উপলক্ষে প্রকাশ্য সমাবেশে এই প্রশ্ন তুলে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘আমরা ধর্মের বিরোধী নই, যে কেউ নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে উপাসনাস্থল বানাতেই পারেন, কিন্তু সরকার কেন বানাবে? সরকারের কাজ স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তা সেতু ইত্যাদি তৈরি করা, যা ধর্ম নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ ব্যবহার করবেন। আমরা বামপন্থীরা ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনার বিরুদ্ধে।’’
বামফ্রন্ট সরকারের তৈরি করা নিউটাউনে (জ্যোতি বসু নগর) মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এদিনই দুর্গাঅঙ্গনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। এই প্রসঙ্গে সেলিম বলেছেন, ‘‘আমরা বলেছিলাম ওখানে ফিনান্সিয়াল হাব হবে, দেশ বিদেশের বিনিয়োগ আসবে, কর্মসংস্থান হবে। আমরা তো কোনও ধর্মীয় উপাসনাস্থলের বিরোধিতা করিনি। উপাসনাস্থল তৈরির জন্য সরকার বা রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ লাগে না, সরকার, দল এসব তৈরি হওয়ার অনেক আগে থেকে দেশে মন্দির মসজিদ গির্জা গুরুদ্বার আছে, থাকবে। কিন্তু সেটাকেই এখন রাজনীতির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বামপন্থীরা রাজনীতিতে রাস্তা, রেললাইন, স্কুল কলেজ, হাসপাতাল এসব তৈরির জন্য আন্দোলন করি, এগুলো তৈরি হলে সব ধর্মের মানুষই ব্যবহার করতে পারে। যারা এগুলো তৈরির বদলে মন্দির মসজিদ তৈরি করে তারা ভক্তি বা বিশ্বাসে করে না, এগুলো নিয়ে ধর্মে ধর্মে মারামারি বাঁধানোর জন্য করে।’’
ধর্মকে রাজনীতিতে টেনে আনার বিপদের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আফগানিস্তানে চোদ্দশো বছর ধরে ইসলাম আর গান্ধার শিল্প একই সঙ্গে ছিল। যখন ইসলামকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে কঠোর করা হলো তখনই বামিয়ানের বুদ্ধ মূর্তি ভাঙতে কামান লাগানো হলো। এভাবেই আমাদের দেশে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে হিন্দুত্বের কথা বলে। এভাবেই বাংলাদেশে ছায়ানট ভাঙছে, মানুষকে পুড়িয়ে মারছে মৌলবাদীরা। বিদ্যুতের পজিটিভ আর নেগেটিভ তারকে যেমন মোড়ক দিয়ে আলাদা (ইনস্যুলেট) করে রাখতে হয় নইলে শর্ট সার্কিটে আগুন ধরে যায়, তেমনই রাজনীতি আর ধর্মকে সমাজে আলাদা রাখতে হয়। নইলে অশান্তির আগুনে মানুষের প্রাণ যায়। শুধু রাজনীতিকদেরই নয়, ধর্মপ্রাণ মানুষেরও উচিত ধর্মের অমর্যাদা রোখার জন্য এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসা।’’
দক্ষিণপন্থীরা কীভাবে ধর্মের ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আড়ালে মানুষের সর্বজনীন অধিকারগুলি কেড়ে নিচ্ছে তার দৃষ্টান্ত দিয়ে সেলিম বলেন, ‘‘মোদী সারা দেশে ৩৮ হাজার স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে, আর পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির হাতে ৮২০০ স্কুল বন্ধ, যার বেশিরভাগই প্রাথমিক। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে আমাদের কাজ ছিল যেখানে স্কুল নেই, সেখানে স্কুল তৈরি করা, প্রাথমিক স্কুলকে মাধ্যমিকে উন্নীত করা, কলেজ করা, কলেজে বিভিন্ন বিভাগ চালু করা, মেয়েদের জন্য স্কুল কলেজ চালু করা। ১৪ বছরের নিচের কেউ স্কুলের বাইরে থাকলে খুঁজে তাকে স্কুলে নিয়ে আসা। কারণ শিক্ষার সঙ্গে রোজগার এবং রোজগারের সঙ্গে উন্নয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নয়ন মানে মোদী-মমতার ছবি সহ সাইনবোর্ড নয়। শিক্ষায় বিনিয়োগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার সুযোগ পেলে মানুষ জীবনসংগ্রাম করতে পারে। এই কারণেই বামপন্থী সরকারের হাতে কেরালা একশো শতাংশ সাক্ষরতার সঙ্গে সঙ্গে চরম দারিদ্র থেকে মুক্ত হতে পেরেছে। কিন্তু মোদী-মমতার শাসনে সেটাই অবহেলিত। নীতির দিক থেকে দু’টো সরকার এক পথে চলেছে। দেশি বিদেশি বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে ওরা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে দিতে চায়। নেতা মন্ত্রী ধনীদের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়তে পারবে, কিন্তু কৃষক খেতমজুরের ঘরের ছেলেমেয়েরা পড়বে কোথায়? বামপন্থা মানে সবার অধিকারের কথা বলা, আর দক্ষিণপন্থা মানে অধিকারকে কিছু লোকের কুক্ষিগত করা। বামপন্থীরা ভূমিসংস্কার করে শুধু গরিবের হাতে জমিই দেয়নি, গোলায় ধান, ঘরে পয়সা আসায় মানুষের মর্যাদাও এসেছিল। ২ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ হয়েছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। মমতা ব্যানার্জি উন্নয়নের সেই চাকা উলটো দিকে ঘুরিয়েছেন।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘শুধু শিক্ষা স্বাস্থ্য নয়, মানুষের সঞ্চয়ও বেড়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। তখন ইন্দিরা বিকাশ পত্র, কিষাণ বিকাশ পত্র ইত্যাদি ক্ষুদ্র সঞ্চয়ে গোটা দেশে পশ্চিমবঙ্গ ছিল প্রথম স্থানে। বামপন্থীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধ হতো স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমানোর বিরুদ্ধে। তারপর তৃণমূলের হাত ধরে চিট ফান্ড এল, তৃণমূল নেতাদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হলো। গরিবের সঞ্চয় লুট হয়ে গেল। এখন মমতা-মোদী মাইক্রোফিনান্স কোম্পানি নিয়ে এসেছে যার দাপটে গ্রামের পর গ্রাম উজার হয়ে যাচ্ছে।’’
এই সঙ্কটের কোনও ছবি মিডিয়ায় নেই কেন? সেলিম বলেছেন, ‘‘কর্পোরেট মিডিয়া কেবল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী, রোহিঙ্গা, মন্দির মসজিদ নিয়ে প্রচার চালাতে ব্যস্ত। এই রাজনীতির কারণেই রাজ্যে কাজ না থাকায় পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে যেতে হচ্ছে আর সেখানে বিজেপি’র ঘৃণা বিদ্বেষের রাজনীতিতে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। সূতির যুবককে ওডিশায় খুন করেছে। দেশটা কি মগের মুলুক হয়ে গেছে? প্রধানমন্ত্রী সিএএ-এনআরসি নিয়ে প্রচার করতে বলেছিলেন, খাদ্য পোশাক দেখে অনুপ্রবেশকারী চেনা যায়। এখন প্রতিটি আক্রমণের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে। বিজেপি-আরএসএস এবং তৃণমূলের গোড়া এক জায়গায় বাঁধা আছে, নাগপুরে। আরএসএস কিছু কাজ বিজেপি’কে দিয়ে করাচ্ছে, কিছু কাজ তৃণমূলকে দিয়ে করাচ্ছে। তাই বামপন্থার পুনরুত্থান দরকার, বামপন্থার পুনরুত্থান ছাড়া বাংলা বাঁচবে না, বাংলা না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না।’’
এদিন সালার এসএফআই’র মুর্শিদাবাদ জেলা সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সালার স্টেশন সংলগ্ন মাঠে। সভায় এসএফআই’র রাজ্য সম্পাদক দেবাঞ্জন দে বলেছেন, ‘‘রাজ্যে স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, স্কুল ছুটের সংখ্যা বাড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে তৃণমূলের দখলদারির রাজনীতির জন্য। স্কুলগুলি শিক্ষক শূন্য হয়ে যাচ্ছে তৃণমূলের নিয়োগ দুর্নীতির জন্য। আমরা আন্দোলন করছি যাতে গরিবের ঘরের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার অধিকার রক্ষা করা যায় যাতে কোনও স্কুল বন্ধ না হয়। কলেজগুলিতে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ না থাকায় তৃণমূলের দুর্নীতি ও লুট চলছে। শিক্ষার স্বার্থে, ছাত্র-ছাত্রীদের অধিকার রক্ষায় এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই জোরদার করতে হবে।’’
সমাবেশে এছাড়াও ভাষণ দেন প্রাক্তন ছাত্র নেতা জাহাঙ্গির শেখ ও এসএফআই’র জেলা সম্পাদক প্রীতম রুজ। সভাপতিত্ব করেন এনজামূল হক রানা। উপস্থিত ছিলেন এসএফআই’র রাজ্য সভাপতি প্রণয় কার্য্যী ও বামপন্থী আন্দোলনের নেতা জামির মোল্লা। জাহাঙ্গির শেখ জানিয়েছেন, ছাত্র সম্মেলন বন্ধ করতে পুলিশ প্রশাসন দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল। সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে সালারের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের সহযোগিতায় আমরা সম্মেলন করছি।
Salim
সরকারি অর্থে উপাসনাস্থল তৈরি কেন, প্রশ্ন সেলিমের
×
Comments :0