'দিদি' আর 'মোদীর' মিল চোখে পড়ছে অমৃতসরেও!
বাদশাহী আমলের গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড বা জিটি রোড অমৃতসর শহরকে উত্তর এবং দক্ষিণে ভাগ করেছে। জিটি রোডের দক্ষিণে রয়েছে পুরনো অমৃতসর।
গুগল ম্যাপে চোখ বোলালেই দেখা যাবে, অমৃতসর শহরের একদম মাঝখানে গোলাকৃতির একটি রাস্তা রয়েছে। আসলে এটি রাস্তা নয়। পাঞ্জাবের শিখ শাসক রঞ্জিত সিং বারো লক্ষ টাকা খরচ করে অমৃতসর শহর জুড়ে পাঁচিল তৈরি করেছিলেন। সময়ের নিয়মে সেই পাঁচিল মাটিতে মিশে গিয়েছে। পাঁচিলের জায়গায় তৈরি হয়েছে অমৃতসর রিংরোড। এই গোল চৌহদ্দির মধ্যেই স্বর্ণ মন্দির অবস্থিত।
স্বর্ণমন্দির চত্বর থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই জালিয়ানওয়ালাবাগ ময়দান।
জালিয়ানওয়ালাবাগ। ১৯১৯ সালের বৈশাখী উৎসবের দিন এখানেই সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করেছিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী।
জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ৫০ জন জওয়ান নিরস্ত্র জনতাকে লক্ষ্য করে ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করতে তৈরি হওয়া রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে প্রতিরোধ জানিয়েছিলেন ৩৭৯ জন নারী পুরুষ শিশু। কোনও কোনও মতে এই সংখ্যাটা হাজারেরও বেশি। চিরদিনের মতো চোখের দৃষ্টি কিংবা নিজের পায়ে চলার শক্তি হারিয়েছিলেন আরো বহু জন।
এই জালিয়ানওয়ালাবাগ পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে। জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্ত ভেজা মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে বিপ্লবে দীক্ষা নিয়েছিলেন ভগৎ সিং।
এহেন জালিয়ানওয়ালাবাগে ঢুকতে গিয়েই এখন হোঁচট খেতে হচ্ছে। সেই যন্ত্রণার অনুভূতি উধাও করতে হরেক ব্যবস্থা।
জালিয়ানওয়ালা বাগকে শারদ উৎসবের মরশুমে কলকাতার পূজো মন্ডপের মতো আদল দেওয়া হয়েছে। সরু গলিপথ। তার ডাইনে বাঁয়ে ফাইবারের ফ্রেস্কো। এই ফ্রেস্কোর উপর আলো এসে পড়ছে মৃদু। কবিতার সুরে ছেলে ভুলোনো গান চলছে- "আও বাচ্চো তুমহে শুনায় কিসসে হিন্দুস্তান কি"।
এবং এই গোটা প্যাসেজের মাথার উপরে দিনের বেলাতেও জ্বলছে ঝকমকে আলো।
জালিয়ানওয়ালাবাগ চত্বরের ভিতর রয়েছে সেই বিখ্যাত কুয়ো, যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল সেদিনের জনতা। সেটিকেও কাঁচ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে।
অবিকৃত ইতিহাস বলতে কেবল জালিয়ানওয়ালাবাগ চত্বরে দুই প্রান্তে দুটি দেওয়াল। এই দেওয়াল দুটিতে চক দিয়ে গুলির দাগ গোল করা রয়েছে। যদিও জায়গা দুটি কার্যত সেলফি স্পটে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া রয়েছে একটি প্যাভেলিয়ন। সব মিলিয়ে একটি পার্ক এবং পিকনিক স্পটের মিশ্রণে পরিণত হয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগ ময়দান।
কিন্তু জালিয়ানওয়ালাবাগের চেহারা কি এমনটাই ছিল?
জালিয়ানওয়ালাবাগ এবং স্বর্ণ মন্দির চত্বরের বাইরে মিশ্রাজির চাট ভাণ্ডার। চাট ছাড়াও কুলচা, ছোলে বাটোরে, নান ইত্যাদি খাবার পাওয়া যায়। একই সঙ্গে মেলে উত্তর ভারতে জনপ্রিয় সয়াবিন,পনির এবং বাঁধাকপির মিশ্রণে তৈরি স্প্রিং রোল এবং ভেজ মোমো। বাঙালি এই রসায়ন শুনে নাক শিটকালেও ব্যাপারটা খেতে নেহাত মন্দ নয়।
শর্মাজির সঙ্গে কথা হচ্ছিল। হিন্দু পাঞ্জাবী। বয়স্ক মানুষ। খুব সম্ভবত কংগ্রেস সমর্থক।
একথা ও কথায় পৌঁছানো গেল জালিয়ানওয়ালাবাগ প্রসঙ্গে। শর্মাজির দাবি, জালিয়ানওয়ালাবাগ আগে মোটেও এরকমটা ছিল না। ২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদী নিবরূপে সজ্জিত জালিয়ানওয়ালা বাগের উদ্বোধন করেন। তখন থেকেই যাবতীয় বদলের সূত্রপাত।
ফ্রেস্কোতে মুখ ঢাকার আগে জালিয়ানওয়ালাবাগ প্রাঙ্গণে ঢোকার সংকীর্ণ গলিপথ ছিল প্যালেস্তারা খসা নানাক শাহী ইটের তৈরি।
প্রসঙ্গত পাঞ্জাবে এক বিশেষ ধরনের ইট ব্যবহার করা হতো মধ্যযুগে। এই ইটকে বলা হয় নানক শাহী ইট। দেখে প্যালেস্তারা খসা মনে হলেও, স্থাপত্য রীতি মেনে ইচ্ছা করেই তার উপর রং কিংবা প্লাস্টারের প্রলেপ পড়তো না। লাহোর কিংবা অমৃতসর এর মতো শহরগুলি গড়ে উঠেছিল মূলত শিখ রাজত্বের সময়। পুরনো অমৃতসরের অধিকাংশ বাড়ি তৈরি হয়েছিল উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে। জালিয়ানওয়ালাবাগ ময়দান ও তাই।
শর্মাজির কথায়, এর আগে ওই গলি দিয়ে ঢুকলেই এক নিমেষে মনটা শান্ত হয়ে যেত। মাথা নুইয়ে আসত। একই সঙ্গে ছিল এক নিস্তব্ধতা। সারা দেশের মানুষ নিরবে সম্মান জানত জালিয়ানওয়ালাবাগের শহীদদের। পার্কের ভিতরেও তখনও পড়েনি আধুনিকতার প্রলেপ।
সংকীর্ণ গলি পথ দিয়ে ঢুকে মনে হতো সময় যেন থমকে গিয়েছে। অনুভব করা যেত সেই মানুষগুলির আর্তনাদ। এখন সব কেমন বদলে গিয়েছে। এখন আর ভিতরে যেতে ইচ্ছাই করে না।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসা ইস্তক বিজেপি দেশের ইতিহাস নিয়ে পড়েছে। আপাতদৃষ্টিতে পাগলামি মনে হলেও এর পিছনে রয়েছে নিখুঁত অঙ্ক। বিজেপি প্রথম থেকে চড়া সুরে দাবি করে আসছে, দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের ইতিহাসকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। দেশের ইতিহাসের গৌরব গাথাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হয়নি। সেই অপূর্ণ কাজের জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছে নরেন্দ্র মোদি।
এবং ইতিহাসকে তুলে ধরার নামে শুরু হয়েছে যথেচ্ছ ইতিহাস বিকৃতি। যারফলে এক দিকে কাশি বিশ্বনাথ করিডরের নামে বুলডোজার চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে কাশি শহরের ঐতিহ্যের একটা বড় অংশকে। তেমনভাবেই জালিয়ানওয়ালাবাগের ফ্রেসকোতে চাপা পড়ে গিয়েছে রঞ্জিত সিং এর আমলের নানক শাহী ইটের দেওয়াল।
আসলে বিজেপির কাছে ইতিহাস মানে রম্য কাহিনী। এমন কাহিনী যা বাজার চলতি সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ । এবং সেই সঙ্গতিকে হাতিয়ার করে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা অনুযায়ী গড়ে নেওয়া যাবে ইতিহাসের ভাষ্য।
একই কায়দায় এ রাজ্যে হেটেছে এবং হাঁটছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেই একই ছক। বাজার চলতি চেতনা,ভাবনা এবং সংস্কৃতির সাথে মিলিয়ে দিতে হবে ইতিহাসকে। এদের দাবি, একমাত্র এই ভাবেই নাকি ইতিহাসের প্রতি সাধারণ মানুষের আকর্ষণ তৈরি করা যায়।
তারফলে আলিপুর জেল মিউজিয়ামে ঠাঁই পেয়েছে দক্ষিণ কলকাতার নামজাদা এক ক্লাবের দুর্গা প্রতিমা। অপর এক ক্লাবের মন্ডপ সজ্জাও জুড়ে দেওয়া হয়েছে বিপ্লবীদের সেলের সঙ্গে। আলিপুর জেল মিউজিয়ামে ঘুরলেও মনে হবে আপনি শারদ উৎসবের মরশুমে কোন ক্লাবের মন্ডপসজ্জা দেখছেন।
অপরদিকে, জার্মানি পোল্যান্ড সহ পশ্চিম এবং পূর্ব ইউরোপ জুড়ে নাৎসিদের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প গুলিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। অশউইটস হোক কিংবা বুশেনওয়াল্ট, এই ক্যাম্প গুলিতে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূত হবে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। মনে হবে সময় যেন থমকে রয়েছে। গ্যাস চেম্বার থেকে শুরু করে গ্যাস চেম্বারে কয়েদীদের ঢোকানোর আগে পোশাক পরিবর্তনের ঘর, অপরিবর্তিত রয়েছে গোটাটাই। সেই পথ ধরে হাঁটলে স্পষ্টত অনুভব করা যায় গ্যাস চেম্বারে খুন হওয়া লক্ষ লক্ষ মানুষের যন্ত্রণা।
একই সঙ্গে বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা।
এদেশে জালিয়ানওয়ালাবাগ হোক কিংবা আলিপুর জেল, দুই শাসকের বদান্যতায় তা পরিণত হয়েছে নিছক সময় কাটানোর জায়গায়। এখানে হাঁটলে একবারও আপনার বুকের ভেতরে সাম্রাজ্যবাদী শাসকের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ কিংবা ঘৃণা দলা পাকিয়ে উঠবে না। মুচলেকা-বীর সভারকারের হাতে তৈরি সংগঠন এখনো যেন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে এই ভাবেই গুরুদক্ষিণা দিয়ে চলেছে। আর সেই আরএসএস'র বেসরকারি নিয়ন্ত্রণে চলা তৃণমূলও একই কাজ করছে।
Comments :0