‘‘পুলিশ ফাউল প্লে নয়, ট্যাক্টফুলি খেলেছে’’, সাম্প্রদায়িক হিংসার সময় খেলাচ্ছলে মন্তব্য মুখ্যমন্ত্রীর!
রামনবমীর মিছিল থেকে হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডবে হাওড়ার কাজিপাড়া, রিষড়ায় গোলমালের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি এতটাই হিংসাত্মক হয়ে ওঠে যে এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়। বিশাল পুলিশ বাহিনী নামিয়েও পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। শুরু থেকেই বামপন্থীরা দাঙ্গা রুখতে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছিল।
সোমবার নবান্ন থেকে কার্যত বিরোধীদের সেই অভিযোগকেই মান্যতা দিলেন মমতা ব্যানার্জি। রাজ্যের সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে মাটিতে মিশিয়ে আসলে সরকারই যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় মদত দিয়েছে এদিন তা বেরিয়ে আসে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যেই। তার থেকে বড় কথা, সাম্প্রদায়িক অশান্তির পরও মমতা ব্যানার্জি মজে আছেন খেলাতেই।
সোমবার নবান্নে সাংবাদিকদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘পুলিশ এক ঘণ্টা খুব ভালো অবস্থায় ছিল না। সেইজন্য তারা (পুলিশ) ফাউল প্লে বলবো না, এক ঘণ্টা ট্যাক্টফুলি খেলেছে।’’ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ কোটার টাকায় এদিন নবান্ন চত্বর থেকে ৩৫টি অত্যাধুনিক অ্যাম্বুলেন্সের উদ্বোধন করে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেখানেই তিনি সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময় পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কথা মেনে নেন।
মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘ঝুলি থেকে বেড়াল শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে গেল। একমাস আগে মুখ্যমন্ত্রী জানতেন বলেছেন। পুলিশ শিথিলতা দেখিয়েছে বলেছেন। যখন পাচার হয়, অপরাধ হয়, খুন হয়, দাঙ্গা হয়— তখন এইভাবেই পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়। এটাকে বলে আপসের উইন্ডো। নাগপুরকে মুখ্যমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন। পুলিশকে দিয়ে সেই উইন্ডো খুলে রেখেছিলেন। তাই পুলিশ ‘ট্যাক্টফুলি’ খেলেননি, মুখ্যমন্ত্রীর কৌশলে এই গোলমালের ঘটনা ঘটেছে।’’
এদিন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এহেন মন্তব্য শুনে শঙ্কিত হয়ে পড়েন রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের শীর্ষ আধিকারিকরা। কোন পরিস্থিতিতে, কী কথা রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহল থেকে বলা হচ্ছে শুনে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের আধিকারিকরা চমকে গিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র দপ্তর মুখ্যমন্ত্রীর নিজের দপ্তর। তারপরেও মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য শোনার পর এক শীর্ষ আধিকারিক জানিয়েছেন, ‘‘পুলিশকে সক্রিয় হতে বললেও কাজের কাজ কিছুই হতো না। আসলে এই ধরনের গোলমালকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পুলিশ তার যোগ্যতা আগেই বিসর্জন দিয়েছে। সিভিক পুলিশ দিয়ে পুলিশ বাহিনী ভরিয়ে দেওয়ার ফল এর থেকে বেশি কিছু হবে না।’’
গোলমালের সময় পুলিশ কৌশলে খেলার সাফাই দেওয়ার পরপরই এদিন হাওড়া থানার আইসি দীপঙ্কর দাসকে পাঠানো হয়েছে ঝাড়গ্রামের কোর্ট ইন্সপেক্টর পদে। একইসঙ্গে হাওড়ার শিবপুর থানার আইসি অরূপ রায়কে পাঠানো হয়েছে রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে।
রামনবমীর মিছিল থেকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ানোর সময় পুলিশকে দিয়ে কৌশল করে এক ঘণ্টা নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। আর সম্প্রীতি রক্ষার দাবি নিয়ে বামপন্থীরা শান্তি মিছিল করার জন্য পথে নামলে সেই পুলিশই অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে। এদিন হাওড়ার সালকিয়াতে পুলিশের এই অতিসক্রিয়তা আক্রান্ত হয় শান্তি মিছিল।
শান্তি মিছিল আক্রান্ত হচ্ছে। আর সেই অশান্ত এলাকাতে পুলিশের নির্দেশ অমান্য করে অস্ত্র নিয়ে মিছিল হয়েছে। দুপুরে রামনবমীর মিছিল সময় থাকলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সন্ধ্যার নমাজের সময়ও অস্ত্র মিছিল করা হয়েছে। আর এসব মুখ্যমন্ত্রীর অজানা নেই।
এদিন নবান্ন থেকেই মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘একটা ধর্মীয় মিছিলে অস্ত্র নিয়ে কেন যাবে? বন্দুক নিয়ে নাচ করবে কেন? কোন অনুমতিতে বুলডোজার নিয়ে যাবে? ট্রাক্টর নিয়ে যাবে? এগুলো সবকটাই বেআইনি।’’
আর বেআইনি কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী করে করতে পারল? রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পুলিশ তারপরেও কী করে একঘণ্টা নিষ্ক্রিয় থাকল, তার জবাব যাঁর দেওয়ার কথা তিনি অবশ্য বলেছেন, ‘পুলিশ কোনও ফাউল প্লে করেনি, ট্যাক্টিফুলি খেলেছে!’
এমনকি রামনবমীর মিছিল থেকে যেভাবে অশান্তি ছড়িয়েছে তাকে লঘু করে দেখার জন্য ঘটনাগুলিকে মুখ্যমন্ত্রী দুষ্কৃতীদের মধ্যে গোলমাল বলে এদিন চালানোর চেষ্টা করেছেন।
‘‘যেটা হয়েছে সেটা কোনো ধর্মীয় গোলমাল নয়। পুরোপুরি দুষ্কৃতীদের গোলমাল। একজনও মারা যায়নি। কোনও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি,’’ জানিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। আবার পরক্ষণেই তিনি দাবি করেছেন, ‘‘পুলিশ ট্যাক্টফুলি খেলার পর আস্তে আস্তে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্য বিনিময় করে। এখন এলাকা শান্ত আছে।’’
Comments :0