UKRAINE WAR

বছর পেরিয়েও কেন থামছে না ইউক্রেন সংঘাত?
ব্যাখ্যা শান্তি আন্দোলনের নেতৃত্বের

আন্তর্জাতিক বিশেষ বিভাগ

ukraine war donbas nato russia ukraine usa bengali news aipso

২৪ ফেব্রুয়ারি এক বছরে পা দিয়েছে ইউক্রেন সংঘাত। ইউক্রেন কিংবা রাশিয়া- সংঘাত থামানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেনি কোনও পক্ষই। সোশ্যাল মিডিয়ায়, বিশেষত টেলিগ্রামে প্রতিদিন যুদ্ধের ফুটেজ চোখে পড়ছে। সেই ফুটেজ অনুযায়ী- মারিউপোল হোক কিংবা বাখমুট, কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

কিন্তু কেন দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের পথ বেছে নিচ্ছে দুই পক্ষ? কেনই বা তৃতীয় কোনও পক্ষ সংঘর্ষ থামানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না? এই প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছিল এদেশের শান্তি আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাছে। তাঁরা কী জানাচ্ছেন?

সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থা (এআইপিএসও)’র পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অঞ্জন বেরার অভিমত, ’’ইউক্রেন সংঘাতকে জটিল করে তুলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট।’’ 

ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সোভিয়েত রাশিয়াকে বাগে আনতে উত্তর অ্যাটলান্টিক অঞ্চলের দেশগুলিকে নিয়ে ন্যাটো তৈরি হয়। নর্থ অ্যাটলান্টক ট্রিটি অর্গানাইজেনের আদ্যক্ষর নিয়ে ‘ন্যাটো’। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান হলেও ন্যাটোকে ভেঙে ফেলা হয়নি। বরং উত্তর অ্যাটলান্টিক ছাড়িয়ে পূর্ব এবং দক্ষিণ ইউরোপ হয়ে এশিয়ায় পা ফেলেছে ন্যাটো। 

অঞ্জন বেরা বলছেন, ‘‘আমেরিকা চাইছে যুদ্ধের মাধ্যমে ইউক্রেন সমস্যার সমাধান করতে। ন্যাটোকে সামনে রেখে ইউক্রেনকে ঢালাও অস্ত্র সাহায্য করে চলেছে আমেরিকা। এই ভাবে সমস্যার নিষ্পত্তি করা যায় না। করা সম্ভব নয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ন্যাটোর তরফে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করা হচ্ছে। যারা প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলের হামলাবাজির দৃঢ় সমর্থক, তাঁরা আজ ইউক্রেনে এসে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলছে কেন, সেটা বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।’’ 

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ইউক্রেন সংঘাত শুরুই হয়েছে ন্যাটোর আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে। ২০১৪ সালে আমেরিকার মদতে ইউক্রেনে নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়া হয়। নতুন সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোয় যোগদানের ইচ্ছাপ্রকাশ করে। ইউক্রেন ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার অর্থ, রাশিয়ার দোরগোড়ায় ন্যাটো ছাউনি স্থাপন। এই মুহূর্তে ন্যাটোর ঘোষিত তিন প্রধান প্রতিপক্ষ হল  রাশিয়া, চিন এবং ইরান। স্বাভাবিক ভাবেই রাশিয়া এই তৎপরতা ভালো ভাবে নেয়নি। এবং সেখান থেকেই যাবতীয় গন্ডগোলের সূত্রপাত।

এই প্রসঙ্গে অঞ্জন বেরা বলেন, ‘‘ন্যাটো সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন করে ইউরোপের অস্ত্র বাজার ধরতেও মরিয়া আমেরিকা। এই চক্রান্তের একটা ধাপ হল রাশিয়াকে ঘিরে বলয় তৈরি করা। বর্তমান বিশ্বে নতুন করে ন্যাটোর সম্প্রসারণের কী প্রয়োজন? কিন্তু তারপরেও আফগানিস্তান অবধি ন্যাটোকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ন্যাটোর সম্প্রসারণ বিশ্ব জুড়েই শান্তি স্থাপনের পথে সব থেকে বড় বাধা। ন্যাটোর আগ্রাসনের প্রশ্নের মীমাংসা না করে পশ্চিমী দেশগুলো ইউক্রেন সঙ্কটের সমাধান চাইছে। সেটা তো হয় না। এদের আসল লক্ষ হল রাশিয়ার দখল নেওয়া। সেই কারণেই এই যুদ্ধ মিটছে না। এবং গোটা বিশ্বকে পারমাণবিক বিপদের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’’

তাহলে সমাধান কী?

শান্তি আন্দোলনের নেতৃত্বের মতে, শান্তি স্থাপনের জন্য মূলত দুটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। প্রথমত, ন্যাটোর সম্প্রসারণ আটকাতে বিশ্বজুড়ে জনমত গঠন প্রয়োজন। অপরদিকে রাশিয়ার উপরেও যুদ্ধ থামানোর জন্য চাপ বাড়াতে হবে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে উগ্র রুশ জাত্যাভিমান কাজ করছে। সেই হাওয়ায় ভর করে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন এলাকা দখলের কথা বলছে। পুতিন সরকার বিভিন্ন সোভিয়েত ‘ইমেজারি’ ব্যবহার করলেও লেনিনের সমালোচনাও করছে সমান তালে। কারণ লেনিন ১৯১৭ সালে ইউক্রেনের স্বায়ত্ব শাসনের কথা বলেছিলেন।  এই সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান চাইলে সেই উগ্রতাও দূর করতে হবে। 

এআইপিএসও’র  সর্বভারতীয় নেতা রবীন দেবের কথায়, ‘‘সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করা শান্তি আন্দোলনের মূল শর্ত। বর্তমানে নব্য ফ্যাসিস্টরা ইউক্রেন জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এবং ন্যাটো তাকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।  তাঁরা পশ্চিমী দেশগুলির থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো-বাইডেন নিজে সেখানে গিয়ে তাঁদের মদত যোগাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছেপ্ররোচনা তৈরির ক্ষেত্রে তাঁরা কোনও ভাবেই পিছপা হবেনা।’’ 

রবীন দেব মনে করাচ্ছেন যে এ রাজ্যে ন্যাটোর বিরোধিতায় এবং ইউক্রেনে শান্তি স্থাপনের দাবিতে সবার প্রথমে পথে নামে এআইপিএসও। তাঁর বক্তব্য, ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে মেটানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু ন্যাটোর পরিধি বিস্তারের জন্য যুদ্ধ চাপানো হয়েছে। তিনি বলছেন, ‘‘স্বাভাবিক ভাবেই তাতে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে। হুমকি পালটা হুমকি চলছে। জটিলতা বাড়ছে। সারা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের মূল শত্রু আমেরিকা। প্যালেস্তাইনে আমেরিকা যা করছে, এখানেও তাই করছে।’’ 

২০১৪ সালে ইউক্রেনে পালাবদলের পর থেকেই রুশ, রোমানিয়ান এবং হাঙ্গেরিয়ান সংখ্যালঘুদের উপর উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলির আক্রমণ শুরু হয়। পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ইউক্রেনের ট্রান্স কার্পেথিয়ায় এই আক্রমণ সর্বাত্মক। একইসঙ্গে ইউক্রেনে নিষিদ্ধ করা হয় কমিউনিস্ট পার্টিকে। আমূল বদলে ফেলা হয় সেদেশের সংবিধানকে। 

এই প্রসঙ্গ তুলে ধরে রবীন দেব বলছেন, ‘‘যেখানে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আক্রান্ত, সেখানেই সাম্রাজ্যবাদের বিস্তার ঘটে। ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। আলোচনার চেষ্টা না করে বলা হচ্ছে যুদ্ধের মাঠে জয় ছিনিয়ে আনব। পশ্চিমী দুনিয়া কথায় কথায় নব্য ফ্যাসিবাদের বিরোধিতার কথা বলে। অথচ, অ্যাজভ ব্রিগেডের মতো ঘোষিত নব্য ফ্যাসিস্ট খুনে বাহিনীর হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে। এই অ্যাজভ ব্রিগেড ডনবাস জুড়ে রুশ ভাষাভাষী সংখ্যালঘুদের উপর গণহত্যা চালিয়েছে। রুশ ভাষাভাষী মানুষের স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’’ 

ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের মূল বীজমন্ত্র লুকিয়ে রয়েছে ন্যাটোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার প্রশ্নে। ন্যাটোর একছত্র আগ্রাসনের মানে আফগানিস্তান জানে। আরব ভূমিখন্ডেরও সেই অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইউক্রেনের পক্ষেও সেটা বিরাট বিপদ। গোটা ‘গ্লোবাল সাউথের’ সেই অভিজ্ঞতা রয়েছে বলেই ইউক্রেন প্রশ্নে তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলি পশ্চিমী ভাষ্যে বিশ্বাস রাখতে পারছে না। 

২৫ ফেব্রুয়ারি ওয়েবসাইট ‘নিউজ ক্লিক’-এ ইউক্রেন যুদ্ধ সংক্রান্ত নিবন্ধ লেখেন আন্ত্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ বিজয় প্রসাদ। কেন উন্নয়নশীল দেশগুলি আমেরিকার পক্ষ নিয়ে রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে না রাষ্ট্রসঙ্ঘে, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।

প্রসাদের কথায়, ‘‘এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলি কোনও না কোনও সময় পশ্চিমী আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। তাই এখন পশ্চিমী দেশগুলির থেকে আগ্রাসনের ‘গ্রামার’ শিখতে রাজি নয় তাঁরা। আমেরিকা সহ পশ্চিমী দেশগুলি চাইছে ইউক্রেন প্রশ্নে তাঁদের রাশিয়ার থেকে সরিয়ে আনতে। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে তাঁদের বিকাশের সুবিধা হবে। যেমন এই মুহূর্তে রাশিয়া থেকে সস্তায় খনিজ তেল কিনছে একটা বড় অংশের উন্নয়নশীল দেশ। তাই নামিবিয়া হোক কিংবা ভারত, ইউক্রেন প্রশ্নে কাঙ্খিত সাফল্য মেলেনি আমেরিকার কূটনীতিকদের। 

আমেরিকা রাষ্ট্রসংঘে একাধিকবার ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ‘গ্লোবাল সাউথের’ সমর্থন না মেলায় সেই চেষ্টা সফল হয়নি। 

শান্তি আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতাকে মানতে হবে আমেরিকাকে। সেই অনুযায়ী রাস টানতে হবে নিজেদের আগ্রাসনে। বসতে হবে আলোচনার টেবিলে। তাহলেই মিলবে সমাধানসূত্র। থামবে যুদ্ধের দামামা। 

Comments :0

Login to leave a comment