Editorial

ডিজিটাল জালিয়াতির সুদিন

সম্পাদকীয় বিভাগ

মানুষের জীবন-জীবিকার সর্বক্ষেত্রে আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রয়োগ দুরন্ত গতিতে বাড়ছে। বিশেষ করে টেলি-কমিউনিকেশন প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি জীবনের অনেক কিছুকেই দ্রুত বদলে দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত আসা নতুন নতুন আবিষ্কার মানুষের কাজের গতি, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। জটিল ও কঠিন কাজ সহজ করে দিচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত ও সহজ করছে। ঘরে বসেই পরিষেবা মিলছে সহজে। ব্যাঙ্কে না গিয়েও, নগদ টাকা ছাড়াই যাবতীয় লেনদেন করা যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। ডিজিটাল প্রযুক্তি অভাবনীয় বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে সমাজ-সভ্যতার অভ্যন্তরে। প্রশ্ন হলো সকলেই কি এর সমান সুবিধা ভোগ করতে পারছেন? অবশ্যই না।
প্রযুক্তি যতই উত্তম হোক না কেন সেটাতে সড়গড় না হলে উপকারের থেকে অপকার বেশি হবার আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সেটা বিড়ম্বনারও কারণ হতে পারে। মোবাইল, ডিজিটাল, কার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাঙ্কের কাজ অর্থাৎ আর্থিক লেনদেন নিঃসন্দেহে দারুণ ব্যবস্থা। কিন্তু তার সুযোগ নিতে হলে এই ব্যবস্থার সাধারণ জ্ঞান জানা দরকার। ব্যবহারে সড়গড় হওয়া দরকার। নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান, ধ্যানধারণা তৈরি না করে যদি চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে পদে পদে তাদের হোঁচট খেতে হয়। অথবা অন্যের উপর নির্ভর করতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হতে হয়। তেমনি নতুন প্রযুক্তি চালু করে বাহবা কেনা যত সহজ ততটাই কঠিন সেই প্রযুক্তি নিখুঁত এবং নিরাপদ রাখা।
ব্যাঙ্কে প্রচলিত চেক বা নগদ লেনদেনের ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষ ওয়াকিবহাল। এই ব্যবস্থায় প্রতারণা-জালিয়াতি থাকলেও তার ব্যাপকতা ততটা ছিল না। এখন ডিজিটাল বা অন লাইন লেনদেন চালু হবার পর দিনদিন প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা হু হু করে বাড়ছে। পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহকের এবং ব্যাঙ্কের বিপুল টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তথা কেন্দ্রীয় সরকার অনেক কথা বললেও কিছুই ঠেকাতে পারছে না।
আসলে কেউ যদি মনে করে গোরুর গাড়িতে হেডলাইট লাগিয়ে সেটাকে মোটর গাড়ির মতো করে ফেলবে সেটা যেমন হয় না, তেমনি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি না করে তার পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে যদি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি চালু করে তার সুফল মেলে না। মোদী সরকার টাকার ব্যবহার কমাতে এবং গ্রাহকদের বাড়তি সুবিধার কথা বলে ব্যাঙ্ক ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছে হঠাৎ করে। কিন্তু সেই ব্যবস্থার অ আ ক খ-ও জানা নেই দেশের অধিকাংশ মানুষের। ফলে পদে পদে বিড়ম্বনার এক শেষ। তার সুযোগ নিয়ে আসরে নেমে পড়ে ডিজিটাল জালিয়াতরা। ডিজিটাল ব্যবস্থা যত প্রসারিত হচ্ছে ততই বাড়ছে জালিয়াতির ঘটনা। ডিজিটাল প্রতারণায় বহু সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন।
সরকারি হিসাব বলছে ২০২২-২৩ সালে নথিভুক্ত জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ২০ লক্ষ এবং তাতে লোপাট হয়েছে আড়াই হাজার কোটিরও বেশি টাকা। গত অর্থবর্ষে (২০২৩-২৪) জালিয়াতির ঘটনা এক লাফে বেড়ে হয়েছে ২৪ লক্ষ। জালিয়াতির ঘটনার সংখ্যার থেকে অনেক বেশি বে‍‌ড়েছে লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ। ৬৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। এই টাকার খানিকটা উদ্ধার হলেও বেশিটাই তামাদি হয়ে গেছে। সর্বনাশ হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকের। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাঙ্কও। বুলেট ট্রেন অবশ্যই ভালো। কিন্তু তারজন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। ডিজিটাল ব্যবস্থার নিরাপত্তাও সেভাবে গড়তে হয় যাতে জালিয়াতি শূন্যের কাছাকাছি নামানো যায়। কিন্তু সরকার বাহবা কুড়ানোয় অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নিরাপত্তাকে সর্বাধিক ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার চরম মূল্য দিতে হচ্ছে মানুষকে।

Comments :0

Login to leave a comment