Shonibar

বছর শেষ, লড়াইয়ের নতুন শুরুয়াৎ

ফিচার পাতা

কলতান দাশগুপ্ত

২০২৪ শেষ হতে চলল। সমাজের ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই বছরটা। এই বছর উগ্র দক্ষিণপন্থার আস্ফালন দেখেছে। জ্বলতে দেখেছে সিরিয়ার জনপদ, অস্থিরতা দেখেছে মধ্যপ্রাচ্যে। আবার প্রবল প্রতিবাদের নয়া দৃষ্টান্তও হাজির করেছে। বিজেপি’র দর্প চূর্ণ দেখেছে, আবার সম্ভল সহ দেশের নানা জায়গায় মানবিকতার উপর, ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আক্রমণও দেখেছে। এই বছর দেখেছে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের আক্রান্ত হতে।
একটি বছর সাক্ষী হয়েছে দেশের বামপন্থী আন্দোলনের দুই অসামান্য নেতা, কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি, কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর প্রয়াণ। প্রয়াত হয়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।

ইনসাফ যাত্রা থেকে জনগণের ব্রিগেড: 
বছরের শুরু হয়েছিল যৌবনের ডাকে জনগণের ব্রিগেড দিয়ে। ২০২৩ সালের শেষ ৫০ দিন কোচবিহার থেকে কলকাতা পর্যন্ত ইনসাফের দাবিতে টানা ৫০ দিনের পদযাত্রা করেছিল যুবরা। যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থায়ী চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন, ১০০ দিনের কাজ করে টাকা হাতে পাওয়ার স্বপ্ন, জাতপাতের বদলে গরম ভাতের কথা জিতে যাওয়ার স্বপ্ন বাংলার নতুন প্রজন্মকে দেখতে শিখিয়েছিল এই ইনসাফ যাত্রা। ২০২৪ সালের শুরুতে প্রশাসনিক নানা বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে যৌবনের ডাকে জনগণের ব্রিগেড হয়েছিল কলকাতায়। যে ব্রিগেড আমাদের সাহস জুগিয়ে ছিল লড়াইয়ের।

বৈষম্য বেড়েছে:
পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আরও তীব্রতর হয়েছে এই বছরে। একটি হিসাব থেকে আমরা জানতে পারি যে ক্রয় ক্ষমতার বিচারে দুনিয়া জুড়ে শ্রমিকদের মোট মজুরি ২০০৪ সালে যা ছিল ২০২৪ সালে তা প্রায় ২.৪ লক্ষ কোটি ডলার কমে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালে বিশ্বে ১০০ কোটি ডলার বা তার বেশি সম্পত্তির মালিক ছিলেন ২৬৬৮ জন, ২০২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৭৮১।

উগ্র দক্ষিণপন্থা এবং শ্রীলঙ্কা:
গোটা দুনিয়া জুড়ে বেকারি, ক্ষুধা ও দারিদ্র বাড়ছে ব্যাপকভাবে। এই সমস্যাকে ধামাচাপা দিতে দেশে দেশে নানা পরিচিতি সত্তাকে ব্যবহার করে উগ্র দক্ষিণপন্থা মাথাচাড়া দিচ্ছে। ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, সুইডেন, আর্জেন্টিনা, নেদারল্যান্ডে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি সংসদে শক্তি বাড়িয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এই প্রথম সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। তবে এর উলটো চিত্র আমাদের সামনে রয়েছে। কলম্বিয়া ও ব্রাজিলে দক্ষিণপন্থী শক্তিকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কায় এই প্রথম একজন বামপন্থী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

মধ্য প্রাচ্যে আশঙ্কা:
নাটকীয় রাজনৈতিক পালাবদলে সিরিয়ায় ক্ষমতার হাত বদল হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার ও সমাজতন্ত্রের একটি মডেলের অন্যতম প্রয়োগ ক্ষেত্র সিরিয়ার বুকে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটিয়ে মার্কিনী ঘনিষ্ঠ মৌলবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার জাল বিস্তার করা হয়েছিল বহুদিন ধরেই। প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতার পক্ষে সিরিয়া তীব্র লড়াই দিয়েছিল। সিরিয়ায় আসাদ সরকার বিরোধীদের অন্যতম মদতদাতা ছিল ইজরায়েল। ২০১৯ সালে ইজরায়েলের সেনাবাহিনীর তরফ থেকে জানা গিয়েছিল যে তারা সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র সরবরাহ করছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেও তীব্র লড়াই করেছিল সিরিয়ার সরকার। ২০১১ সালে তথাকথিত 'আরব বসন্ত' শুরু হওয়ার পরেই সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তনের চক্রান্ত শুরু হয়। ২০১৫ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি খবর থেকে জানা যায় যে সিআইএ সিরিয়ার বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বছরে এক বিলিয়ন ডলার খরচ করছে। পশ্চিমী দেশগুলোর চাপিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং তেলের খনির ওপর মার্কিন দখলদারির জন্য সিরিয়া আর্থিকভাবে যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমেরিকা, তুরস্ক ও ইজরায়েলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সিরিয়াতে বিরোধী জোট ক্ষমতা দখল করেছে। অতীতে পশ্চিম এশিয়ার নানা দেশে এই ধরনের রাজনৈতিক পালাবদলের পরে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছিল। সিরিয়ার ক্ষেত্রেও সেটার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।  

ইজরায়েল ভয়ঙ্কর:
বিশ্বজুড়ে একাধিপত্য কায়েমের লক্ষ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়া জুড়ে বিভিন্ন অংশে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল নিয়ে চলেছে। এই বছরের শুরু থেকে এই লেখা শেষ হওয়া পর্যন্ত সময় প্যালেস্তাইনের উপর ইজরায়েল লাগাতার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ৪০ হাজারের বেশি মানুষ এই আক্রমণের ফলে নিহত হয়েছেন, লক্ষাধিক মানুষ আহত এবং কত মানুষের দেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে রয়েছে তা বলা কঠিন। প্যালেস্তাইনের স্কুল, হাসপাতাল ও শরণার্থী শিবিরগুলোতে লাগাতার হামলা চলছে। পৃথিবীর বহু দেশের লাখো মানুষ এই হত্যা লীলার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। সেই জনমতকে উপেক্ষা করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইজরায়েলকে সরঞ্জাম সহ সব ধরনের সাহায্য করে চলেছে। মানবাধিকার রক্ষা ও গণহত্যা বন্ধের রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রস্তাব ও উপেক্ষা করেছে ইজরায়েল।

‘৪০০’ আটকে গেলো মানুষের ‘ইন্ডিয়া’য়:
কৌশল আলাদা হলেও আমার দেশের শাসক শ্রেণিও মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে অদ্ভুতভাবে নিশ্চুপ। ২০১৪ সালে বিজেপি এর ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গুরু দক্ষিণপন্থার উগ্র দক্ষিণপন্থার বিপদ বেড়েছে আমাদের দেশে এ বছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে ৪০০ আসন পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল বিজেপি। সেই লক্ষ্যে তীব্র সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, প্রতিটি কাজের ক্ষেত্রে উচ্চবর্ণ হিন্দুত্বের আস্ফালনের প্রচার করা হয়েছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল যে একটি মন্দির উদ্বোধনের দিনটাই আসলে দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা দিবস। আরএসএস, বিজেপির সর্বগ্রাসী আক্রমণের হাত থেকে দেশের মানুষকে, সংবিধানকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়া মঞ্চ। তবে সরকার গঠন করেই ‘এক দেশ এক ভোট’ বিল পেশ করেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। যা দেশের সংবিধানের ভাবনারই পরিপন্থী। বামপন্থীরা সহ বিরোধীরা সোচ্চারে এর প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। দেশের মানুষের লড়াইয়ের ফলেই বিজেপি এই নির্বাচনে লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ৪০০ পার তো করতে পারেইনি, এমনকি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও লাভ করতে পারেনি। লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বামেদের ফল আশানুরূপ হয়নি।

আর জি কর: সংগ্রামের মাইলস্টোন

প্রয়াত কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শেষ যাত্রায় হাঁটার সময়ই আর জি কর হাসপাতালের অভ্যন্তরে এক ডাক্তারি ছাত্রীর ওপর নির্মম নির্যাতন ও খুনের ঘটনার খবর পাওয়া যায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর দেহ দানের পর আমরা, বামপন্থী ছাত্র-যুব আন্দোলনের কর্মীরা পৌঁছে যাই আর জি করের পুলিশ মর্গের বাইরে। ছিল এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ। হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় এক ডাক্তারের নির্যাতন ও মৃত্যু, অথচ সেখানে যে উত্তেজনা হওয়ার কথা ছিল সেটা নেই। আমাদের সন্দেহ সেখান থেকেই শুরু হয় যে এটা স্রেফ নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা নয়। এর পিছনে বড় কিছু আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শববাহী গাড়িতে করে হাসপাতালের ভিতর থেকে দেহ নিয়ে ছুটে পালাতে যায় পুলিশ। আমরা আটকানোর চেষ্টা করি, পরিবারের সাথে কথা বলতে চাই। পুরুষ পুলিশ দিয়ে মহিলা কর্মীদের আক্রমণ করিয়ে, কার্যত গ্রিন করিডর করে গাড়ি চালিয়ে দেহ নিয়ে পালায় পুলিশ। রহস্য ক্রমাগত ঘনীভূত হতে থাকে। বিভিন্ন মানুষ নিজেদের মতো করে নির্যাতিতার বিচারের দাবিতে পথে নামতে থাকেন। প্রশাসন এই ঘটনাটিকে যথেষ্ট সংবেদনশীলভাবে দেখার পরিবর্তে নানান দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করতে থাকেন ঠিক যে ধরনের মন্তব্য কামদুনি, পার্ক স্ট্রিট, হাঁসখালি, ধূপগুড়ি,  হাথরস, উন্নাওয়ের সময় করা হয়েছিল। আর জি করের কলেজের প্রিন্সিপালের নাটকীয় পদত্যাগের পরপরই তাকে পুরষ্কার হিসাবে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের সুপার করা হয় প্রশাসনের শীর্ষস্তরের নির্দেশে। রাজ্যের এবং দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের ক্ষোভ বাড়তে থাকে। তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে আর জি করের ঘটনাকে ক্রমাগত হালকা করে দেখানোর চেষ্টা এই ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে ১৪ আগস্ট মেয়েদের ‘রাত দখল’ -এর কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এই রাত দখলের কর্মসূচি শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে গ্রামে, গঞ্জে, মফস্বলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এতটাই ছিল যে রাজ্য ও দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের বহু জায়গাতেও আর জি করের ঘটনা প্রতিবাদে রাত দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৪ তারিখ রাতে গোটা রাজ্যজুড়ে, দেশজুড়ে এবং বিদেশেও কত মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন তার আক্ষরিক হিসাব করা দুষ্কর। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ যে প্রশাসনকে কার্যত নাড়িয়ে দিয়েছিল। কয়েক লক্ষ মানুষ যখন মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল নির্যাতিতার ন্যায় বিচারের দাবিতে তখন একদল দুষ্কৃতী হাসপাতালের মধ্যে ঢুকে ভাঙচুর করল। প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় হাসপাতালে ঢুকে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। এই হাসপাতাল ভাঙচুরের ঘটনায় এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেতৃত্বের একাংশের নামে সমন জারি করল পুলিশ। ধরপাকড় হলো। চাপ তৈরি করে এই আন্দোলনকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে, এই ছিল তৃণমূল সরকারের চক্রান্ত। ফল হলো উলটো। আরও অনেকে সাহস সঞ্চয় করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হলেন। সরকার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর নানা ফতোয়া জারি করলেন। গণআন্দোলনের চাপে ফতোয়া কার্যত উড়ে গেল। ফতোয়া জারি হয়েছিল ফুটবল মাঠেও। টিফোকে হাতিয়ার করে বহু খেলাতেই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে অথবা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন সাধারণ মানুষ। আন্দোলনের জোয়ারে ভয় পেয়ে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ বাতিল ঘোষণা করে প্রশাসন। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহামেডানের হাজার হাজার সমর্থক প্রতিবাদের ভাষ্য নিয়ে হাজির হন মাঠের সামনে। সরে পড়তে বাধ্য হয় পুলিশ। নির্যাতন মোকাবিলায় মহিলাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ তো আসলে পুরুষতান্ত্রিক এবং লিঙ্গবৈষম্যমূলক ভাবনা। এই ভাবনা তো আরএসএস পোষণ করে! মুখে আরএসএস বিরোধিতার কথা বলে কাজের ক্ষেত্রে একই ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেন? মাথার মধ্যে মনুবাদী চিন্তাভাবনা নিয়েই রাজ্য সরকার কাজ করে এই কথা আমরা বহুবার, বহুভাবে বলেছি।
নতুন স্লোগান রাজপথে:
স্বৈরাচারী শাসক তাদের ছাতার তলায় অপরাধীদের রেখে প্রতিবাদীদের যেভাবে আক্রমণ শুরু করলেন তাতে গণআন্দোলন এক অন্য মাত্রা নিল। প্রতিদিনই আমরা সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে নতুন করে এই গণআন্দোলনে শামিল হতে দেখছি। এই আন্দোলনের স্লোগান এতটাই সাধারণ মানুষকে নাড়া দিয়েছে যে যিনি হয়তো গতকাল পর্যন্ত রাস্তায় নামেননি তিনিও আজকে পথে নেমে ন্যায় বিচারের দাবির লড়াইতে শামিল হয়েছেন। বহু নতুন স্লোগান এই আন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে এসেছে যা অতীতে আমরা কখনো শুনিনি। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল করা যাবে না এই ফতোয়ার পালটা হিসাবে স্লোগান উঠেছিল,‘‘সব ক্লাসে বলে দিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস!’’  ফুটবলের বড় ম্যাচ বাতিল হওয়ার পর রাস্তাজুড়ে হাজারো জনতার সম্মিলিত স্লোগান ছিল,‘‘বাঙাল ঘটি একটাই স্বর, জাস্টিস ফর আর জি কর।’’ মফস্বলের এক স্কুলপড়ুয়া তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে স্লোগান দিচ্ছে,‘‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে হবে...পথে নেমে লড়তে হবে!"এই হাজারো মানুষের লড়াইকে ভয় পেয়েই রাষ্ট্র ষড়যন্ত্রের জাল বিছাতে থাকে। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা হয় একাধিক বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীকে।
‘সেটিং’ যখন: 
একদিকে সেন্ট্রাল ফরেনসিক সাইন্স ল্যাবরেটরির দেওয়া তথ্য-প্রমাণকে আড়াল রেখে সিবিআই তাদের তদন্তের চার্জশিট জমা দেয়। অপরদিকে আর জি করের ঘটনা প্রবাহ চলাকালীন নানান দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতারা একের পর এক জামিনে ছাড়া পেতে থাকেন। যার ফলে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে থাকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বোঝাপাড়া নিয়ে। ইতিমধ্যে আরএসএস নেতা মোহন ভাগবত ঘোষণা করেন যে আর জি করের ঘটনায় রাজ্য সরকার যা পদক্ষেপ নেবে তারা তার পক্ষেই দাঁড়াবেন। এরপর থেকে বিজেপি’র নেতারা ক্রমাগত আর জি করের ঘটনায় হয়ে চলা ডাক্তারদের আন্দোলনকে তীব্র কটাক্ষ করতে থাকেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের আন্দোলন আজও চলমান। এই সুবিধা পাওয়ার হিসাবে তৃণমূল সংসদে আদানির দুর্নীতি ইস্যুতে পরোক্ষে বিজেপি’র সুবিধা করে দেয়। সংসদ ভবনে বিতর্ক চলাকালীন অমিত শাহ আম্বেদকর সম্পর্কে অপমানজনক উক্তি করেন। গোটা দেশের মানুষ তার পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হন।

বাংলাদেশ: এক শিক্ষা

আর জি করের ঘটনার সময়কালেই আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ উত্তপ্ত হতে থাকে। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে অন্যদিকে মোড় নিতে থাকে। গত আগস্ট মাসে পার্টির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানকার সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ সেই সময়ই পার্টির পক্ষ থেকে করা হয়েছিল। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর থেকে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণকে ব্যবহার করে আমাদের দেশেও নতুন করে মানুষ ভাগের রাজনীতি করার চেষ্টা চালায় আরএসএস বিজেপি। এক ধর্ম গুরুর গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে বাংলায় ধর্মীয় ভাগাভাগির তীব্র চেষ্টা চালাতে থাকে বিজেপি। তৃণমূল এক্ষেত্রে আপাত নীরবতা অবলম্বন করে কারণ বিজেপি’র বিরুদ্ধে বেশি কথা বললে নিজের দলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের জামিন পাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। মজা হলো, বাংলাদেশে ধর্মগুরু গ্রেপ্তার হয়েছেন দেশদ্রোহীতার অভিযোগে। ভারতেও চলমান কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বকে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল বিজেপি যারা বাংলাদেশে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ নিয়ে প্রতিবাদ করছে। উমর খালিদকে দেশদ্রোহীতার অভিযোগে বছরের পর বছর জেলবন্দি করে রেখেছে যে বিজেপি তারা কিভাবে বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবাদ করতে পারে? সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার লড়াইতে বামপন্থীরা সমানভাবে আছে। বর্তমান সময়ে ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ ভারতীয় উপমহাদেশে শাসকের হাতে চমৎকার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
শাসকের এই অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ছেন গোটা বিশ্বের প্রান্তিক মানুষেরা। আমাজন কোম্পানির শ্রমিকদের বিক্ষোভ, ব্রিটেনে শ্রমিক বিক্ষোভ, তামিলনাড়ুতে স্যামসাং কোম্পানিতে শ্রমিক বিক্ষোভ বা বাংলায় চলমান গণআন্দোলন আদতে প্রতিরোধের দেওয়াল গড়ে তুলেছে।

 

Comments :0

Login to leave a comment