Braille map for the visually impaired

যাদবপুরে দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল মানচিত্র

কলকাতা রাজ্য

রিঙ্কি দাশ


যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ব্রেইল মানচিত্র তৈরি করেছেন। এই প্রকল্পে দৃষ্টিহীনদের সহায়তা তো হবেই, সেই সঙ্গে গোটা সমাজকে ভাবনার জগতে আশার আলো দেখাচ্ছে বলেই মনে করছেন প্রতিবন্ধীদের সমানাধিকারের দাবিতে সোচ্চার সমাজকর্মীরা। 
আমরা যখনই কোনও সাজানো ঘর, মিউজিয়ামে বা পুজো প্যান্ডেলে যাই, বলা হয় ছোঁবেন না, স্পর্শ করবেন না। অনুধাবনের জন্য যাদের দৃষ্টিশক্তি রয়েছে তাদের ছোঁয়ার দরকার হয় না, কিন্তু যারা দৃষ্টিহীন তাঁরা তো স্পর্শের মধ্য দিয়েই চেনেন, জানেন, বোঝেন। তাহলে যারা দৃষ্টিহীন তাদের ওপরে বাকিদের নিয়ম চাপিয়ে দেওয়া কেন? কেন তাদের অনুধাবনের জন্য স্পর্শযোগ্য ব্যবস্থাপনা থাকবে না? সংখ্যায় তাঁরা তুলনামূলকভাবে কম বলে কি অধিকার থেকেও তাঁরা বঞ্চিত থাকবেন?
দৃষ্টিহীন বলে ছাত্রাবস্থায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঈশান চক্রবর্তীকে ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরার জন্য সাহায্য নিতে হয়েছিল একজন সহচরের। এই প্রাঙ্গণকে জানতে এবং বিভিন্ন বিভাগের অবস্থান সম্পর্কে ধাতস্ত হতে তাঁর সময় লেগেছিল দীর্ঘদিন। তবে সেটা এখনও সম্পূর্ণরূপে নয়।  প্রতিবন্ধী বলে তাঁদের অনেক কিছু  মানা। কিন্তু তা তো হবার কথা নয়। সমানাধিকারের কথা তো সংবিধান স্বীকৃত। কিন্তু তাদের বেঁচে থাকাটাই ভীষণ এক লড়াই। প্রতিবন্ধীদের অবস্থার উন্নতি এবং তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শ্রুতি ডিসএবিলিটি রাইট সেন্টারের শম্পা সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘প্রতিবন্ধী বলে তো নিজের পরিবারই মেরে ফেলছে শিশুকে, সেখানে সমাজের কাছে বেশি কি আশা করা যায়!’’ কিন্তু এই সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যেও আশার আলো দেখায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই পড়ুয়ার নেওয়া অভিনব উদ্যেগ।  
ক্লাসের প্রজেক্ট হিসাবে যাদবপুরের দুই শিক্ষার্থী প্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের ব্রেইল ম্যাপ। ইংরেজি স্নাতকোত্তরের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অস্ত্যর্থা দাস এবং রামেশ্বর চক্রবর্তী ‘ভারতীয় সাহিত্যে অক্ষম’ ঐচ্ছিক কোর্সের অংশ। এর তত্ত্বাবধানে ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক ঈশান চক্রবর্তী, যিনি নিজেও দৃষ্টিগত দিক থেকে প্রতিবন্ধী। তার শিক্ষার্থীদের এই অভিনব উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তিনি। তিনি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন ছাত্র। কিন্তু তিনি জানাচ্ছেন এই প্রথমবার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সম্পূর্ণরূপে  কল্পনা করতে পারছেন তিনি। কারণ ক্যাম্পাসের ম্যাপ যা ছিল, তা সাধারণদের জন্য। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের জানার ক্ষমতা তো ছুঁয়ে দেখার মধ্যেই নিহিত। কিন্তু সেই সুযোগ সব জায়গায় পাওয়াই যায় না। দৃষ্টিহীনদের সেই সুযোগ দেওয়ার বন্দোবস্ত যাদের করার কথা তারা হয়তো এই বিষয়টি নিয়ে ভাবেই না। আর এখানে ব্রেইল মানচিত্রে ঠিক উলটো, দৃষ্টিহীনদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, আসুন এবং ছুঁয়ে দেখুন, জানুন।’’ 
সম্পূর্ণরূপে হাতে বানানো ক্যাম্পাসের এই ব্রেইল ম্যাপ তৈরি করতে সময় লেগেছে দেড় মাস। এটিই বিশ্বের প্রথম হাতে বানানো ব্রেইল ম্যাপ। ৫ ফুট চওড়া এবং ৩.৫ ফুট একটি ঘাস বোর্ডে  স্ক্রু এবং কার্ডবোর্ড এবং বই বাঁধাই করার মোটা সুতো দিয়ে ব্রেইল এবং ট্যাকটাইল ম্যাপটি তৈরি করেছে তারা। ম্যাপে রয়েছে ব্রেইল হরফ বোঝার জন্য ছাপানো নির্দেশনাও, কাজেই কেবল দৃষ্টিহীন না সাধারণ মানুষও অনুধাবন করে দেখতেই পারেন। নভেম্বরের শেষদিকে  ক্যাম্পাসের ৪ নম্বর গেটের সামনে লাগানো হয় ম্যাপটি। গোটা ম্যাপটি আসলে দুটি ভাগে বিভক্ত, একদিকে আছে সূচি এবং অন্যদিকে রয়েছে ম্যাপ। এতে অন্যান্য সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর মতোই দৃষ্টিহীনরাও সমগ্র ক্যাম্পাসের বিভিন্ন রাস্তা, ক্লাস, বিভাগ, ঝিল, ক্যান্টিন এবং অফিসের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাবে।
‘‘এই পদক্ষেপকে আমরা দৃষ্টিহীনদের একপ্রকার ক্ষমতায়ন হিসাবে দেখি। কারণ ক্যাম্পাসে ৪০টির বেশি বিল্ডিং রয়েছে, কিন্তু কোন  কোন বিল্ডিং-এর পাশে, কিংবা কোন রাস্তা দিয়ে সেখানে যাওয়া যাবে সে সম্পর্কে এখনও সঠিক ধারণা পাওয়া যাবে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে আমাদের যদি কেউ ক্যান্টিনের রাস্তা জিজ্ঞেস করে তাহলে আমাদের মুখ কাঁচুমাচু করে বলতে হবে না, যে আমরা বলতে পারবো না, কারণ আমরা দৃষ্টিহীন।’’ মুখে প্রশস্তি নিয়ে জানালেন এক শিক্ষার্থী। 
প্রতিবন্ধকতার কারণে প্রান্তিকদের অন্তর্ভুক্তিমূলক এমন একটি উদ্যোগ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিয়েছেন বলে অধ্যাপক চক্রবর্তী অত্যন্ত গর্বিত। অধ্যাপক চক্রবর্তী মনে করেন এই উদ্যোগ কেবল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা রাজ্য নয় গোটা দেশের জনগণের মধ্যে প্রভাব ফেলবে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে  সাহায্য করবে। ‘‘আসলে আমরা তো সাধারণ দৃশ্যমান্যতা থেকে দুরে থাকি, আমাদের প্রান্তিক করে রাখা হয়। কাজেই এই ধরনের কাজ দৃশ্যমানতা তৈরি করছে, আমাদেরও একই সারিতে নিয়ে আসছে। পথ চলতি সাধারণ মানুষ যখন দেখছে তখন তারাও নিশ্চয়ই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। সমাজের সর্বত্রই দৃষ্টিহীনদের অধিকারের কথা নিশ্চয়ই সবাই আরও বেশি করে বুঝতে পারবেন।’’ এই ধরনের উদ্যোগ অবশ্যই সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে বলে মনে করছেন তিনি। 
এই কারণেই তিনি এমন ধরনের প্রজেক্টকে উৎসাহ দিয়ে এসেছেন। সমাজের প্রান্তিক অবহেলিত মানুষদের বাস্তবেই সাহায্য করবে এমন বিষয় নিয়ে ভাবতে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদেরও সবসময় উৎসাহ দিয়ে চলেছেন। ২০২০ সালেও তারই অধীনে ৬ জন শিক্ষার্থী প্রথম ব্রেইল গ্রাফিতি তৈরি করে তাক লাগিয়েছিল। তবে এ কথা ঠিক যে এই ব্যক্তিগত পদক্ষেপগুলি একটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকছে। তাঁর কথায়, তিনি নিজে যেহেতু দৃষ্টিহীন তাই সবসময় চান ছাত্র-ছাত্রীরা এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয় যে কাজ এই অংশকে সরাসরি এবং বাস্তবেই সাহায্য করতে পারে। এতেই অনুপ্রাণিত হয়ে পড়ুয়ারা ব্রেইল ম্যাপ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, তিনি হয়তো অনুপ্রাণিত করেছেন কিন্তু উদ্যোগের সমস্ত কৃতিত্বই ওই দুই পড়ুয়ার। তাকে যখন প্রথম ব্রেইল ম্যাপের কথা জানানো হয় তিনি নিজেও বিষয়টি নিয়ে অনিশ্চিত ছিলেন কিন্তু এই দু’জনের ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা তাকে মুগ্ধ করেছিল। শেষে যখন তিনি তাদের প্রজেক্ট দেখেন তখন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
তবে বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টিহীন অংশের মানুষ এমন সুবিধা থেকে এখনও বেশিরভাগ জায়গায় বঞ্চিত থাকেন। শম্পা সেনগুপ্ত মনে করেন, এর কারণ  সরকারের প্রচেষ্টার অভাব, সামাজিক সচেতনতার অভাব, দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবশ্যই অর্থের অভাব। তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা দেখি, আমাদের সাথে যেসব প্রতিবন্ধীদের যোগাযোগ হয় তারা আর্থিকভাবে অনেকটাই দুর্বল। তাদের  ক্ষমতা নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করার। এই কারণেই অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রতিবন্ধী ও লিঙ্গ বৈষম্য সংক্রান্ত নানা সমস্যা নিয়ে কাজ করছে এবং এই সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে। এই মুহূর্তে ভারতেই তিন হাজারের বেশি সংস্থা যারা প্রতিবন্ধীদের সহায়তা এবং অধিকার নিয়ে কাজ করছে। 
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি নানা আইন, নিয়ম এবং প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও এই ব্যক্তিগত উদ্যোগের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার প্রয়োজন কেন পড়ছে? সংবিধানে রয়েছে সাম্যের অধিকার, পিডবলিউডি’র অধীনে একাধিক ধারা আছে যেগুলি বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের সমানাধিকার এবং মর্যাদা প্রদান করে। সরকারি ক্ষেত্রে নানা ছাড় সহ বিভিন্ন ভাতা এবং অসংখ্য প্রকল্প রয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় ও রাজ্যগতভাবে প্রতিবন্ধীদের নানা অভিযোগ ও অন্যান্য বিষয়ে সহায়তার জন্য প্রতিবন্ধী কমিশন এবং কেন্দ্র গঠন করেছে সরকার। কিন্তু তার পরও ব্যাঙ্ক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানে তাঁদের বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়। ভিন্নভাবে সক্ষমদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টভঙ্গিও খুব সদর্থক নয়। বিশেষভাবে সরকার যখন এই অংশকে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার গাল ভরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এদের জন্য পরীক্ষায় অনুলেখকের ব্যবস্থা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আরবিআই’র নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা ‌আছে, কিন্তু ব্যাঙ্কে গিয়ে অধিকাংশ সময়ই সহযোগিতা পাওয়া যায় না। খুব সামান্য ভাতা দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না কিছুই। তাই সরকারকেই বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্যবস্থাপনার যে আইনবিধি বর্তমানে রয়েছে তা রূপায়ণ করতে হবে, পরিকাঠামো করতে হবে ও তার তদারকি করতে হবে, তার সঠিক প্রয়োগের দিকে নজর দিতে হবে এবং সঠিক সামাজিক দৃষ্টভঙ্গি তৈরিতেও উদ্যেগ নিতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment