আবদুল হালিম
‘‘বিপ্লবের আদর্শ ব্যতীত কোনও বিপ্লবী আন্দোলনই সম্ভবপর নয়। বিপ্লব হইতেছে ইতিহাসের গমনশীল যন্ত্র’’-লেনিন।
‘‘সঙ্কট যতই গুরুতর আকার ধারণ করে বুর্জোয়া শাসনও ততই ত্রাসবাদের রূপ পরিগ্রহ করে। প্রভুর বিরুদ্ধে যখন ক্রীতদাসগণ অভিযান শুরু করে তখন ধনিক-সমাজের সভ্যতা, ন্যায়বিচারের আসলরূপ প্রকাশিত হইয়া পড়ে তখন এই সভ্যতা ও ন্যায় সম্পূর্ণরূপে বর্বরতা এবং আইনসঙ্গত প্রতিশোধে রূপান্তরিত হয়।’’ - মার্কস।
১৯৩০ সালে ব্রিটিশ-সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতে গণ-আন্দোলনের যে উত্তালতরঙ্গ প্রবাহিত হইয়াছিল তাহাকে দমন করিবার জন্য ভারতের সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শাসকরা নগ্ন ত্রাসবাদের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। সত্যাগ্রহ আন্দোলন সাময়িকভাবে বন্ধ হইলেও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক আন্দোলন একদিনের জন্যও স্তব্ধ হয় নাই। শ্রমিক-শ্রেণির বৈপ্লবিক আদর্শকে রূপ দিবার জন্য বহু সংগ্রামশীল সংগঠন গড়িয়া উঠিয়াছিল। ১৯৩০ সালের গাড়োয়ান ধর্মঘট উপলক্ষে সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বলি হিসাবে আমি এক বছর কঠোর কারাদণ্ড ভোগের পর ১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসে খুলনা জেল হইতে মুক্তিলাভ করিয়া কলিকাতায় ফিরিলাম। মীরাটে কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্রের মামলার শুনানি তখনও চলিতেছে। ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতা দিবস পালন উপলক্ষে মিটিং মিছিল শোভাযাত্রা বন্ধ করিবার জন্য সাম্রাজ্যবাদী গভর্নমেন্ট নতুন করিয়া দমননীতি শুরু করিল। আমরা শ্রমিক নেতা ও কমিউনিস্ট কর্মীরাও সাম্রাজ্যবাদী ত্রাসবাদের আক্রমণ হইতে নিষ্কৃতি পাইলাম না। আমরা তিন সপ্তাহের জন্য বিচারাধীন বন্দি হিসাবে আলিপুর জেলে আটক রহিলাম। সত্যাগ্রহ-বন্দিরা তখনও জেলে আটক... লন্ডন গোল-টেবিল-বৈঠক বসিয়াছে।
ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে আলিপুর জেল হইতে ছাড়া পাইয়া মীরাটে কমিউনিস্ট বন্দিদের মামলা পরিচালনায় সাহায্য এবং তদবির করিবার জন্য আমি মীরাটে যাত্রা করিলাম। ১৯৩১ সালে করাচীতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন শেষ হইবার পর সত্যাগ্রহ আন্দোলনও বন্ধ হইয়া গেল। কিন্তু আমাদের চলার পথের শেষ কোথায়? কয়েক মাস মীরাটে অতিবাহিত করিয়া আমি জুলাই মাসে কলিকাতা ফিরলাম। শ্রাবণের প্রবল বর্ষণ-ধারায় কলিকাতার মানুষের জীবনস্রোতও প্রবাহিত। রাজনৈতিকগণ তমসাচ্ছন্ন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ক্রিয়াকাণ্ড তখনও চলিতেছে। কংগ্রেসের আন্দোলন মন্দীভূত হইয়াছে। শ্রমিক-আন্দোলন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী গভর্নমেন্টের প্রচণ্ড দমননীতির আঘাতে ভীষণভাবে পর্যুদস্ত হইলেও শ্রমিক শ্রেণি, মিল- মালিক ও সরকারি নীতির বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত।
আমাদের শ্রমিক সংগঠনগুলিও সাময়িকভাবে দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর প্রচণ্ড শক্তিশালী চটকল মজদুর ইউনিয়নের অফিস কোনও মতে টিকিয়া রহিয়াছে। সুতাকল, চটকল, ম্যাচ- ফ্যাক্টরি প্রভৃতি শিল্প প্রতিষ্ঠানের ধর্মঘটগুলি শ্রমিক- ইউনিয়নের নেতৃত্বে আমরা পরিচালনায় ব্যাপৃত। ‘‘শ্রমিক কৃষক দলের’’ অফিসটিও বন্ধ হইয়া গিয়াছে। বন্ধুরা কেহ কারাগারে, অনেকে আন্দোলন ত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। সারাক্ষণ গোয়েন্দা পুলিশের গুপ্তচরেরা পিছনে পিছনে ঘুরিতেছে। আমার খাওয়া- পরার কোও সংস্থান নেই; নিরাশ্রয় ও নিরুপায় হইয়া পথে পথে ঘুরিতেছি। কয়েকদিন ২৩ নম্বর হ্যারিসন রোডে ‘‘চটকল মজদুর’’ ইউনিয়ন অফিসে কমরেড আব্দুল মোমিনের সঙ্গে কাটাইলাম। কমরেড মোমিনের আর্থিক অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। শ্রমিক আন্দোলন পরিচালনার জন্য তিনি অর্থ সংগ্রহের চেষ্টায় ব্যস্ত। কিন্তু তাহাকে আর বেশি চেষ্টা করিতে হইল না। একদিন রাত্রে সিআইডি পুলিশ বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া চটকল মজদুর ইউনিয়নের অফিসে তালা লাগাইয়া দিল। কমরেড মোমিনের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গে চটকল মজদুর ইউনিয়নের কাজও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া গেল। মাঝে মাঝে ৭ নম্বর মৌলবী লেনে বন্ধু কুতবুদ্দীন আহমেদের বাড়ির বহিঃপ্রাঙ্গণে মুক্ত আকাশের তলে কঠিন লোহার বেঞ্চিতে রাত্রি যাপন করি। এই দুঃসময়ে আমার সহৃদয় বন্ধু শ্রী স্বরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (নেপু ঠাকুর) ৬ নম্বর দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনে তাঁহার নিজ বাড়িতে আমাকে কয়েক সপ্তাহ আশ্রয় দিয়া পরম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছিলেন। তাঁহার উপকার জীবনেও ভুলবো না। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের অত্যাচারে সেখানেও আর বেশিদিন টিকিতে পারিলাম না। তাহারা সর্বদাই পিছনে লাগিয়া রহিয়াছে: স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার এতটুকু উপায় নাই বিপ্লবের আদর্শই তখন আমার একমাত্র পাথেয়— এই সম্বলটুকু এবং মানসিক প্রেরণা, দৃঢ়তা ও শক্তি না থাকিলে জীবনের ইতিহাস বিপরীত খাতে প্রবাহিত হইত।
অবসাদগ্রস্ত মন, ক্লান্ত, শ্রান্ত দেহ, কোনোদিন আহার জোটে, কোনোদিন বা জোটে না, ব্যথা ভারাক্রান্ত মনে আমি চলার পথ খুঁজিতেছি। এই সময়েই ২৩ নম্বর হ্যারিসন রোডে কমরেড সোমনাথ লাহিড়ীর সহিত আমার প্রথম আলাপ হয়। অল ইন্ডিয়া ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন আরম্ভ হইয়াছে। বোম্বাই হইতে কমরেড দেশপান্ডে, রণদিভে প্রভৃতি আসিয়াছেন। আমরা- কমরেড বঙ্কিম মুখার্জি প্রমুখ বিখ্যাত শ্রমিক নেতৃগণ বাংলাদেশ হইতে অধিবেশনে যোগদান করিয়াছে। সুভাষচন্দ্র বসু সভাপতি। অ্যালবার্ট হল ও ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে কংগ্রেসের অধিবেশন হয়। আন্তর্জাতিক শ্রমিক নীতি সম্পর্কিত বিষয়, শ্রমিক শ্রেণির স্বতন্ত্র রাজনীতির ভূমিকার প্রশ্ন নিয়া বাদানুবাদ ও ভাঙ্গন দেখা দেয়। তাহাছাড়া ভারতের শ্রমিক আন্দোলনে সংস্কারবাদী শ্রমিক সঙ্ঘ ও বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে প্রচুর বিরোধ দেখা দেয় এবং ইহাকে উপলক্ষ করিয়া ট্রেড-ইউনিয়ন কংগ্রেস পুনরায় বিভক্ত হইয়া যায়। শ্রমিক আন্দোলনের নীতি ও পরিণতি সম্পর্কে কারান্তরে আলোচনা করিবার ইচ্ছা রহিল।
শরতের বর্ষণক্লান্ত একদিন সারাদিন অনাহারে কাটাইয়া সন্ধ্যায় ডিএম লাইব্রেরিতে বিক্রিত পুস্তকের মূল্যবাবদ কয়েক টাকা সংগ্রহ করিলাম এবং সেই অর্থে শিয়ালদহের এক রেস্তোরাঁয় কমরেড সোমনাথ ও আমি খাইয়া ক্ষুধা নিবৃত্ত করিলাম। কোথায় রাত্রি যাপন করিব ভাবিতেছি তখন কমরেড (ডাক্তার) অতুলচন্দ্র চন্দ্রের কথা স্মরণ হইল। কমরেড অতুলচন্দ্র ও নুর মোহম্মদকে আগে হইতেই চিনতাম। তাঁহারা শ্রমিক কৃষক দলের অফিসে যাতায়াত করিতেন। তাছাড়া প্রগতিশীল সাহিত্য সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁহাদের খুবই অনুরাগ ও আগ্রহ ছিল। 'সর্বহারা' নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনায় তাঁহারা যথেষ্ট আর্থিক সাহায্যও করিয়াছিলেন-কিন্তু উক্ত পত্রিকার পরিচালক বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি না হওয়ায় তাঁহার সংস্রব ত্যাগ করেন। কমরেড সোমনাথ ও আমি ৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটের ২৫ নম্বর কামরায় কমরেড অতুল চন্দ্র চন্দ্রের বাসায় বা মেসে হাজির হইলাম। শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটের ২৫ নম্বর কামরা চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে।
কমরেড অতুল তখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। তাঁহার সঙ্গে থাকিতেন ময়মনসিংহের হাতেম আলি খান। তিনি ছিলেন আইন কলেজের ছাত্র। তিনি আমাদের গুপ্ত পার্টি কমিটির সদস্য ছিলেন এবং আমাদের আর্থিক সাহায্যও করিয়াছিলেন। অল্প কিছুকাল পরে তিনি কলিকাতা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যান, কিন্তু একজন থাকিতেন-কমরেড নূর মোহাম্মদ। নদীয়া জেলায় শান্তিপুরের অধিবাসী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র এবং কমরেড অতুলের সহপাঠী। কমরেড নূর মোহাম্মদ ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ম্যানিনজাইটিস রোগে মারা যান। কমরেড অতুল, নূর ও হাতেম আলি-৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটের তিন তলায় ‘‘ঢাকা হাউসে’’ দুইখানি ঘরে থাকিতেন। খাওয়া-দাওয়ার জন্য একটি মেসও তাঁহাদের ছিল। আমরা একখানি ঘর অর্থাৎ ২৫ নম্বর কামরাখানি দখল করিয়া বসিলাম এবং রবাহুতের ন্যায় সেখানে মৌরসীপাট্টা গড়িলাম। কমরেড অতুল ও নূর আমাদের মার্কসবাদী ও প্রগতিশীল পত্রিকা প্রকাশ করিতে উৎসাহ দিলেন এবং তজ্জন্য ২৫ নম্বর কামরাখানি আমাদের হেপাজতে ছাড়িয়া দিলেন। পত্রিকা প্রকাশের জন্য আর্থিক সাহায্যও করিলেন। ৪১, নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিট, তিনতলা বাড়ি-নাম ‘‘ঢাকা হাউস’’ - বড়বাজার-হ্যারিসন রোড অঞ্চলে ‘‘ঢাকা-হাউসের’’ নামডাক আছে। এই ‘‘ঢাকা-হাউসকে’’ কেন্দ্র করিয়া আমাদের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজও শুরু হয় - সেই দিক হইতেও ৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটের নাম কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হইয়া থাকিবে। বাড়ির নিচের তলায় হোটেল। পাঞ্জাবী, কাশ্মীরি, বিহারী, বাঙালি প্রভৃতি লোকের বাস— মুটে, মজুর, দরিদ্র মেহনতি মানুষ, হরেক রকম লোকের আড্ডা। মানুষের হট্টগোল ও কোলাহলে বাড়িটি সারাক্ষণ কলরবমুখরিত। বাড়ির ভাড়াটিয়া কাশ্মীরি শালকর, পাঞ্জাবী আলোয়ান ব্যবসায়ীগণ, বিহারী-হোটেলওয়ালা, রাস্তার মুটে-মজুর-শ্রমিক- সকলেই আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল-এবং দরদিবন্ধু। আসর জমিয়া উঠিল। পুলিশও খুব কর্মতৎপর হইয়া উঠিল। দিবারাত্র পুলিশের আনাগোনা লাগিয়াই আছে। পুলিশের কড়া-নজরের মধ্যেই আমরা আমাদের কাজ আরম্ভ করিলাম।
আমরা ২৫ নম্বর কামরা খানিকে বাসস্থান ও আফিসে পরিণত করলাম। এখানেই হইল আমাদের মার্কসবাদী সাহিত্য ও পত্রিকা প্রকাশের প্রথম সূচনা। আমরা কিছু অর্থসংগ্রহ করিয়া "চাষী-মজুর" সাপ্তাহিক-পত্রিকা প্রকাশ করিলাম। পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী-সরকারের গোয়েন্দা-পুলিশের কর্মপ্রেরণা বৃদ্ধি পাইল - তাহারা খুবই সজাগ হইয়া উঠিল। ৪১ নম্বর জ্যাকোরিয়া স্ট্রিটের ২৫ নম্বর কামরাটি সরগরম হইয়া উঠিল— ইহা একটি বৈপ্লবিক কেন্দ্রে পরিণত হইল। একে একে বন্ধুরা আসিয়া জুটিলেন। কমরেড রণেন সেন, অবনী, সোমনাথ লাহিড়ী, সরোজ মুখার্জি আসিলেন। পরবর্তীকালে ১৯৩৪ সালে কমরেড নিত্যানন্দ চৌধুরি, ইসমাইল সাহেব, শামশুল হুদা, গোপেন দা প্রমুখ অনেক কমরেড আমাদের সঙ্গে যোগদান করেন। ১৯৩১ সালে জামিনে মুক্তি পাইয়া কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ মীরাট হইতে কলিকাতা আসিয়া আমাদের সঙ্গে এই ২৫ নম্বর কামরায় কিছুদিন ছিলেন। তাঁহার আগমন উপলক্ষে এই বাড়িটি আরও প্রসিদ্ধ হইয়া উঠে। গোয়েন্দা-পুলিশের স্পাই প্রায়ই তাঁহাকে অনুসরণ করিত। তদুপরি কমরেড আহ্মদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করার জন্য বহুলোক এখানে আসিতেন। ইহা ছাড়া সন্ত্রাসবাদী দলের নেতারা এখানে যাতায়াত করিতেন তাঁহাদের অনেকেই আজ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। বিস্তারিতভাবে সকলের বিষয় এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে লেখা সম্ভব নহে।
৪১, জাকারিয়া স্ট্রিট হইতে আমরা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সহিত যোগসূত্র স্থাপন করিয়াছিলাম। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টিকে কেন্দ্রীয়ভাবে গড়িয়া তুলিবার জন্য বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপগুলিকে ঐক্যবদ্ধ হইবার জন্য যেসব আন্তর্জাতিক আবেদন; দলিলপত্র আসিয়াছিল তাহার মূলেও ছিল আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এই প্রসঙ্গে একজন চীনা কমরেডের কথা আজ সবচাইতে মনে হয়। কমরেড জন জেমসন। ১৯৩০ সালে প্রথমে কলিকাতায় তাহার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং পরে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। বিশ বছরের যুবক ১৯২৭ সালে ক্যান্টন-বিপ্লবে যোগদান করিয়াছিলেন। প্রতিক্রিয়াশীল চিয়াং কাইশেকের কবল হইতে কোনোরকমে আত্মরক্ষা করিয়া সিঙ্গাপুরে আসেন এবং সেখান হইতে পলাইয়া আসেন। তিনি বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে এক জুতার দোকানে থাকিতেন এবং ইনকামট্যাক্স অফিসে একটি চাকরি জোগাড় করেন। তাঁহার সহিত আলাপ হইবার অল্পদিন পরেই আমার জেল হয়। ১৯৩১ সালে জেল হইতে মুক্তিলাভ করিয়া তাঁহার সহিত পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করি। তিনি কখনও কখনও গোপনে ৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটে আসিয়া আমার সহিত দেখা করিতেন। আমি তাঁহার সাহায্যে সিঙ্গাপুর হইয়া চীন যাইবার চেষ্টা করিতেছিলাম। আমার যাইবার আয়োজন যখন প্রায় সব ঠিকঠাক হইয়াছে, ঠিক সেই সময় সিঙ্গাপুর পুলিশ সিঙ্গাপুরের (মালয়) কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে হানা দেওয়ার ফলে আমার চীন যাত্রার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। যাহা হউক, কমরেড জেমসন আমাদের প্রত্যেকমাসে আর্থিক সাহায্য দিতেন। কলিকাতার হগ মার্কেটে আর একজন চীনা বন্ধু থাকিতেন। তিনিও আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন। দেশের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবিদের একাংশ যখন আমাদের প্রতি নাক সিঁটকাইতেন, সাম্যবাদের বিরুদ্ধে প্রচার করিতেন তখন এই বিদেশি বন্ধুদের আন্তর্জাতিকতায় আমরা মুগ্ধ না হইয়া পারিতাম না। ইলিসিয়াম রো বা লর্ড সিংহ রোডের গোয়েন্দা দপ্তর জেমসন সম্পর্কে অনেক খবর সিঙ্গাপুর হইতে সংগ্রহ করিয়াছিল কলিকাতা পুলিশ ১৯৩১ সালে তাঁহাকে বৈদেশিক আইনে ভারত হইতে বহিষ্কার করিয়া দেয়। শুনিয়াছিলাম, হঙকঙে তিনি গ্রেপ্তার হইয়া তিনমাস কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু পরে তাঁহার কোনও খোঁজ-খবর পাই নাই।
আর একজন বিদেশি কমিউনিস্ট বন্ধু সেই সময়ে (১৯৩১-৩৪) যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছিলেন। কমিউনিস্ট সাহিত্য পত্রিকা প্রভৃতি আমদানি করিয়া তিনি আমাদের সাহায্য করিতেন। তিনি ছিলেন একজন আমেরিকান— কমরেড এম মার্টিন, এক আমেরিকান জাহাজের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। খিদিরপুর ডকে জাহাজ আসিলে আমি গোপনে জাহাজে গিয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতাম বিভিন্ন ধরনের মার্কসীয় সাহিত্য, পত্রিকা, বই তিনি আমাদের সরবরাহ করিতেন; তদুপরি আমাদের আর্থিক সাহায্য করিতেন, সামান্য হইলেও তাহার সাহায্যের মূল্য ছিল আমাদের কাছে যথেষ্ট। ১৯৩৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে শেষবারের মতো তাঁহার সহিত আমার দেখা হইয়াছিল। আন্তর্জাতিক-কমিউনিস্ট প্রতিষ্ঠানের সহিত যোগসূত্র স্থাপনের তিনি ছিলেন আমাদের বিশিষ্ট বাহক ও বন্ধু।
‘‘চাষী-মজুর’’ কাগজ কয়েক সংখ্যা বাহির হওয়ার পর রাজদ্রোহকর প্রবন্ধ প্রকাশের অপরাধে সম্পাদকের সাজা হইল এবং সরকার “চাষী-মজুর” প্রকাশের জন্য ১০০০ টাকা জামানত দাবি করিল— আমরা জামানত দিতে অসমর্থ হওয়ায় পত্রিকাটির প্রকাশও বন্ধ হইয়া গেল। নাম পরিবর্তন করিয়া “দিনমজুর” নামক একখানি সাপ্তাহিক পত্রিকা বাহির করিলাম, তাহার উপরও জামানত তলব হইল। সুতরাং তাহাও বন্ধ হইয়া গেল। পত্রিকা-প্রকাশনা ছাড়া ২৫ নম্বর কামরা ছিল শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সদর দপ্তর। কমিউনিস্ট পার্টির গোপন ইস্তাহার, ইউনিয়নের লিফ্লেট বা ইস্তাহার, কৃষকের দাবির সমর্থনে পুস্তিকা, মে-দিবসের ইস্তাহার প্রভৃতি মুসাবিদা আমরা এখানেই বসিয়া করিতাম। একাধারে পার্টি অফিস, ইউনিয়ন অফিস, পত্রিকার অফিস, রাত্রিকালে আমাদের শোবার ঘর। এই একটা ছোট কামরাতে এক এক সময়ে আমরা ১০-১২ জন কমরেড চাটাই বিছাইয়া রাত্রি যাপন করিতাম। বিড়ির ধোঁয়ায় কুণ্ডলীতে ঘরটি অন্ধকার হইয়া উঠিত। খাওয়া-পরার আর বিশেষ সমস্যা ছিল না। কিছু পয়সা জুটলেই মির্জাপুর স্ট্রিটের পাইস হোটেলে নতুবা জাকারিয়া স্ট্রিটের আমজেদিয়া হোটেলে তন্দুর রুটি ও ডালগোস্ত ভক্ষণ করিয়া ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করিতাম। ‘‘আদর্শ কমিউন ব্যবস্থা’’ - প্রত্যেকের জন্য ছয় পয়সা হইতে দুই আনা বরাদ্দ থাকিত। সারাদিনের কর্মের পর কোনও কোনোদিন অনাহারেই রাত্রি কাটিত। সেই সময় কবি নজরুলের কবিতার কয়েক পংক্তি মনে পড়িত। ‘‘আঁকাড়া চালের অন্ন লবণ— আমার রসনা করেছে লোভন।’’ এত দুঃখকষ্টের মধ্যেও আমাদের দিনগুলি বেশ আরামে কাটিত। মাঝে মাঝে গোয়েন্দা পুলিশ আফিসে হানা দিয়া বই, কাগজপত্র তচনচ করিয়া দিত। দলিল, বই, পত্রিকা, ইত্যাদি লইয়া সরিয়া পড়িত। ১৯৩১-৩২ সালে সুতাকলে ধর্মঘট চলিতেছে। ১৯৩২ সালের ১ মে তারিখে মে দিবস-উপলক্ষে মেটিয়াবুরুজে বিরাট মিটিং ও মিছিল হইল। পরদিন আমি জ্বর প্লুরিসিতে আক্রান্ত হইলাম। দীর্ঘদিন অসুখে ভুগিলাম। অনেকদিন পত্রিকা-প্রকাশনা বন্ধ রহিল। সেপ্টেম্বর মাসে গোয়েন্দা পুলিশ সোমনাথ ও আমাকে ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করিল। আমি সবেমাত্র হাসপাতাল হইতে ছাড়া পাইয়া বাসায় ফিরিয়াছি। সেই সময় সন্ত্রাসবাদী দলের যুবকরা আমার সঙ্গে কমিউনিজম সম্বন্ধে আলোচনা করিতে আসিতেন— পুলিশ সন্দেহ করিত যে সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে এবং তাহাদের ধারণা হইয়াছিল যে আমরা সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করিয়া ডাকাতির সাহায্যে অর্থসংগ্রহে লিপ্ত আছি। পুলিশের এই ধারণা সম্পূর্ণ অমূলক— ইহার কোনও বাস্তব ভিত্তিও ছিল না। আমরা সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের সন্ত্রাসবাদের পথ পরিহার করিয়া বৈজ্ঞানিক-মার্কসবাদের পথ গ্রহণের জন্য আবেদন করিতাম, প্রবন্ধ লিখিতাম, প্রচার করিতাম। সেইজন্য কোনও কোনও সন্ত্রাসবাদী নেতা আমাদের সঙ্গে দেখা করিতে আসিতেন। সরোজ বিপ্লবীদের দল হইতে আমাদের সঙ্গে আসিয়াছিলেন তবুও পুরাতন দলের সম্পর্কের জের হিসাবে ডাকাতির অপরাধে গ্রেপ্তার হইয়াছিল। যাহা হোক কয়েক সপ্তাহ হাজত ভোগের পর আমরা মুক্তি পাইলাম। পুনরায় আমরা মার্কসীয় তত্ত্ব প্রচারের জন্য যাহাতে পত্রিকা প্রকাশ করিতে পারি তজ্জন্য কমরেড নূর মোহাম্মদ তাঁহার স্ত্রীর যাবতীয় স্বর্ণালঙ্কার আমার হাতে আনিয়া দিলেন। সৌভাগ্যের বিষয় ডাকাতির অপরাধে আমি গ্রেপ্তার হইবার অল্পকিছুদিন আগেই এই অলঙ্কার আমার হাতে আসিয়াছিল এবং যথাসময়ে তাহা বিক্রয় করিয়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ এক বন্ধুর নিকট গচ্ছিত রাখিয়াছিলাম। নহিলে মিথ্যাবাদী পুলিশের পক্ষে ডাকাতির সঙ্গে আমাদের জড়িত করিবার পক্ষে এতটুকু অসুবিধা হইতো না। ডাকাতি করিয়া সংগৃহীত অর্থে কমিউনিস্ট-পত্রিকা ইত্যাদির পরিচালনার বিরুদ্ধে আমরা বরাবরই ছিলাম। এবং টেররিস্টদের সঙ্গে যোগসূত্র না থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুযোগ লইয়া পুলিশ বহুবার আমাদের হয়রান করিয়াছে। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসে মীরাট বন্দিদের দীর্ঘকালের জন্য সাজা হইয়া গেল। আগস্ট মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্টে আপীলে অধিকারী প্রমুখ কয়েকজন কমরেড মুক্তি পাইলেন। আমরা নতুন উদ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি পুনর্গঠনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করিলাম। ইতিপূর্বেই আমরা কমরেড নূর মোহাম্মদ প্রদত্ত অর্থে ‘‘মার্কসবাদী’’ পত্রিকা বাহির করিলাম। প্রথম সংখ্যা বাহির হওয়ার পরই পুলিশ জামানত দাবি করিল। আমরা ‘‘মার্ক্সপন্থী’’ বাহির করিলাম। ১৯৩৩-৩৪ সাল পর্যন্ত মার্ক্সপন্থী প্রকাশিত হইল। কিন্তু পুলিশ মার্কসপন্থীর নিকট জামিন দাবি করায় “গণশক্তি” প্রকাশিত হয়। ১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বর, নভেম্বর, ডিসেম্বর-এই তিন মাস ধরিয়া আলাপ-আলোচনার পর এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলির নির্দেশ মানিয়া লইয়া ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হইল। ১৯৩৪ সালে পার্টির খসড়া গঠনতন্ত্র এবং রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হইল। পার্টি গঠন, প্রচার পত্রিকা ছাড়াও আমরা গণশক্তি পাবলিশিং হাউস নাম দিয়া একটি পুস্তক প্রকাশন কেন্দ্র খুলিয়াছিলাম এবং অনেকগুলি পুস্তকও প্রকাশিত হইয়াছিল।
১৯৩৪ সালের মাঝামাঝি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী গভর্নমেন্ট ভারতবর্ষের শ্রমিক-কৃষক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন দমনকল্পে আর একবার তীব্র দমননীতি শুরু করিল। কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করিল। জঙ্গি শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকে অবৈধ ঘোষণা করিয়া দিল। জাকারিয়া স্ট্রিট হইতে দমন-নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হইল। আমরা সকলে একে একে রাজনৈতিক অপরাধে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হইলাম। যাঁহারা বাহিরে থাকিলেন তাঁহার গোপনে ও প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টির লাল নিশানকে ঊর্ধ্বে বহন করিয়া চলিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে ৪১ নম্বর জাকারিয়া স্ট্রিটের অবদান চিরকাল একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া থাকিবে। সংক্ষেপে ৪১নং জাকারিয়া স্ট্রিটের ইতিবৃত্ত এখানে দিলাম।
(লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে ‘অনুশীলন’ পত্রিকায়। মূল শিরোনাম ছিল ‘তিরিশের দশকে কমিউনিস্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচেষ্টা, ৪১নং জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের কাহিনী’। এখানে শিরোনাম গণশক্তির।)
Comments :0