Cinema

সিনেমাকে ভালবেসে জীবনের উদযাপন

ফিচার পাতা

স্বস্তিক সরকার

সিরিজ - চলছে সিনেমা 
মাধ্যম - ইউটিউব
সৃজনে - সন্দীপ্ত দে
চিত্রনাট্য - সুদীপ্ত দে
পরিচালনা - রুদ্ররূপ সেনগুপ্ত, প্রীতম দাস, দীপায়ন রায়, নীলজিৎ সেন, জ্যোৎস্না সেন

সিনেমা আসলে সময়ের কথা বলে। ইতালির নব্য বাস্তববাদ থেকে শুরু করে ফরাসি নব তরঙ্গ অথবা মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের ছবি, সবই সময়ের দলিল। ১৯৬৮ সালের ফ্রান্স, সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গল সরকারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। সংগঠিত হয় ছাত্র আন্দোলন যা পরবর্তীতে বৃহত্তর গণআন্দোলনের রূপ নেয়। এই ছাত্র আন্দোলনই গোদারকে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রভাবিত করে। সত্তর দশকে বাংলা চলচ্চিত্রেও উঠে আসে উত্তাল সময়ের প্রতিচ্ছবি। মৃণাল সেন এবং সত্যজিৎ রায় দু’জনেই নির্মাণ করেন তাঁদের ‘ক্যালকাটা ট্রিলজি’। দুই পরিচালকের দু’রকম দৃষ্টিভঙ্গিতে শহরের প্রতিচ্ছবি যা সেই সময়ের সমাজ-রাজনীতির জ্বলন্ত দলিল। 
চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে এমন সময়ের দলিল পাওয়া যায় বিস্তর। এই সকল ছবি বারবার সমৃদ্ধ করেছে চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই সময় বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে এমন ছবির উদাহরণ বিরল। যে ছবি সৎভাবে সময়ের কথা বলে, আধুনিক নগর জীবনের কথা বলে, সর্বোপরি মানুষের কথা বলে। 
এই নিরাশা অনেকটা দূর করল ‘চলছে সিনেমা’—  সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছয় পর্বের একটি ওয়েব সিরিজ। সিরিজটি মূলত স্বাধীনভাবে তৈরি, তাই এই সিরিজ অনেক বেশি সাহসী এবং গবেষণাধর্মী। শুরুতে বিশ্ব চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ তোলার কারণ হলো এই সিরিজটি আদতে সমস্ত চলচ্চিত্র প্রেমীদের পক্ষ থেকে চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে লেখা একটি প্রণয় পত্র। এই মাধ্যমটির ইমপ্যাক্ট, ঐতিহাসিক গুরুত্বকে উদ্‌যাপন করেছে এই সিরিজ। 
প্রথম পর্বটিতে প্রায় প্রত্যেকটি ফ্রেমে বিশ্ব চলচ্চিত্রের সমস্ত দিকপালদের হোমাজ দেওয়া হয়েছে। সত্যজিৎ রায় - ঋত্বিক ঘটক - মৃণাল সেন থেকে  গোদার, তারকোভিস্ক, ফেলিনি, কুরোসাওয়া, কিয়ারোস্তামির মতন ফিল্ম জিনিয়াসদের ছবিকে উৎসর্গ করে নির্মিত হয়েছে এই পর্বটির বিভিন্ন দৃশ্য। এই পর্বের নির্মাণও বেশ অন্যরকম। স্টক ফুটেজ, আর্কাইভ এর ব্যবহার অথবা ফোর্থ ওয়াল ব্রেক, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতির কথা মনে করায়। এই পর্বের একটি দৃশ্যে প্রজেকশনের মাধ্যমে যেভাবে সমাজ রাজনীতি এবং বিশ্ব সিনেমাকে একত্রে উপস্থাপন করা হয়েছে তা প্রশংসনীয়। সুদীপ্ত দে ( যিনি এই সিরিজের কাহিনিকার এবং চিত্রনাট্যকারও বটে) অভিনীত চরিত্রটির কথা বলার ধরন, চশমা ঠিক করার ভঙ্গি ‘যুক্তি তক্কো গপ্পো’ ছবিতে ঋত্বিক ঘটক অভিনীত চরিত্র নীলকণ্ঠ বাগচীর কথা মনে করায়। বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী অভিনীত চরিত্রটির সংলাপেও বিভিন্ন বাংলা সিনেমার রেফারেন্স বেশ উপভোগ্য। 
এই সিরিজটি কিছুক্ষেত্রে মানুষের অবচেতনের বিষয়ও আলোকপাত করে। রাজা সেন অভিনীত চরিত্রটির সংলাপ ‘আমি তো রিফ্লেকশন’ নির্দেশ করে যে সিনেমাও আদতে মানুষের অবচেতনেরই প্রতিচ্ছবি। 
দ্বিতীয় পর্ব থেকে সিরিজটি সম্পূর্ণভাবে গল্প বলায় মনোনিবেশ করে। আর এই গল্পের মধ্যেই উঠে আসে এই সময়ে সমাজ-রাজনীতির প্রসঙ্গ।
সিরিজটি অনেকগুলো মানুষের গল্প বলে। তাদের বেঁচে থাকার গল্প, হেরে যাওয়ার গল্প, আবার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই চরিত্রগুলি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিকে প্রতিনিধিত্ব করছে। তারা প্রতিদিন নিজের জীবনে কিভাবে লড়াই করে চলেছে— এই সিরিজ সেই গল্প বলে। এর মধ্যেই উঠে আসে চাকরি দুর্নীতি, শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক, সিন্ডিকেট রাজত্বের মতো এই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার কথাও বলে এই গল্পের চরিত্ররা। সুদীপ্ত দে অভিনীত চরিত্রের সংলাপে উঠে আসে কমিউনিজমের প্রসঙ্গ। কিভাবে এই চরিত্রগুলির জীবন সিনেমার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তৈরি হবে এক সৎ ‘ফ্লপ সিনেমা’, যে সিনেমা সময়ের কথা বলবে, প্রান্তিক মানুষদের কথা বলবে তা নিয়েই গোটা সিরিজটি সাজানো। এ ক্ষেত্রে বলতেই হয় চিত্রনাট্যের কথা। যথেষ্ট মুনশিয়ানার সঙ্গে অনেকগুলো গল্প একত্রে জুড়েছেন চিত্রনাট্যকার সুদীপ্ত দে। টেকনিক্যাল দিক থেকেও সিরিজটি ব্যতিক্রমী। প্রথম পর্বে প্রজেকশন ব্যবহারের কথা তো শুরুতেই বললাম, এছাড়াও চতুর্থ পর্বের শেষের দিকে একটি পিওভি শট বেশ ভালো। কিছু ক্ষেত্রে অ্যানিমেশনের ব্যবহার স্বল্প বাজেটেও বেশ উৎকৃষ্ট মানের। 
কিছু সম্পাদনার ত্রুটি ও কিছু জায়গায় ক্যামেরার ফোকাসের সমস্যা খানিক ছন্দপতন ঘটালেও বিষয়বস্তু শক্তিশালী হওয়ার কারণে তা এড়িয়ে যাওয়া যায়। সুমন্ত রায়, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, সুমিত সমাদ্দার, শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য সহ একাধিক অভিনেতা এই সিরিজটির সম্পদ হয়ে উঠেছে। এছাড়াও রয়েছেন অনেক নতুন মুখ। তবে বিশেষভাবে দু’জনের কথা বলতেই হয়, যাঁরা এই সিরিজটির চমক। প্রথমজন বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক রাজা সেন এবং দ্বিতীয়জন সুদীপ্ত দে। 
এই সিরিজটি আশাবাদের গল্প বলে। এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে শিরদাঁড়া সোজা রেখে সমাজ রাজনীতির কথা বলে। হেরে গিয়েও জিতে যাওয়ার গল্প বলে। তবে গল্প এখানেই শেষ নয়, সেই আভাস পাওয়া যায় অন্তিম পর্বের শেষে। দ্বিতীয় কিস্তিতে এই গল্পেরই বাকি অংশ দেখানো হবে। সব মিলিয়ে কিছু ত্রুটি, বাজেটের সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বাংলার অসংখ্য উদ্দেশ্যহীন সিনেমা— সিরিজের ভিড়ে এই সিরিজটি খানিক খোলা হাওয়ার মতন। তাই এই সিরিজটি যাতে হারিয়ে না যায় সেই দায়িত্ব মানুষকে নিতে হবে। কারণ সিরিজটি সৎভাবে মানুষের গল্প বলতে সক্ষম হয়েছে।

Comments :0

Login to leave a comment