General elections 2024

বেসরকারি হাতে খাদান রুখে দিতে পারে লাল ঝান্ডাই, শুনলেন জাহানারা

জেলা লোকসভা ২০২৪

 ব্যাঙ্ক-বিমার মতো মাটির নিচে খাদানেও নজর মোদী সরকারের। শাসক তৃণমূলের নজর এত গভীরে নয়, স্রেফ পাচারেই!
লড়ছে চিনাকুড়ি। লিজ আউট পদ্ধতিতে খাদানের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সমানে লড়ছে সেখানে লাল ঝান্ডা! লড়ছে তিলাবনী কোলিয়ারি— এখানে ঠিকাকরণের মাধ্যমে চালু লাভদায়ক খাদানকে আসলে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়ছেন শ্রমিকরা। এতটাই সেই ঝাঁঝ যে ঠিকাকরণ প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও শ্রমিক বিক্ষোভের পা রাখতে পারেননি সিএমডি! স্রেফ শ্রমিকদের লড়াই বেসরকারি থাবা থেকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে একের পর এক কোলিয়ারিকে।
একাংশের মিডিয়া থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কথায়, ‘এসব বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কি ভোট জেতা যায়!’
তবে দাঁড়ানো যাক কুলটির চিনাকুড়ি থেকে বিস্তর দূরে দামোদরের পাড়ে এক তল্লাটে। অণ্ডাল স্টেশন থেকে সোজা কিছুদূর এগলেই মদনপুর। দামোদরের কোল ঘেঁষা এই জনপদ ইতিমধ্যেই যেন সেজে উঠেছে পতাকায়। লাল পতাকা আছে, দেওয়াল লিখন আছে, আছে তৃণমূলের দেওয়াল লিখনের পাশে কেবল প্রতীক এঁকে ফাঁকা রেখে দেওয়া বিজেপির’র দেওয়াল! শাসক তৃণমূলের এক দাপুটে মন্ত্রীর ‘পরামর্শ’ ছাড়া এখানে বিজেপি এখনও প্রার্থী ঘোষণা করছে না, এমন কথাও শোনা গেল এখানে খোদ দলের কর্মীর মুখেই। 
সেই মদনপুরেই এদিন সকালে প্রচারে কয়লা শ্রমিক পরিবারেরই কন্যা জাহানারা খান। গোটা এই এলাকা জুড়ে তৃণমূলী বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য! দিনে দুপুরেই দামোদরকে আরও রিক্ত করে লরির পর লরি বেআইনি বালি পাচার চলছে। মদনপুর জানাচ্ছে্, দামোদর-অজয়ের বালি তোলার কারবার মূলত চালায় শাসক দলের এক বিধায়কের বাহিনি। তৃণমূলের তারবাংলার অফিসে প্রতিরাতে আবার দেখা মেলে বিজেপি’র বালি-বাহিনীর। পাচারের ঐক্য। 
মদনপুর থেকে প্রার্থীকে নিয়ে যখন গ্রামবাসীরা মিছিল করে এগচ্ছে বাসকার দিকে। সেই সময়েই গ্রামেরই প্রৌঢ়া চায়না বাউড়ি হাতে রাখা কিছু কুঁচো ফুল জাহানারা খানের দিকে ছুঁড়ে দিলেন, কাছে যেতেই বলছিলেন, ‘‘এরা দেখুন খাদান, কারখানা খোলার কথা বলছে, কাজের কথা বলছে ভোটের সময়। আমার ছেলেটা ঠিকায় কাজ করে। গ্রামে কাজ নেই কিন্তু ঘুরে দেখুন কটা মন্দির হয়েছে।’’
জামুড়িয়া, পাণ্ডবেশ্বর, রানিগঞ্জ হয়ে আসানসোল, কুলটি, বারাবনী— বিস্তীর্ণ শিল্প তল্লাটে গত কয়েকবছরে নতুন নির্মাণ বলতে শুধু চোখে পড়বে মন্দির! হনমুান মন্দির থেকে রাম জানকি মন্দির, সূর্য মন্দির। নতুন মন্দিরের সংখ্যা প্রায় দু’শোর বেশি। পাশের লোকসভা কেন্দ্রের শুধুমাত্র দুর্গাপুর পূর্ব বিধানসভা কেন্দ্র জুড়েই একশোটির মতো বজরঙবলীর মন্দির গড়ে উঠেছে। কোথাও তৃণমূল তো কোথাও বিজেপি— পাল্লা দিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। 
সকালে বাসকায় যখন জাহানারা খানের বাড়ি বাড়ি প্রচারের সময়তেই গ্রামের বাসিন্দা বিদ্যুৎ মণ্ডল বলছিলেন, এখানে সব বোঝাপড়া করে চলে। খাদান হোক আর কারখানা হোক— ওরা মালিকপক্ষের ভাড়াটে বাহিনী, রুখতে পারে লাল ঝান্ডাই।
শিল্পাঞ্চল জানে শ্রমিক লড়াইয়ের রং আসলে কী? প্রচারের ফাঁকে সেই কথা বলছিলেন বামফ্রন্ট প্রার্থী জাহানার খান। বলছিলেন, ‘আমরা কোলিয়ারি এলাকার মানুষ। খাদান বিজেপি সরকার তুলে দিতে চাইছে কর্পোরেটদের হাতে। আর তৃণমূল কয়লা পাচারের কারবার করে তার পথ আরও প্রশস্ত করছে। এরা কোনোদিন শ্রমিকের হয়ে কথা বলে না। শুনুন শিল্পাঞ্চল থেকে শুধু পুরুষরা নয় এখনও মহিলারাও কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছেন। জামুড়িয়ার পড়শিরা গ্রামের মহিলারাও সন্তান নিয়ে অন্য রাজ্যে কাজের জন্য যাচ্ছেন। কাজের আকাল কোথায় পৌঁছেছে ভাবা যায়? আগের বিজেপি সাংসদ তো এখন তৃণমূলে ভিড়ে গেছে। উনি সাংসদ থাকাকালীন বার্ন ওয়াগান বন্ধ হলো, হিন্দুস্থান কেবলসের দশা তো জানেন।’
গোটা পশ্চিম বর্ধমান জেলায় ২৬টির বেশি ব্যক্তি মালিকাধীন শিল্প সংস্থা গত দশ বছরে পাততাড়ি গুটিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার হিসাব এর বাইরে। দশ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। স্বাধীনতার পরে দুর্গাপুর থেকে সালানপুরের বিস্তীর্ণ তল্লাটকে ‘রূঢ় অব বেঙ্গল’ বলা হতো। এখন সেখানে বন্ধ কারখানা, বজরঙবলীর মন্দির, কয়লা পাচার আর লটারির কারবার। এই চত্ত্বর ভাইপো সাংসদের কাছে বরাবরই ‘লাভদায়ক’! জামুড়িয়া থেকে পাণ্ডবেশ্বরের তৃণমূলী বিধায়কদের নজরানা যায় প্রতি মাসে দক্ষিণ কলকাতায়।
আসানসোলের প্রাক্তন সাংসদ, সিপিআই(এম) নেতা বংশগোপাল চৌধুরির কথায়, গোটা আসানসোলকে তিলে তিলে ধ্বংস করা হচ্ছে। এখানকার অভিনেতা তৃণমূল সাংসদ তো সংসদে ‘খামোশ’ থাকেন। উনি তো ভালো করে চিনতে পারেননি গোটা এলাকা। জানেন কীভাবে এখানে ধস এলাকায় পুনর্বাসনের প্রকল্পের ২০০ কোটি টাকা ওঁর দলের লোক গায়েব করে দিয়েছে? দেশপ্রেমিকরা কোথায়? কোন একটা কারখানা খোলার লড়াইয়ে ওরা আছে? বিজেপি তাকিয়ে থাকে তৃণমূলের দিকে, তৃণমূল ওদের দিকে। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে হয়ে ভোটের খেলা’।
গোটা রাজ্যের মধ্যে এই কুলটিতেই রয়েছে আরএসএস’র একমাত্র বিলাসবহুল গেস্ট হাউস। রানিগঞ্জে অমৃত ভবন থেকেও চলে সঙ্ঘের কারবার, একদা যোগী আদিত্যনাথের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল। কুলটির সোদপুর এলাকার আরএসএস-র এক প্রচারকের কথায়- ‘সব জায়গায় কয়লা ,বালি পাচার,  সব কারখানা বন্ধ এসব  সিপিএমের অভিযোগের। সব মোহ!’ 
শ্মশান হয়ে যাওয়া শিল্প তল্লাটে, বন্ধ কোলিয়ারি চত্বরেই চলেছে এখন আরএসএস –তৃণমূলের রামনবমীর প্রস্তুতি!
 

Comments :0

Login to leave a comment