Pele last rite

প্রিয় স্যান্টোসের স্টেডিয়ামেই শায়িত থাকবে পেলের দেহ

খেলা আন্তর্জাতিক

কয়েকদিন আগে থেকেই আভাস ছিল। কিন্তু বছরের শেষলগ্নে এরকম মনখারাপ করা খবর আশা করেননি কেউই। তিন বারের বিশ্বকাপ জয়ী বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার পেলে প্রয়াত হলেন বৃহস্পতিবার ভারতীয় সময় গভীর রাতে। বয়স হয়েছিল ৮২। ২০২১ সাল থেকে অন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কেটে বাদ দেওয়া হয় টিউমার। তারপর থেকে কেমোথেরাপির মতো বিভিন্ন অনুসারী চিকিৎসা চলছিল। কাতার বিশ্বকাপের সময়ই শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ২৯ নভেম্বর সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। গত মাসে বিশ্বকাপের মধ্যেই ব্রাজিলের একটি সংবাদ সংস্থা দাবি করে, কেমোথেরাপিতে আর সাড়া দিচ্ছেন না ফুটবল সম্রাট। গত ২২ ডিসেম্বর ক্যানসারের প্রকোপ বেড়ে যায়। শেষের দিনগুলিতে যন্ত্রণা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। কথা থাকলেও ডাক্তারদের পরামর্শ মেনে বাড়ি ফেরা হয়নি। বড়দিনে এ বছর হাসপাতালেই কাটিয়েছিলেন পেলে। বিছানায় অসুস্থ বাবাকে জড়িয়ে ধরে ছবি গণমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন তাঁর কন্যা কেলি। গত শনিবার হাসপাতালে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁর ছেলে এডিসনও। গত কয়েকদিন ধরে পরিবারের লোকেরা হাসপাতালে তাঁর পাশেই ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারদের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেলেন পেলে।


নতুন বছরে পেলের শেষকৃত্য হবে। স্যান্টোসের তরফে একটি বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, আগামী সোমবার ভোরবেলায় সাও পাওলোর হাসপাতাল থেকে পেলের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে স্যান্টোসে। সেখানে স্যান্টোসের ভিলা বেলমিরো স্টেডিয়ামের একদম মাঝখানে পেলের নিথর দেহ শায়িত থাকবে। ঘরের মাঠ ভিলা বেলমিরো স্টেডিয়ামে ফুটবলজীবনের সেরা কিছু ম্যাচ খেলেছেন পেলে। স্মরণীয় প্রচুর গোল রয়েছে সেই স্টেডিয়ামেই। পেলের স্মৃতিবিজড়িত সেই ভিলা বেলমিরোতেই ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন। সোমবার সকাল ১০টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত শ্রদ্ধা জানানো যাবে। এরপর পেলের কফিন নিয়ে শোভাযাত্রা করে স্যান্টোসের বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরানো হবে। সেটি যাবে তাঁর পৈতৃক বাড়ির সামনে দিয়েও, বাড়িতে আছেন শয্যাশায়ী তাঁর শতায়ু বৃদ্ধা মা সেলেস্টি। তবে ছেলের শেষযাত্রা দেখতে পাবেন না তিনি। কারণ, এখন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। পেলের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে স্যান্টোসের মেমোরিয়াল নেক্রোপোল একুমেনিকাতে। শুধু পরিবারের সদস্যরাই সেখানে হাজির থাকতে পারবেন। স্যান্টোসে পেলের একটি বাড়ি রয়েছে, যেখানে তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন। পরের দিকে তিনি চলে যান গুয়ারুজা সিটিতে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন তিনি।
ব্রাজিলে তিনদিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সাও পাওলোতে সাতদিন। ব্রাজিল জুড়ে বিভিন্ন স্মারকে আলো জ্বালিয়ে তাঁকে স্মরণ করা হচ্ছে। স্যান্টোস ক্লাবের এবং ব্রাজিলের ১০ নম্বর জার্সি পরে অনুরাগীরা দলে দলে ভিড় করেছেন হাসপাতালের সামনে।

পেলের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর। ব্রাজিলের মিনাস জেরাইসে। বাবা ছিলেন ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লুমিনেন্সের ফুটবলার ডোনডিনহো। ইলেকট্রিক বাল্বের আবিষ্কর্তা টমাস এডিসনের নামানুসারে ছেলের নাম রাখেন। তবে ‘এডিসন’ বদলে নাম দেন ‘এডসন’। এডসন আরান্তেস দি নাসিমেন্তো। ডাকনাম দেওয়া হয় ‘ডিকো’। যদিও বিশ্ব তাঁকে চেনে পেলে নামেই। ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ। পরপর চারটি বিশ্বকাপে খেলেছেন। তার মধ্যে তিন বার চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল। বিশ্বের আর কোনও ফুটবলারের তিনটি বিশ্বকাপ জয়ের নজির নেই। তিনটি বিশ্বকাপের সঙ্গে একের পর এক ট্রফি, সম্মান এবং অগণিত স্মৃতি। 
শোনা যায়, ব্রাজিলের ছেলেরা নাকি জন্মের পরেই প্রথম উপহার হিসাবে পায় একটি ফুটবল। পেলের জীবনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বয়স কিছুটা বাড়ার পর আসল ফুটবলে লাথি মারার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। স্থানীয় বাউরু এলাকার বিভিন্ন অপেশাদার লিগে খেলেছেন ছোটবেলায়। গোল করা এবং বল ড্রিবলিং করার ক্ষমতা যেন প্রকৃতিপ্রদত্ত। ছোটবেলায় চুটিয়ে খেলতেন ‘ফুটসল’ (ইন্ডোর ফুটবল)। পেলের ছোটবেলায় ব্রাজিলে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল  এই ‘ফুটসল’। বড় হয়ে স্বীকার করেছেন, ছোট জায়গায় কাটানোর ক্ষমতা এবং দুরূহ কোণ থেকে গোল করার পিছনে ছিল ছোটবেলায় ‘ফুটসল’ খেলা।


পেলের মৃত্যুর খবরে শোক প্রকাশ করেছে বিশ্বফুটবল। ব্রাজিলের প্রাক্তন ১০ নম্বর জার্সিধারীর মৃত্যুর পর বর্তমান ১০ নম্বর জার্সিধারী নেইমার লেখেন, “কোথাও একটা লেখা পড়েছিলাম, পেলের আগে ১০ শুধুই একটা সংখ্যা ছিল। বাক্যটা সুন্দর তবে অপূর্ণ। আমি বলব, পেলের আগে ফুটবল শুধুই একটা খেলা ছিল। পেলে ফুটবলকে শিল্প, আনন্দে রূপান্তরিত করেছিলেন।  বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। গরিব এবং কৃষ্ণাঙ্গদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন পেলে। ব্রাজিলকে গোটা বিশ্বে দৃশ্যমান করেছিলেন। ধন্যবাদ রাজা, তোমার জন্য ফুটবল এবং ব্রাজিলের স্থান উঁচু হয়েছে। পেলে নেই কিন্তু তাঁর জাদু থেকে যাবে। পেলে অনন্তকালের।”
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নিজের সাথে পেলের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, “সমস্ত ব্রাজিল এবং পেলের পরিবারকে সমবেদনা জানাই। এই মুহূর্তে গোটা ফুটবলবিশ্ব যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তাতে শুধু একটা শোকবার্তা যথেষ্ট নয়। রাজাকে শুধু বিদায় জানালে হবে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের অনুপ্রেরণা পেলে। অতীতে তিনি ছিলেন মাপকাঠি, আজও তাই, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। আমাকে যে ভালোবাসা আপনি দিয়েছেন তা আমি চেষ্টা করেছি আপনাকে ফিরিয়ে দিতে। সে আমরা যত দূরেই থাকি না কেন। কখনও তাঁকে ভোলা সম্ভব নয়। আমি এবং আমার মতো সব ফুটবল ভক্তের মধ্যে বেঁচে থাকবেন পেলে। শান্তিতে ঘুমাও রাজা।”


তিনবারের বিশ্বজয়ীর মৃত্যুতে এবারের বিশ্বজয়ী মেসি লিখেছেন, “শান্তিতে বিশ্রাম নাও।” সেই সঙ্গে মেসি পোস্ট করেছেন তাঁর এবং পেলের দু’টি ছবি। আরেক বিশ্বজয়ী ফুটবলার এমবাপে লেখেন, “ফুটবলের রাজা বিদায় নিয়েছেন, তবে তাঁকে ভোলা যাবে না। শান্তির ঘুম ঘুমাও রাজা।” স্যান্টোস ক্লাবে পেলের সতীর্থ এবং পরে আর্জেন্টিনার কোচ সিজার মেনোত্তি লিখেছেন, ‘আরেকজন পেলে পাওয়া খুবই কঠিন। একজন প্লেয়ারের যা যা গুণ থাকা দরকার, পেলের সবই ছিল। পরিশ্রমী, লাফ দেওয়ায় ওর সমকক্ষ কেউ ছিল না, দু’পায়ে শট ছিল, শারীরিকভাবে খুবই শক্তিশালী এবং সাহসী, পেলের মতো কেউ নন।’
ব্রাজিলের ভাবী রাষ্ট্রপতি লুলা লিখেছেন, “ওনার মতো আর কোনও ১০নম্বর হয়নি। ওনার মতো খুব কম ব্রাজিলিয়ান মানুষই আমাদের দেশের নামকে সর্ব্বোচ্চ স্তরে নিয়ে গেছেন। ওনার খেলা, শুধুই খেলা ছিল না। ওটা সম্পূর্ণ এক প্রদর্শনী। ধন্যবাদ পেলে।” ইউনেসকো তাঁদের শোক বার্তায় লিখেছে, “খেলাধুলার চ্যাম্পিয়ন। খেলাধুলাকে শান্তির হাতিয়ার হিসাবে প্রচারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেছেন। আমাদের সমবেদনা সমস্ত ব্রাজিলকে এবং ফুটবল পরিবারকে।”
 

Comments :0

Login to leave a comment