Nabanna Abhijan

নবান্ন অভিযান ঘিরে দিনভর সাজানো চোর-পুলিশ খেলা

রাজ্য

রাজ্যে অসংখ্য সামাজিক প্রতিবাদের‌ একটি।

 অস্তিত্বহীন সংগঠনের নবান্ন অভিযান নিয়ে ২৪ ঘণ্টা আগে কর্মসূচির প্রচারে নেমে পড়ল রাজ্য সরকার!
তবে সেই সংগঠনের পিছনে কারা আছে তা সোমবার প্রেস ক্লাবে তাদের সাংবাদিক সম্মেলনে অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নবান্ন অভিযানের পক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন করতে বসা এক নেতা, নবদ্বীপের শুভঙ্কর হালদার জানিয়ে দেন,‘‘হ্যাঁ আমি আরএসএস। তো কী হয়েছে? আরএসএস বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো সামাজিক সংগঠন। স্ববংসেব হিসাবে আমি গর্বিত।’’ তাঁর বিরুদ্ধে নবদ্বীপ থানায় শ্লীলতাহানির অভিযোগ আছে, এই প্রশ্নের জবাবে ওই স্বয়ংসেবক প্রশ্নকারী সাংবাদিকদকে ‘চোপ’ বলে ধমকে ওঠেন।
এদিন ওই নাবন্ন অভিযান কর্মসূচীর চিঠি না পাওয়ার জন্য অবৈধ ঘোষণার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নবান্ন অভিযানের অনুমতি চেয়ে চিঠি চলে আসে। আবার সেই চিঠির বয়ান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দ্বিতীয় দফায় সাংবাদিক বৈঠকে চলে আসেন পুলিশকর্তারা। দিনভর আয়োজক আর রাজ্য পুলিশকর্তাদের ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ খেলায় সংবাদ মাধ্যমে জোরদার ছিল অস্তিত্বহীন সংগঠনের নবান্ন অভিযানের প্রচার। 
দিনভর নবান্ন অভিযান নিয়ে পুলিশি তৎপরতার পর মঙ্গলবার কলকাতা সহ হাওড়া শহরকে নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হচ্ছে। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই নবান্নে আসতে শুরু করেছে শয়ে, শয়ে ফোর্স। কলকাতা ও হাওড়ার রাস্তার যান নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়ে যাবে। অভিযানের আগেই সরকার ও পুলিশ মিলেই আয়োজকদের উদ্যোগকে রাজনৈতিক চেহারা দিতে ব্যস্ত হয়েছে। চমকপ্রদ বিষয় হলো সারাদিনই বিজেপি নেতারা বিভিন্ন কথা বলে যাচ্ছেন সংবাদ মাধ্যমে, তৃণমূলের তরফেও চলছে পালটা বক্তব্য। দু-তরফের উদ্দেশ্যও তাতে স্পষ্ট।
সোমবার নবান্ন থেকে দু’দফায় সাংবাদিক সম্মেলন করলেন রাজ্য পুলিশের শীর্ষ আধিকারিকরা। প্রথমে বেলা ১টায় রাজ্য পুলিশের এডিজি(দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতীম সরকার, এডিজি(আইনশৃঙ্খলা) মনোজ ভার্মা থেকে কলকাতা ও হাওড়া পুলিশ কমিশনারেট মিলিয়ে প্রায় ৫ জন আইপিএস আধিকারিক নবান্ন থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করলেন। সেই সাংবাদিক সম্মেলন থেকে নবান্ন অভিযান কর্মসূচিকে বেআইনি ও অবৈধ বলে ঘোষণা করার পরই, এদিন সন্ধ্যাতে পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ নামধারী সংগঠন কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করার করে। এরপর ফের নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করে যান এডিজি(আইনশৃঙ্খলা) ও এডিজি(দক্ষিণবঙ্গ)। 
দিন কয়েক আগে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করে নবান্ন অভিযানের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল পুলিশের খাতায় অস্তিত্বহীন এক ছাত্র সংগঠন। তাদের নবান্ন অভিযানকে বেআইনি ঘোষণা করার পক্ষে এদিন এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ‘‘ নবান্ন অভিযান যেটা বলা হচ্ছে, সেটা রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর। হাই সিকিউরিটি জোন। নিয়ন্ত্রিত এলাকা। যারা সংগঠক তারা পুলিশের কাছ থেকে কোনও অনুমতি নেয়নি। এই দুই কারণের জন্য নবান্ন অভিযানের কর্মসূচি বেআইনি ও অবৈধ।’’
দুপুরে সাংবাদিকদের কাছে নবান্ন অভিযান নিয়ে অনুমতির আবেদন না পাওয়ার কথা জানানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশকর্তাদের কাছে চলে আসে অনুমতি চেয়ে চিঠি। তার জন্যও আবার দ্বিতীয় দফায় সাংবাদিকদের কাছে এসে তার ব্যাখ্যা দিতে থাকেন দুই শীর্ষ পুলিশকর্তা। রাজ্য পুলিশের এডিজি(দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতীম সরকার জানান, ‘‘ দু’টি মেইল আমাদের কাছে এসেছে। একটি এসেছে ছাত্র সমাজের কাছ থেকে। ই মেল করে শুধু কর্মসূচির কথা বলা হয়েছে। অনুমতি চাওয়া হয়নি। তাই তাদের অনুমতি পুলিশ দিচ্ছে না।’’
ই মেল মারফত দ্বিতীয় আবেদনটি এসেছে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ সংগঠনের তরফে। তাদের আবেদনে অবশ্য পুলিশকে কর্মসূচি নিয়ে প্রয়োজনীয় সব তথ্যই সরবরাহ করা হয়েছে দাবি করেছেন পুলিশকর্তারা। কিন্তু তাদের অনুমতি বাতিল করার জন্য যুক্তি দেওয়া হয়েছে, সর্বভারতীয় ইউজিসি নিট পরীক্ষা। মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে ১২টা ও দুপুর ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত, দু’দফায় ইউজিসি নেট পরীক্ষা হবে। 
এখন প্রশ্ন হলো, সকালে সাংবাদিক বৈঠক করে সুপ্রতীম সরকার বলেছিলেন, ‘‘ পশ্চিমবঙ্গ ছাত্র সমাজ নামে কোনও সংগঠনের অস্তিত্বের কথাই আমরা শুনিনি। অনেক দলের ছাত্র সংগঠন আছে, ছাত্র গোষ্ঠী আছে। কিন্তু এই নামের আমরা কোনও অস্তিত্ব পাইনি।’’ অস্তিত্বহীন এমন সংগঠন তাদের কর্মসূচি নিয়ে সরকারকে কিছু না জানানোর ঘোষণা করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অনুমতি চাওয়ার চিঠি চলে আসে নবান্নে। আবার সেই চিঠি প্রাপ্তির পর সাংবাদিকদের কাছে দ্বিতীয় দফায় সাংবাদিক বৈঠকে চলে আসেন রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তারা। 
এমনকি পুলিশকর্তারা গোয়েন্দা সূত্র তুলে ধরে নবান্নে জানান, ‘‘ বিভিন্ন সূত্র থেকে আমাদের কাছে খবর আছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুষ্কৃতীরা মিশে মঙ্গলবার গন্ডগোল করতে চাইবে। পুলিশকে প্ররোচনা দেওয়া হবে, যাতে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ নেয়। তার থেকে ওরা ফায়দা তুলবে। এইরকম বহু তথ্য আমাদের হাতে এসেছে।’’ 
নবান্নে রাজ্য পুলিশকর্তাদের এহেন সাংবাদিক সম্মেলন শোনার পর রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত এক শীর্ষ আধিকারিক বলেন, ‘‘ গোয়েন্দা থেকে পাওয়া তথ্য হাতে নিয়ে রাজ্য পুলিশ সাংবাদিক সম্মেলন করছে এটা প্রথম দেখলাম। পুলিশের কাজ গোয়েন্দা সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার। যে কোনও বড় ঘটনা ঘটার আগাম খবর থাকলে পুলিশ শান্তির স্বার্থে আগাম গ্রেপ্তার করে।’’ 
কিন্তু আগাম ব্যবস্থা কী নেওয়া হচ্ছে, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে নবান্ন থেকে দুই পুলিশকর্তা জানিয়েছেন, ‘‘ যে সব দুষ্কৃতী ভিডিও ছড়াচ্ছেন, উসকানি দিচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করার কাজ শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনি পথে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
কিন্তু সে পথে হাঁটেননি পুলিশকর্তারা। বরং গোয়েন্দা তথ্য হাতে নিয়ে তাঁরা নবান্ন থেকে সাধারণ মানুষের কাছে ‘হাতজোড় করে’, ‘অনুগ্রহ করে’ ফাঁদে না পড়ার অনুরোধ জানাতে থাকেন! এমনকি ছাত্র সমাজের এক আহ্বায়ক গত রবিবার সকাল ১১ টা ২৫ মিনিট নাগাদ কলকাতার পাঁচ তারা হায়াৎ রিজেন্সি হোটেলে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন, সেই তথ্যও শুনিয়েছেন পুলিশকর্তারা। 
রাজ্যজুড়ে প্রতিবাদ মিছিলের বহরে এমনিতেই রাজ্য সরকার ও পুলিশ ব্যাকফুটে। আর এখন নবান্ন অভিযানকে সামনে রেখে মানুষের প্রতিবাদকে সরিয়ে তাকে রাজনৈতিক খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য তৎপর ছিল রাজ্য সরকার। না হলে রাজ্য পুলিশের এডিজিকে বলতে হয়, ‘‘ যিনি রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি ছাত্র সমাজের অন্যতম আহ্বায়ক। তাঁর সঙ্গে কোনও পরিচিতি নেই। আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। এই সময়ে  গোপনে দেখা করতে যাওয়া আমাদের কাছে আশ্চর্য সমাপতন বলেই মনে হচ্ছে।’’ কিন্তু কে সেই নেতা তাঁর নাম সামনে আনছেন না এডিজি।

Comments :0

Login to leave a comment