প্রবন্ধ — মুক্তধারা, বর্ষ ৩
“হিম্মতকে সবার উপরে স্থান দাও…” : আজিজুল হক
সৌরভ দত্ত
লড়াই, আন্দোলন কখনো শেষ হয় না। আজিজুল হক নকশালবাড়ি আন্দোলন এর শ্লাঘাহীন সৈনিক । অদ্ভুত তীক্ষ্ণ চাহনি, সুনিপুণ তথ্যের সমাবেশ, আঙুল উঁচিয়ে বজ্রনির্ঘোষের ধ্বনি। কলমে জ্বলে ওঠা অক্ষরবৃত্ত। রাষ্ট্রীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে বারংবার গর্জে উঠেছে তার কলম।প্রথম জীবনে ছাত্র আন্দোলন পরে কৃষক আন্দোলন চারু মজুমদারের মৃত্যুর পর শ্রেণি শত্রুদের খতম করার শপথ গ্রহণ করেছিলেন। ঝকঝকে বাকপটুতায় অনায়াসে থামিয়ে দিতে পারতেন বিপক্ষ শিবিরের বক্তাদের। উলুবেড়িয়ায় একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম।সি.পি.আই.এম লিবারেশনের মুখপত্র দেশব্রতীতেও কলম ধরেছেন তিনি। তিনি ভেবেছিলেন লালফৌজের গেরিলা যুদ্ধ সমাজে সাম্য আনবেন। ছয়ের দশকের নকশালবাড়ি আন্দোলনের উজ্জ্বল মুখ আজিজুল হক। দেশে জরুরি অবস্থার সময় তিনি গ্রেপ্তার হন।সত্তর দশকে পার্বতীপুরম ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি প্রথমবার কারারুদ্ধ হন।তাঁর পরে বামপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে নকশালদের মুক্তি দেয়।চোখে বামপন্থার স্বপ্ন জেল থেকে বেরিয়ে তিনি কিছু অনুগামীদের নিয়ে সংগঠন মজবুত করার চেষ্টা করছিলেন। চারু বাবুর পর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির তিনিই ছিলেন মূল চালিকাশক্তি।তার কারাবাসের ভয়ঙ্কর দিনগুলির কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে আত্মজীবনী মূলক রচনা–‘কারাবাসের ১৮ বছর ’ বইটিতে। এছাড়া তাঁর ‘জেলখানার নোটবই’,‘নকশালবাড়ি তিরিশ বছর আগে ও পরে’ বইগুলি নকশালবাড়ি আন্দোলনের সম্যক ইতিহাস ও জ্বলন্ত দলিল রূপে পরিগণিত হতে পারে।অন্যায়ের সাথে আপোষ নয়। বুর্জোয়া রাষ্ট্রকাঠামো বদল চাই। ব্যক্তি আজিজুল হকের রাজনৈতিক দর্শন অনেক উঁচু স্তরের। আজিজুল হক প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি এসে পড়ে। লেখালেখির সূত্রে বইমেলায় যেতাম কলেজে পড়ার সময় থেকেই। বইমেলায় যেতাম।সেসময় যুবশক্তির স্টলেও বই রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন যুব সংগঠনের শতরূপা,সুগমদারা ।লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে প্রচুর টেবিল থিকা। সেরকমই সময়ের ঘড়ি পত্রিকার স্টলে দেখি দুপুরের পড়ন্ত রোদ ঠিকরে পড়ছে আজিজুল হকের চশমার ঘষা কাঁচে। প্রথম আলাপ সময়ের ঘড়ি পত্রিকার স্টলে। আশপাশে থাকত দীপঙ্করদাদের প্রতিবাদী কবিতা স্টল। সময়ের ঘড়ি বিভিন্ন সংখ্যা ছাড়া আজিজুল হকের লেখা বিভিন্ন বই ও শোভিত থাকত টেবিলে। পড়বার জন্য অনেকদিন ধরে খুঁজছিলাম রেডবুক।সে সুযোগ এল আজিজুল হকের সৌজন্যে ।সেদিন খুব অল্প সাম্মানিক এর বিনিময়ে তিনি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন অগ্রণী প্রকাশিত থেকে প্রকাশিত চীনা সংস্করণের লাল কভারে তারা আঁকা মাও-সে-তুঙ এর রেডবুক এর বাংলা অনুবাদ।যা পরে বিভিন্ন কৌতুহলী বামপন্থী বন্ধুদের পড়িয়েছি।তারাও সমৃদ্ধ হয়েছে।বইমেলায় আলাপ হওয়ার পর আজিজুল হকের ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিলাম।ফোন করতাম মাঝে মধ্যে। একটা মজার ঘটনা বলি– একবার আমার এক বামপন্থী দাদা বৈদ্যনাথ বসু আজিজুল হকের শানিত লেখানীর খুব ভক্ত ছিলেন। একদিন দুপুরে দাদার বাড়িতে আড্ডা মারতে মারতে আজিজুল হকের প্রসঙ্গ উঠতে দাদাকে বলি দেখবে আজিজুল হক সাহেবকে ফোন করব বলেই আজিজুল হককে ফোন লাগিয়ে দিই।ফোন রিসিভ করলে বলি–আমার এক বামপন্থী দাদা আপনার খুব অনুরাগী একটু কথা বলতে চান।দাদা তো রীতিমতো অবাক। আজিজুল হক ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে বলেন ওনাকে ফোন দাও অনুরাগী কি বীতরাগী কথা বলে দেখি। দাদার সাথে পরস্পর কুশল বিনিময় তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে দুদিন চার মিনিট কথা ।এরপর একবার বইমেলা গেছি দেখি আজিজুল হক পেতলের বাটিতে ঘরোয়া চালের মুড়ি আর বাতাসা খাচ্ছেন। চেয়ারের পাশে রাখা একটা কালো বাঁটের লাঠি ।পাশের চেয়ারে বসে বইপত্র ঘাঁটছিলাম।উনি বলেন এনাও মুড়ি খাও।কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন–এ শাঠিটাও বন্দুক হয়ে গর্জে উঠতে পারে যদি তোমরা ভয় দেখাও। সেবার স্টল থেকে সংগ্রহ করেছিলাম স্বাক্ষর সম্বলিত মহামতি লেনিনের প্রচ্ছদ আঁকা–‘যে পথে ওরা হেঁটেছেন’ বইটি।বইয়ে লিখেদিয়েছিলেন এক লাইন আশীর্বাণী–“হিম্মতকে সবার উপরে স্থান দাও ”।একবছর সরস্বতী পুজোর দিন আমি আর আমার দাদা বইমেলায় গিয়ে সময়ের ঘড়ির স্টলেই আজিজুল হককে সামনাসামনি পেয়ে যাই।কারাবাসের ১৮ বছর বইটি ক্রয় করার সময় কিছু লিখে দিতে বললে উনি লিখে দেন–“সম্প্রীতির ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়ে সাম্প্রদায়িকতার কাল সাপ”। বইমেলায় গেলেই আজিজুল হকের টেবিলে হাজির হতাম। একবছর পরিবারের কিছুদিন ও বন্ধুবান্ধব দলবল মিলে হাজির হয়ে অনেকক্ষণ ওনার সান্নিধ্যে কাটিয়েছিলাম।একটা কথার মধ্যে থাকত গভীর চিন্তন ও দার্শনিক মননের ছাপ। মাঝেমধ্যে টিভির টকশোতে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে হাজির হতেন। হাজির হতেন আজকাল পত্রিকার দপ্তরে।সঙ্গে থাকত সেই বাঁকা হাতলের লাঠি। যা তার সর্বক্ষণের সঙ্গী। “মানুষ মেরেছি আমি ” বইটিতে ও নকশাল পর্বের আত্মসাক্ষ্য রয়েছে।অশোক মুখোপাধ্যায় রচিত–“আটটা নটার সূর্য ” বইটিতেও আজিজুল হকের জেলবন্দি দশার কথা উল্লিখিত আছে।কিছু কমিউনিস্টদের বলতে শুনেছি বা ডায়েরিতে উল্লেখ ও পেয়েছি কারাবাসের দিনগুলোর ভয়ংকর নরকযন্ত্রণার কথা।রুনু গুহ নিয়োগীর কথা উঠে এসেছে বিভিন্ন লেখায়।এমনি রুল দিয়ে মলদ্বারে বলপ্রয়োগের মতো ঘৃন্য, নৃশংস অত্যাচার।যার ফলে বেশকিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার শারীরিক অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বামপন্থী। বিপ্লবের স্বপ্নে সোচ্চার।এমন একজন মানুষের সান্নিধ্যে বেশকিছু ছবিও ছিল মুঠোফোনে বন্দি। সেগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছি। বেশকিছু তিনি অসুস্থ ছিলেন। শরীর ভেঙে পড়েছিল।মৃত্যুর পরেও আজিজুল হকের হক্ কথা ও বিশ্বাস জেগে আছে ও থাকবে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। সুচেতনার আলো দেবে উজ্জ্বল আগামীর লক্ষ্যে ।
Comments :0