Editorial

বাংলাভাষী বিদ্বেষ

সম্পাদকীয় বিভাগ

উপলক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী খোঁজা এবং তাদের পত্রপাঠ ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেওয়া। কিন্তু তার পুরো খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলা‍ভাষী ভারতীয় নাগরিকদের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষী মানুষকে। অবশ্য ছাড় মিলছে না অন্য রাজ্যের বাংলাভাষী ভারতীয়রাও। এক্ষেত্রে আসাম সবার শীর্ষে। এহেন ভাষা সন্ত্রাসের একেবারে কেন্দ্রে আছে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের আরএসএস চালিত বিজেপি সরকারগুলি। এতদিন দিল্লিতে ক্ষমতায় না থাকায় কিছু করে উঠতে পারছিল না। এবার দিল্লি রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পরেই অমিত শাহর দিল্লি পুলিশ বীর বিক্রমে বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। লক্ষণীয়, বাংলাভাষী সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই অমানবিক জুলুম, পুলিশি সন্ত্রাসের শিকার কিন্তু একেবারে অসহায় দিন এনে দিন খাওয়া গরিব মানুষ। নিজ নিজ রাজ্যে রুজি রোজগারহীন মানুষগুলি পেটের দায়ে ভিন রাজ্যে যেতে বাধ্য হন কাজের সন্ধানে। সেখানে তারা ঝুপড়িতে, বস্তিতে নোংরা, অপরিসর, অস্বাস্থ্যকর পরিবে‍‌শে কোনোরকমে বেঁচে থাকেন। আরএসএস-বিজেপি’র সরকারগুলি টার্গেট করছে এই মানুষগুলিকেই। কতটা নির্মম, অমানবিক, বিবেকহীন হলে এমন মনুষ্যতর আচরণে লিপ্ত হওয়া যায়।
অবশ্য অবাক হবার কিছু নেই, এটাই বিজেপি, এটাই আরএসএস, হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক মতাদর্শের একেবারে মূলে আছে মুসলিম বিদ্বেষ। সারা দেশে ১৪ শতাংশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে ৮৫ শতাংশ হিন্দুদের ক্ষেপিয়ে তোলাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রণনীতি। নানান রণকৌশলের মধ্যে দিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা যত ছড়ানো যাবে ততই হিন্দুদের মুসলিমদের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ করা যাবে এবং বিভাজনকে ভোট বাক্সে প্রতিফলিত করে ক্ষমতা নিশ্চিত করা যাবে।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের জন্ম শত্রুতা। পশ্চিম সীমান্তে কড়া নজরদারি। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর অর্ধেকটাই মোতায়েন থাকে পাক সীমান্তে। তাই পাকিস্তান থেকে উর্দুভাষী অনু্প্রবেশ বিশেষ হয় না বললেই চলে। তাছাড়া সীমান্তে উর্দুভাষী কোন রাজ্যও নেই যেখানে অনেক মুসলিমের বাস। কিন্তু বাংলাদেশের সীমান্তে আছে পশ্চিমবঙ্গ যেখানে ধর্ম যাই হোক ভাষা বাংলা। তেমনি আসাম, ত্রিপুরাতে বাংলাভাষী মানুষ বিস্তর আছেন এবং তাদের একটা বড় অংশ ধর্মে মুসলিম। তাছাড়া প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক। তাছাড়া একদা যুক্ত বাংলা ভাগ হয়ে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান পরে বাংলাদেশ হওয়ায় দু’দেশের মানুষেরই আত্মীয়স্বজন থেকে যায় দু’দেশে। তাদের মধ্যে যোগাযোগ, আসা-যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটা ঠিক স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের পরেও বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের ভারতে আসা বন্ধ হয়নি। তবে মুসলিমরা দলে দলে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে আসা বন্ধ হয়নি। তবে মুসলিমরা দলে দলে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে আসছেন চরম অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে, এটা নিতান্তই কষ্ট কল্পনা। সামান্য ব্যতিক্রম সর্বত্র সবসময়ই থাকে।
এমন এক তথ্য পরিসংখ্যানহীন অবাস্তব কষ্ট কল্পনাকে সম্বল করে হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের হিড়িক তুলছে। এরাজ্যে ক্ষমতায় আসতে গেলে হিন্দুদের জোটবদ্ধ করতে হবে। তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ, মুসলিম আতঙ্ক, মুসলিম তৈরি না করতে পারলে সেটা সম্ভব। বাংলাদেশি খোঁজার এমন হিস্টিরিয়াগ্রস্ততার মূলে আছে এই রাজনৈতিক অভিসন্ধি। সত্যিকারের বাংলাদেশি যখন মিলছে না যেখানে পাওয়া যাচ্ছে বাংলাভাষী মুসলিমদের ধরে থানায় নিয়ে নির্যাতন করছে, তারপর ডিটেনশন ক্যাম্প হয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে। একে ঘিরে এমন প্রচার চলছে যেন পশ্চিমবঙ্গে সত্যি সত্যি বাংলাদেশি মুসলিমে ভরে গেছে। আসলে তারা এরাজ্যের মুসলিমদের বাংলাদেশি তকমা দিয়ে বিতাড়িত করতে চাইছে। ভাবছে এমন আবহে বাংলায় ক্ষমতা দখল করবে।

Comments :0

Login to leave a comment