Post Editorial

বন সংরক্ষণ সংশোধনী এবং নরেন্দ্র দলুইরা

উত্তর সম্পাদকীয়​

জাভেদ ইকবাল

দৃশ্য ১
রাত্রি তিনটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন নরেন্দ্র দলুই। বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা। শেষ রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আধ ঘণ্টা হেঁটে এসে পৌঁছান জকপুর স্টেশন। দিনের প্রথম মেদিনীপুর লোকাল ধরে কখনো মেদিনীপুর তো কখনো খড়গপুর থেকে ভোর ৫:৪০-এর টাটানগর মেমু ধরে সোজা চলে যান ঘাটশিলা। সেদিন অবশ্য এসেছিলেন ঝাড়গ্রাম শহর সংলগ্ন ‘খাস জঙ্গল’-এ। আরেকজন সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে বেলপাতা আর ছোট ছোট বেল ফল পাড়তে। সেগুলো দুটো আলাদা আলাদা কাপড়ের পুঁটুলি করে তুলেছেন খড়গপুরগামী বাসে। বেলপাতাগুলো শুকিয়ে না যায় তাই সেগুলো পরিপাটি করে ঘিরে রাখা হয়েছে নিমপাতা দিয়ে। তারপর কাপড় দিয়ে বেঁধে করা হয়েছে পুঁটুলি। জিতুশোলে পাশের জন নেমে যেতেই বসলেন উনি। স্যান্ডো গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট জুড়ে গাছের ছাল আর পাতার রসের দাগ। শরীরে ধুলো আর পাতার অংশ তখনও লেগে। জিজ্ঞেস করায় জানালেন, এই বেলপাতা আর বেল তিনি বিক্রি করবেন কোলাঘাট বাজারে। হাজার থেকে বারোশো টাকা পাবেন। সেটা ভাগ হবে দু’জনে মিলে। ‘‘এখন বাবার (শিবের) মাথায় জল ঢালা চলছে। আমাদের কাছ থেকে দোকানদার এগুলো কিনে এর সঙ্গে আকুন্দ ফুলের মালা, আরও অনেক ফুল ইত্যাদি দিয়ে ঘট সাজিয়ে দুশো টাকায় তারা বিক্রি করে।’’ দুই বন্ধু মিলে এখন সপ্তাহে একদিন দু’দিন যান জঙ্গলে পাতা আনতে। সেখানে কখনো থাকে হাতির পাল, কখনো শিয়াল তো কখনো চিতা বাঘ।  

দৃশ্য ২
জঙ্গলের মধ্যে কী যেন একটা কুড়িয়ে চলেছেন অনিল মাহাতো। মাটিতে শুকনো পাতার মাঝে একটা দুটো করে ছড়িয়ে হালকা সবুজাভ হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল। দেখতে একদম আঙ্গুর ফলের মতো। কিন্তু গন্ধে যেন মাথা ধরে যায়। সাদা পলিথিনের প্যাকেটে বাঁকসোলের জঙ্গল থেকে একটা একটা করে সেই মহুয়া ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছেন অনিল মাহাতো। বয়স প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। পাশেই মোহনপুরে বাড়ি। জাতীয় সড়কের অন্য পাড়ে রাখা আছে তাঁর সাইকেল। হ্যান্ডেলে ঝুলছে বাজার করা ঝোলাতে এক ঝোলা মহুয়া ফুল। অনিল মাহাতোর সঙ্গে হাত লাগাতেই দেখি অল্প হওয়াতেই গাছ থেকে একটা দুটো করে ঝরে পড়ছে মহুয়া। গোটা চৈত্রমাস জুড়েই কুড়ানো হয়। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর দশ বারো দিন লাগে শুকোতে। কীভাবে তৈরি করেন মহুয়া রস?
এই ফুল শুকিয়ে গেলে কিছু গাছের শেকড় বাকড় দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হয়। কয়েকদিন ভিজিয়ে রাখলে মাটির হাঁড়িতে ফুটিয়ে বাষ্প বের করে সেই বাষ্প ধরে রাখা হয়। সেটাই মহুয়া। আদিবাসী নরনারীর প্রায় সকলেরই প্রিয় রস। অবশ্য এই রসের প্রতি টান শুধু আদিবাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। গোপিবল্লভপুর ব্লকের অন্তর্গত মঙ্গলবারের ফেকো হাটে মোরগ লড়াইয়ের সঙ্গে মহুয়ার খ্যাতি ঝাড়খণ্ড থেকেও মানুষদের টেনে আনে।

দৃশ্য ৩
এই এলাকারই একটি গ্রাম বেলিয়াবেড়া। স্থানীয় মানুষ ডাকেন বেলেব্যাড়া। সপ্তাহে দুইদিন বসে হাট। বুধ আর শনিবার। ওই দুইদিনেই মজুত রাখতে হয় সপ্তাহের বাকি দিনের সবজি। নইলে যেতে হবে তপসিয়া। ক’দিন আগেও রাস্তার যা অবস্থা ছিল,  সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরের তপসিয়াই হয়ে যেত বিশ কিলোমিটারের পথ। হাটবারের দিন আলু, পেঁয়াজ, তিতির পাখি, নিজেদের ফলানো শাক সবজি, শুটকি, নিজেদের পালন করা দেশি হাঁস মুরগির ডিম নিয়ে বসেন এলাকার মানুষ। পাশে কাঠ পুড়িয়ে কাস্তে শান দিচ্ছেন দু’জন কামার। গোল করে ঘিরে আছেন গ্রামের মহিলা পুরুষ নিজের বাড়ির কাস্তে নিয়ে। 
তারই ফাঁকে কুড়ি বাইশ বছরের অমিত বসেছেন গাছের পাতার মধ্যে গুচ্ছ খানেক মরা পিঁপড়ে নিয়ে। দশ টাকা করে পাতা। অমিত কিনে আনেন লোধাশুলি জঙ্গল থেকে ৬০০ টাকা কিলো দরে। অমিত জানায়, জঙ্গলের ভিতর যাঁরা যান,  তাঁরাই গাছ থেকে পিঁপড়ের বাসা ভেঙে জোগাড় করে আনেন। পিঁপড়ের ভয়ঙ্কর কামড়ও নাকি খেতে হয় তাঁদের। ঠান্ডা-সর্দির ওষুধ এই পিঁপড়ের চাটনি। শীতকালেই চাহিদা বেশি। নাম কুর্কুট চাটনি। ধনেপাতা, লঙ্কা, পিঁপড়ে সহযোগে বাটনা বেটে তৈরি করা হয় সেই চাটনি। জঙ্গলমহল এলাকায় বেশ প্রসিদ্ধ।


 

দৃশ্য ৪ 
আবার বর্ষাকাল জুড়ে কেশিয়ারি জঙ্গল থেকে ছাতু তুলে নিয়ে এসে খড়গপুরের ইন্দা বাজারে বসেন বছর পঞ্চান্ন ষাটের সাবিত্রীদি। কখনো নিজে জঙ্গলে গিয়ে আবার কখনো পাড়ার ছেলে ছোকরাদের থেকে একশো দুশো টাকা দিয়ে জঙ্গল থেকে নিয়ে নেন এই ছাতু মানে মাশরুম। গোলাকার ছোট ছোট মার্বেলের মতো দেখতে সেগুলো। জঙ্গলের মাটি ফেটে বেরিয়ে আসে। সেখানে আছে সাপের ভয়, চিতার ভয়। দূরের বাজারে বিক্রি করেন ৩০ টাকা পোয়া দরে।  
এইরকম অসংখ্য দৃশ্য প্রতিদিন ঘটে চলেছে।
এখন জঙ্গলই যদি না থাকে এদের?
রাজ্যসভায় করা প্রশ্নের উত্তরে সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০০৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ২ লক্ষ হেক্টর জমির চরিত্র পালটে ফেলা হয়েছে। সরকারি ইন্ডিয়ান স্টেট ফরেস্ট রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী (২০২১) নথিবদ্ধ বনভূমির পরিমাণ দেশের মোট ভূমির ৫৩ শতাংশ। যদিও আরেকটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে ২৪ শতাংশ। পরিবেশবিদ সুনীতা নারায়ণ লিখেছেন ২৫০ লক্ষ হেক্টর নথিবদ্ধ বনভূমি ওই রিপোর্ট থেকে বাদ পড়ে গেছে। অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ গায়েব। 
আইনের মারপ্যাঁচ  স্বাধীন দেশের বনসম্পদ ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে প্রণয়ন করা হয়েছিল ‘বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০’। ওয়েব পোর্টালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায় সেই আইন প্রণয়নের পর থেকে গত চল্লিশ বছরে ১৫ লক্ষ হেক্টর বনভূমি উজাড় করা হয়েছে। এবং ২০১৮ থেকে বিগত মাত্র চার বছরে উজাড় করা হয়েছে ৯০ হাজার হেক্টর বন। আইন থাকতেই এই অবস্থা! এর পর তো আবার গত ২৬ জুলাই পার্লামেন্টের বাদল অধিবেশনে বন জঙ্গল সংরক্ষণের যে নতুন সংশোধিত বিল পাস করা হল, তাতে জঙ্গল লুট করার বাহ্যিক আইনি পর্দাটাও সরে গেল। যেখানে নথিবদ্ধ বনভূমি অন্যান্য কাজে ব্যবহার করতে হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের অনুমতির প্রয়োজন হতো, এখন আর তার বালাই নেই। এই সংশোধনী বিল অনুযায়ী দেশের সীমান্ত এলাকায় সর্বাধিক ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত জঙ্গলের জমিকে ‘কৌশলগত ও নিরাপত্তাগত’ কারণে অধিগ্রহণ করা যাবে, এবং তার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের অনুমতির আর প্রয়োজন নেই।  
আর্থিক প্রয়োজনীয়তা তাহলে কাদের? বন সংরক্ষণ সংশোধনী বিলটির ভূমিকাতে ‘বনাঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও পরম্পরাগত মূল্যবোধ বাঁচিয়ে রাখা’, ‘বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষিত করা’, ‘বনভূমি সংরক্ষণ’-এর মতো শব্দবন্ধের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তার কথাও বলা রয়েছে। প্রশ্ন হলো এই প্রয়োজন কাদের? সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত জঙ্গল কেটে ইচ্ছামত হাইওয়ে, রেললাইন ছাড়াও চিড়িয়াখানা, সাফারি পার্ক, ইকো ট্যুরিজম করতে পারবে কোনও পুঁজিপতি ব্যবসায়ী।

কী হবে তাহলে নরেন্দ্র দলুইদের? ছত্তিশগড়ে শেওনাথ নদীর ধারে বর্ষাকালে জাল ফেলে মাছ ধরছিলেন একালার কিছু মৎস্যজীবী মানুষ। হঙকঙ থেকে কিনে আনা দামি  স্পিড বোটে করে সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন কৈলাশ সোনি, যিনি এই শেওনাথ নদীর ২৩ কিলোমিটার অংশ বাইশ বছরের জন্য সরকারের কাছ থেকে কিনেছেন। মৎস্যজীবীদের জাল বোটে লেগে ছিঁড়ে যায় এবং নিজের কেনা নদীতে জাল বিছিয়ে মাছ ধরার অপরাধে পুলিশকে দিয়ে গরিব মৎস্যজীবীদের হেনস্তা করেন সোনি। নদীর মালিক বলেন, যতদূর চোখ যায় যে বিস্তীর্ণ জলরাশি দেখছেন তা এখন আমাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ৬ কোটি টাকা নগদ দিয়ে কিনেছি। এর পুরো কর্তৃত্ব এখন আমাদের। যা খুশি করতে পারি। বিক্রি করতে পারি বা জল আটকে দিতে পারি। জল নিতে হলে গাঁটের কড়ি খসাতে হবে। নদীর পাশে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষ যাঁরা নদীর ওপরে নির্ভরশীল তাঁদের স্নান করা, কাপড় কাচা, মাছ ধরা সবই অপরাধের তালিকাভুক্ত হলো। এখন বনভূমিতে ব্যক্তি মালিকের কর্তৃত্ব তৈরি হলে অনিল মাহাতো, নরেন্দ্র দলুই, সাবিত্রী, অমিতদের কী হবে?


তাহলে উপায়? মাছ ধরতে যাওয়া সেই মৎস্যজীবীদের একজন সেদিন আঙুল তুলে কৈলাশ সোনির উদ্দেশে বলেছিল, ‘এক ভি জাল টুটা তো আচ্ছা নেহি হোগা’। বামপন্থী দলগুলি, সমাজকর্মী এবং জনসাধারণ একজোট হয়ে সেদিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সেই আন্দোলনের জেরে কৈলাশ সোনির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়। 
মণিপুর, মেঘালয়, অরুণাচল, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড সহ দেশজুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ এই বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একটাই পথ: সকলের একজোট হওয়া।


 

Comments :0

Login to leave a comment