ইন্দ্রজিৎ ঘোষ
সারাজীবন প্রচুর পরিশ্রম করে সন্তান মানুষ করেছেন। সন্তান সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কষ্টের বিষয় সন্তান চাকরি করে বিদেশে...আমেরিকা, প্যারিস, জাপান...দেশে হলেও পুনে, ব্যাঙ্গালোর, নয়ডা...
বয়স্ক বাবা মায়ের দেখাশুনা কাজের লোকের উপর বা আত্মীয়দের উপর। সন্তানের সাথে কথা হয় মাত্র কয়েক মিনিট ভিডিও কলে।
কেবল মাত্র স্কিল বা উচ্চ মেধা সম্পন্নরাই বাইরে যাচ্ছেন এমন নয়। দক্ষিণ ভারত গামী যে কোনও ট্রেনে উঠলেই দেখা যাবে আমাদের রাজ্যের যুব সমাজের বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দিচ্ছে কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক মহারাষ্ট্র। তাঁরা কী করতে যায়? রাজমিস্ত্রী বা তাঁর জোগাড়ে, গৃহসহায়িকা, হোটেলের বয় প্রভৃতি কাজে তাঁরা যাচ্ছেন। কী করুণ অবস্থায় দিন কাটায় তাঁরা।
কারণ আমাদের রাজ্যে কাজ নেই। আমাদের রাজ্যে শিল্প নেই। প্রতিবছর শিল্প সম্মেলনে আমার আপনার ট্যাক্সের কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। গত কয়েক বছরে ১৮ লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ আসবে, মউ সই হয়েছে বলে ঘোষণা হয়। কিন্তু কারখানা হয়নি। শিল্প আসেনি। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে আসা বিনিয়োগগুলি তাড়ানো হয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময় নতুন করে গড়ে উঠেছিল হলদিয়া, বক্রেশ্বর, ক্যালকাটা লেদার কমপ্লেক্স, সেক্টর ফাইভ, ফলতা শিল্পাঞ্চল, বোম্বে রোডের ধারে সলপ, সাঁরাকাইল স্মল স্কেল ইন্ড্রাস্ট্রি...আরও অনেকগুলি। সবগুলির অবস্থা খারাপ হচ্ছে প্রতিদিন। বামফ্রন্ট সরকারের সময় হরিণঘাটা, আরামবাগ হ্যাচারি, মাদার ডেয়ারি সহ বিভিন্ন সমবায় তৈরি করে কৃষিজাত পণ্য ও ফুড প্রসেসিং শিল্প হয়েছিল। তোলাবাজি ও দুর্নীতির কারণে তাদের অবস্থাও শোচনীয়।
শিল্পে বিনিয়োগ আসবে তখনই যখন পরিকাঠামো উন্নত হবে। বামফ্রন্ট সরকারের সময় রায়চক-বারাসাত রাস্তা, অণ্ডাল বিমানবন্দর, কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে, ৩৪ নং জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ, দীঘা-হাওড়া রেল লাইন, মেট্রো রেল, কলকাতা শহরের ও শহরতলির যানজট কমানো জন্য ফ্লাইওভার, বেহালা বিমানবন্দর একাধিক কাজ বামফ্রন্ট সরকার করেছিল।
এই সরকার কি করেছে? কেন বঙ্গোপোসাগরে কোনও ল্যান্ডিং স্টেশন হচ্ছে না? যেখানে চেন্নাইতে ৩ টা, মুম্বাইতে ৪ টা ল্যান্ডিং স্টেশন? কেন তাজপুর ডিপ সী পোর্ট তৈরিতে এত সময় লাগছে? উত্তর নেই সরকারের কাছে।
বিগত দিনে যা পরিকাঠামো ছিলো তাও নষ্ট করা হচ্ছে। আমাদের রাজ্যে গত ১০ বছরে কলকাতা বন্দর আর আগের জায়গায় নেই, হলদিয়া বন্দরের অবস্থাও ভালো নয়।
এই অযোগ্যতা ঢাকতে প্রচার করা হয় যে, ৩৪ বছর জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের জন্যই নাকি পশ্চিমবঙ্গ শিল্পে মরুভূমি হয়েছে। প্রশ্ন হলো ২০১১ সালের পর সেখানে অনেক কারখানা বন্ধ হয়েছে তার কারণ কি? ২০১১ সালের পর আমাদের রাজ্যে প্রায় ৮০০০ ছোট বড় কারখানা, ওয়ার্কশপ বন্ধ হয়েছে। তার কারণ কি? ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন না তোলাবাজি? বন্ধ কারখানার জমিতে নতুন কারখানা হয়েছে? নাকি প্রোমোটিং হয়ে হাউজিং হয়েছে, হাইরাইজ বিল্ডিং হয়েছে? কয়েক হাজার প্রোমোটিং হয়েছে। হাওড়া, কলকাতার এন্টালি, বেলেঘাটা, বারাকপুর, দমদম, বিরাটি, বেলঘড়িয়া, কলকাতা শহর ও শহরতলির একাধিক ছোট বড় কারখানা বন্ধ হয়েছে। প্রায় সবগুলিতে প্রোমোটিং হয়ে আজ হাইরাইজিং বিল্ডিং হয়েছে। এই প্রোমোটিংয়ে যুক্ত কারা?
কারখানার জমিতে প্রোমোটিং হয়েছে। শ্রমিক কাজ হারিয়ে হকারি করছেন, দিন মজুরি করছেন। কেউ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে অন্য রাজ্যে চলে গেছেন। নাহলে বেকার হয়ে গেছেন। পড়াশোনা বন্ধ হয়েছে শ্রমিক পরিবারে সন্তানের। চিকিৎসার অভাবে রুগ্ন হয়েছে শ্রমিকের পরিবার।
শিল্প নেই, যুবদের কর্মসংস্থান নেই এক ভয়াবহ পরিস্থিতি।
সিঙ্গুরে হওয়া কারখানা চলে যাওয়া, শালবনী ও রঘুনাথপুরে কারখানা না হওয়া, উত্তরবঙ্গ থেকে ভিডিওকন চলে যাওয়ার মতো ঘটনা আমাদের বিপদ ডেকে এনেছে। লোকের আয় কমেছে, কর্মসংস্থান নেই। ফলে উৎপাদিত পণ্যের বাজার কম।
বিনিয়োগ আনতে গেলে এই রাজ্যের পরিবেশকে পরিবর্তন করতে হবে, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে নয়। শ্রমিক কখনও চায় না যে কারখানা বন্ধ হোক। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে যে কারখানাগুলি বন্ধ হয়েছিল সেই কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ নিয়ে একটা সমীক্ষা করেছিল। দেখা যায় মাত্র ১.৭৮% কারখানা বন্ধের কারণ ছিল শ্রমিক আন্দোলন। বাকিগুলির অন্য কারণ। ১৯৯১ সালে নিও লিবারাল ইকনোমিক চালু হওয়ার পর প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে না পেরে বন্ধ হয়েছে প্রচুর কারখানা। কাজ হারিয়েছেন প্রচুর শ্রমিক।
বেশকিছু কোম্পানি আইটি সেক্টর, অটোমোবাইল সেলস অ্যা ন্ড সার্ভিস, রিটেইলার সেকশন, বিভিন্ন হোয়াট কলার জবে কর্মীরা তো বটেই, এমন কি ওলা, উবের রেপিডো ইনড্রাই, ফ্লিপকার্ট , তথ্যমিত্র কেন্দ্র, জোম্যাটো, সুইগি এই সমস্ত সেক্টরের কর্মীরা এই সময়ে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে ইউনিয়ন তৈরি করছেন। একটা সময় ছিল সেক্টরের কর্মীদের ধারণা ছিল ইউনিয়ন করা একটা অন্যায় কাজ।
লাল ঝান্ডার প্রতি আকর্ষণ অনেকেরই ছিল না। নিজেদের প্রয়োজনে, অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন কর্পোরেটদের শোষণের থেকে বাঁচাতে গেলে লাল ঝান্ডাই সম্বল। শ্রমিক চায় তার ন্যায্য মজুরি। সে আন্দোলন করে তার সেই ন্যায্য মজুরি, বোনাস, মজুরি বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষার জন্য। আন্দোলন করে তার ও তার পরিবারের বেঁচে থাকা, আগামী প্রজন্মের শিক্ষা ও পরের দিনে শ্রম বিক্রি করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য। মালিক সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিস দেয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। আর এই সাসপেনশান অব ওয়ার্কের বিরুদ্ধে কারখানা খোলার আন্দোলন করতে হয় শ্রমিকদের সংগঠনকেই। দেশের সংবিধান তাদের দিয়েছে শ্রম আইন, লেবার কোর্ট, লেবার ট্রাইবুনাল।
কিন্তু বর্তমান কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকার তাদের এই অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
কর্পোরেটদের মুনাফার স্বার্থে ১৮৬টি শ্রম আইনে পরিবর্তন করে ৪টি শ্রম কোড তৈরি করছে। যেখানে শ্রমিককে ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ১২ ঘণ্টা কাজ করানো যেতে পারে। মজুরির থেকে ওভারটাইমের ভাতা, ছুটির ওয়েজ, মাতৃত্বকালীন ছুটি বাদ দেওয়া হয়েছে। কোনও কারখানা বা সংস্থায় ২০ জনের কম থাকলে বোনাস না দিলেও চলবে। সংস্থায় ২০ জনের কম থাকলে পিএফ না দিলেও চলবে। ন্যূনতম সামজিক সুরক্ষার বালাই থাকবে না। ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। ইউনিয়নের রেজিষ্ট্রেশন করাতে গেলে মালিকের অনুমতি লাগবে। মানে আর রেজিষ্ট্রেশন করানোই সম্ভব হবে না। ৩০০-র কম শ্রমিক থাকলে ইউনিয়ন করার অধিকার থাকবে না। কোনও সংস্থায় ইউনিয়ন করতে গেলে আগে ন্যূনতম ৭ জন শ্রমিক একত্রিত হলেই করতে পারত এই শ্রম কোডে ন্যূনতম ১০০ জন অথবা মোট শ্রমিকদের ১০% হতে হবে। এর ফলে অনেক সংস্থা আর ইউনিয়ন করা সম্ভব হবে না। মহিলা শ্রমিকদের নাইট ডিউটি করানোর ক্ষেত্রে সুরক্ষার নির্দিষ্ট মানদণ্ড ছিল বর্তমানে তা তুলে নেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে।
বেকার যত বাড়ছে শ্রমিকের বারগেনিং ক্ষমতা তত কমছে। শ্রমিকের উপর আক্রমণ যত বাড়ছে প্রতিরোধে আন্দোলনও তত বাড়ছে। প্রতিদিন রাস্তায় আন্দোলনের ঝাঁজ বাড়ছে। প্রতিদিন পরিষ্কার হচ্ছে আরও বড় লড়াই করা দরকার। লড়াইয়ের জন্য চাই আরও বড় প্ল্যাটফর্ম।
ইনসাফের দাবিতে গত ৩ নভেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর ইনসাফ যাত্রা করেছে ডিওয়াইএফআই। ব্যাপক অংশের মানুষ মিলিত হয়েছেন এই পদযাত্রায়। কারখানা থেকে বেরিয়ে, গিগ ওয়ার্কাররা ডেলিভারি করতে করতে অনেকেই এই ইনসাফ যাত্রায় পা মিলিয়েছেন। অনেকে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিয়েছেন ইনসাফ যাত্রীদের। নিজেদের কষ্টার্জিত টাকাও তুলে দিয়েছেন ইনসাফ যাত্রীদের হাতে। অনেকে হাঁটতে না পারলেও সোশাল মিডিয়াতে ইনসাফ যাত্রার পোস্ট করেছেন।
তাঁরা থাকবেন ব্রিগেডের সমাবেশে। নিজেদের লড়াইকে সংহত করতে, বৃহত্তর লড়াইয়ে নিজেদের শামিল করতে আগামী রবিবার ব্রিগেডে থাকবে বাংলার শ্রমিক শ্রেণি। তাঁদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হাজির হবেন ব্রিগেডের সমাবেশ। উপলব্ধি এটাই— লড়াইয়ে ময়দানে বন্ধু চাই। বৃত্ত বাড়াতে হবে। শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে শোষিত মানুষদের সবাইকে এক করতে হবে। তবেই ধাক্কা দেওয়া সম্ভব।
Comments :0