Iranian women right

ইরানে মেয়েদের সাহসী লড়াইয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো সরকার

আন্তর্জাতিক

ঘরে-বাইরে তীব্র আন্দোলনের জেরে শেষ পর্যন্ত কি মেয়েদের হিজাব পরা নিয়ে প্রশাসনিক কঠোরতা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ইরান? দেশের অতি-রক্ষণশীল হিজাব আইনও কি নতুন করে খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার? ইরানের পথে-ঘাটে হিজাব-হীন মহিলাদের ওপর দমনপীড়ন চালানোর ‘নীতি পুলিশ’ বাহিনী ‘গস্ত-এ-এরশাদ’র তৎপরতাও কি ইতিমধ্যে স্থগিত রাখা হয়েছে? সরকারিভাবে কোনও ঘোষণা না হলেও ইরানের প্রসিকিউটর জেনারেল মহম্মদ জাফর মন্তাজেরির তাৎপর্যবাহী মন্তব্যে এব্যাপারে জোর গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
সংবাদসংস্থা আইএসএনএ জানাচ্ছে, তেহরানে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শনিবার মন্তাজেরি জানান, ‘‘গস্ত-এ-এরশাদের যাবতীয় তৎপরতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’’ অনুষ্ঠানে এক শ্রোতা তাঁর কাছে জানতে চান, ‘‘কয়েকদিন ধরে গস্ত-এ-এরশাদের লোকজনকে রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না কেন?’’ জবাবে মন্তাজেরি বলেন, ‘‘ওই নীতি পুলিশের সঙ্গে কোনোদিনই দেশের কেন্দ্রীয় বিচারব্যবস্থার সম্পর্ক ছিল না। ওই বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।’’ 
প্রসঙ্গত, মাত্র শুক্রবারই মন্তাজেরি জানিয়েছিলেন, ‘‘মহিলাদের মাথা ঢেকে রাখার আইনটিতে বদলের দরকার রয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখছে সংসদ এবং বিচারবিভাগ।’’ এই মন্তব্যের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি নীতি পুলিশ বাহিনী প্রত্যাহারের কথা জানালেন। তবে রবিবার পর্যন্ত এব্যাপারে সরকারিভাবে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়নি। এই নীতি পুলিশ বাহিনীকে ঠিক কতদিনের জন্য ‘প্রত্যাহার’ করা হয়েছে, তা কি চিরকালের জন্য? এনিয়েও অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু জানাননি মন্তাজেরি। এই ‘গস্ত-এ-এরশাদ’ কথার অর্থ হলো ‘পথপ্রদর্শক বাহিনী’। ২০০৬ সালে ইরানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ এই বাহিনী তৈরি করেছিলেন। দেশে হিজাব সংস্কৃতি ঠিকঠাক পালিত হচ্ছে কিনা তার নজরদারি ছাড়াও এব্যাপারে মেয়েদের ‘শালীনতার’ পাঠ দিতেই এই নীতি পুলিশ বাহিনীর সৃষ্টি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, মন্তাজেরি-কথিত ‘বিচারব্যবস্থার অন্তর্গত’ না হলেও দেশের একজন রাষ্ট্রপ্রধানই এর স্রষ্টা। তার ওপর এই নজরদার বাহিনীকে এতদিন পর্যন্ত কাজেও লাগিয়েছে সরকার।
মহিলাদের পোশাকবিধি নিয়ে গোঁড়া ইসলামিক শাসকদের বেপরোয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে গত দু’মাস ধরে জোরদার বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন ইরানের মহিলারা। পোশাকবিধি লঙ্ঘনের দায়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর ২২ বছর বয়সি মাশা আমিনিকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল গস্ত-এ-এরশাদ। তার ক’দিন পরে পুলিশি হেপাজতেই রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয় কুর্দ অঞ্চলের বাসিন্দা এই তরুণীর। পুলিশই নির্মম অত্যাচার চালিয়ে মাশাকে খুন করেছে বলে জোরালো অভিযোগ ওঠে। 
মাশাকে খুনের ঘটনায় ইরানে ধর্মীয় শাসকদের লাগাতার অত্যাচারে বহুদিন ধরে ফুঁসতে থাকা মহিলাদের ক্ষোভের আগুন কার্যত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানী তেহরান সহ ইরানের বিভিন্ন শহর ও উপকণ্ঠে নানা বয়সি হাজার হাজার মহিলা রীতিমতো রাস্তায় নেমে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করেন। হিজাব খুলে, চুল কেটে রক্ষণশীল ইসলামিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ চলতে থাকে। ঘটতে থাকে অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুরের ঘটনাও। শহীদ মাশার ছবি হাতে নিয়ে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন অকুতোভয় মেয়েরা। 
দ্রুত দেশের অন্যান্য অংশের সমর্থনও জড়ো হয় মহিলা আন্দোলনের পাশে। ইরানে মেয়েদের এই আন্দোলন ক্রমশই সরকার-বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়। রক্ষণশীল মৌলবাদী সরকারের ইস্তফার দাবিও উঠে যায় দেশজুড়ে। আন্দোলনের রিপোর্ট করতে গিয়ে সংবাদসংস্থা রয়টার্সও জানিয়েছে, ইরান সরকারের ব্যাপক দমনপীড়নের মধ্যেও বিক্ষোভকারীরা দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খোমেইনির বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন। ইসলামিক সরকারের অবসানে বারবার দাবি জানাচ্ছেন।
মাত্র কয়েক দিন আগে সকলকে চমকে দিয়ে কাতারে চলতি বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠেও পৌঁছে গিয়েছিল ইরানের প্রতিবাদী লড়াইয়ের আঁচ। যাবতীয় রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিশ্বকাপের প্রথম খেলায় প্রথামাফিক দেশের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে গলা মেলাননি ইরানের প্রতিবাদী খেলোয়াড়রা। গ্যালারিতেও দেখা যায় মাশা আমিনির নাম লেখা জার্সি পরে ইরানের তরুণীদের নীরব প্রতিবাদ। ইরানের লড়াকু মেয়েদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিশ্বের নানা দেশের রাজপথেও গণবিক্ষোভ চলেছে প্রায় প্রতিদিনই।
টানা দু’মাসের এই লড়াইয়ের মাঝেই প্রতিবাদী মহিলাদের দাবির কাছে ইরানের গোঁড়া মৌলবাদী শাসকের মাথা নোয়ানোর খবর ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বজুড়ে যুগপৎ আগ্রহ ও চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। প্রায় সকলেরই ধারণা, ইরানের প্রসিকিউটর জেনারেল মন্তাজেরির বক্তব্যের যথার্থতা যদি সত্যিই প্রমাণিত হয় তাহলে এই ঘটনাপ্রবাহের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বেই। ইরানের মেয়েদের এই বিপুল বিজয় পরিবর্তনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment