Rohith Vemula

রোহিত ভেমূলা: আম্বেদকর যাঁর প্যাশন

ফিচার পাতা

 দেবেশ দাস

১৭ জানুয়ারি, ২০১৬। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। চুপি চুপি হস্টেলের একটি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ছেলেটি। হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। এ জীবন সে রাখবে না। দড়ি এনেছে। বন্ধ ঘরের সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলিয়ে দেবে শরীরটা। হস্টেলের এই ঘরটা তাঁর নয়, তার এক বন্ধুর। হস্টেলে তাঁর একটা ঘর ছিল, এখন নেই। কারণ তাঁকে হস্টেল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। খিদে পেয়েছে কী? অবান্তর প্রশ্ন। খাওয়ার কোনো পয়সা তার ছিল না। মাসে মাসে ২৫০০০ টাকা করে  স্কলারশিপ পেয়েছিল, গত প্রায় ৭ মাস ধরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে বাকিতে খাওয়া যেত হস্টেলের ক্যান্টিনে, এখন বলে দেওয়া হয়েছে সেখানে যেন তাঁকে খাবার দেওয়া না হয়। খিদের কোনো অনুভূতি নেই।  তার নিজের খিদের চেয়েও বড় প্রশ্ন, শক্ত সমর্থ ২৬ বছরের ছেলেটি তার মাকে সংসারের টাকা পাঠাতে পারছে না। জনমদুঃখিনী দলিত মা, লোকের বাড়িতে কাজ করে দুই ভাই ও এক বোনকে মানুষ করেছে। সেই মাকে টাকা পাঠাতে না পারলে, আত্মহত্যা ছাড়া কোনও পথ থাকে? কোনও প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বা পরীক্ষায় ফেল করে সে আত্মহত্যার পথ বাছেনি। 

সময় বেশি নেই। কেউ এসে পড়লে মুশকিল। আর মাত্র কয়েক মিনিট। তার আগে একটা শেষ কথা লিখতে হবে। খসখস করে ছেলেটা লিখে ফেলল সুইসাইড নোট। জীবনের শেষ লেখা। শেষ চিঠি। নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানায় নয়, নির্দিষ্ট কাউকে নয়।  আকাশের ঠিকানায়, দুনিয়াকে লেখা চিঠি। না, কাউকে দায়ী করার জন্য চিঠি লিখতে বসেনি। কাউকেই দায়ী করতে চায় না, তার শত্রুদেরও নয়। একদম আনুষ্ঠানিকভাবে লিখে যেতে হবে যে তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, শত্রু হোক বা মিত্র, কাউকেই যেন হয়রান করা না হয়। জন্ম অন্ধ্র প্রদেশের গুরজালা টাউনে। আজ মনে হচ্ছে - তার 'জন্মটাই এক বিপজ্জনক দুর্ঘটনা’ যাতে মৃত্যু অবধারিত। সেই মৃত্যুটাই শেষ পর্যন্ত এল তার নিজেরই হাত ধরে। বেঁচে থাকলে নানা বঞ্চনা, লাঞ্ছনা, অপমান। মৃত্যুতে সে সব ঝামেলা নেই। ‘বাঁচার চেয়ে মরেই আমি ভালো থাকবো'- লিখে দিল রোহিত। 

কার কথা মনে পড়ছে? ভীমের কথা। জীবনের নানা লাঞ্ছনা, অপমানে লড়তে লড়তে যার কথা ভেবে মনে সাহস জুগিয়েছেন সেই ভীমের কথা। রোহিত তার সুইসাইড নোটের শেষের দিকে লিখে ফেলল  - "শেষ বারের মতো এক বার বলি - জয় ভীম"।  'ভীম’ মানে ‘ভীম রাও রামজি আম্বেদকর'। জীবনের এক আদর্শ ছিল আম্বেদকর। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে রোহিত যোগ দিয়েছিল আম্বেদকর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন নামক ছাত্র সংগঠনে। আম্বেদকরের নামে সংগঠনের সাথে বিজেপি’র ছাত্র সংগঠন এবিভিপি’র বিরোধ। এবিভিপি’র এক সদস্য রোহিত সহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল যে তাঁকে ওরা মেরেছে। কর্তৃপক্ষ দু’-দু’বার নানা তদন্ত করে বলে দিয়েছিল রোহিতরা নির্দোষ। কিন্তু দু’জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বঙ্গারু দত্তারেয় ও স্মৃতি ইরানি বারবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চাপ দিয়ে রোহিত সহ পাঁচজনকে শাস্তি দেয় আর কোনও তদন্ত ছাড়াই। 

রোহিতের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে হইচইয়ে থানায় পুলিশ কেস রুজু করতে বাধ্য হয়, কেন্দ্রীয় সরকার উপাচার্যকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায়। সেই উপাচার্যকে পরের বছর ২০১৭-র জানুয়ারিতে বিজ্ঞান কংগ্রেসে  মিলেনিয়াম ফলক সম্মান (millennium plaque of honour) দেওয়া হয়। তিনি বিজ্ঞানের গবেষণা করতেন ঠিকই, কিন্তু তিনি যে এত বড় বিজ্ঞানী তা আগে কেউ কোনোদিন শোনেনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন। আর সেই পুলিশ কেস? তেলেঙ্গেনা পুলিশ এক ৬০ পাতার রিপোর্ট তেলঙ্গানা হাইকোর্টে পেশ করে জানিয়েছে যে ব্যক্তিগত কারণে রোহিত আত্মহত্যা করেছে।  

এবিভিপি’র বিরোধী সংগঠন করার জন্যই কি রোহিতদের বিপত্তি? বিপত্তি আসলে দলিত হওয়ার জন্য। প্রতি বছরই কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এরকম ভাবেই অনেক দলিত ছাত্র আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছে। রোহিত এক চিঠিতে উপাচার্যকে লিখেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত ছাত্রদের প্রতি যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়, তার জন্য ভর্তি হওয়ার সময়েই কর্তৃপক্ষ এই ছাত্রদের জন্য বিষ দিয়ে দিতে পারে। দলিতদের প্রতি এই বঞ্চনার বিরুদ্ধেই রোহিতরা বাচতে চেয়েছিল আম্বেদকরকে ধরেই। তাদের সংগঠনের প্রিয় স্লোগান তাই 'জয় ভীম', সেটাই সে আবার লিখেছিল তার জীবনের শেষ চিঠিতে। 

শুধু রোহিত নয়। সারা দেশে প্রায় প্রতি ৭ ঘণ্টায় একজন  দলিত বা আদিবাসী খুন হন, প্রতি দেড় ঘণ্টায় কোনও দলিত বা আদিবাসী মহিলা ধর্ষিতা হন,  প্রতি ৮ মিনিটে কোনও দলিত বা আদিবাসীর উপর আক্রমণ হয়।  খুন, ধর্ষণ ও আক্রমণ ২০১৩ সালের তুলনায় যথাক্রমে বেড়েছে ৫০, ৯২ ও ৪৬ শতাংশ।  সেই দলিত আদিবাসীদের কাছে আশ্রয়স্থল বাবা সাহেব আম্বেদকর। তারা  নিপীড়নের সময় আম্বেদকরকে স্মরণ করে,  লড়াই করার সময় স্লোগান দেয়— 'জয় ভীম'।  আম্বেদকর তাঁদের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন যে আম্বেদকরের নাম উচ্চারণটা ফ্যাশন হয়ে দাড়িয়েছে, এতবার আম্বেদকর উচ্চরণ না করে ভগবানের নাম করলে সাত জন্মের স্বর্গবাস হয়ে যেত। দলিতরা স্বর্গ চায় না, মর্তের মাটিতে মানুষের মতো বাঁচতে চায়। তারা আম্বেদকরকে আঁকড়ে ধরে, কারণ তিনিই তাদের বাচার কথা শিখিয়েছিলেন। তাই অনেক দলিতদের কাছেই আম্বেদকর ঈশ্বর হয়ে যান। আম্বেদকরের প্রতি দলিতদের এই শ্রদ্ধা দেখেই অরুন শৌরি একটা মোটা বই লিখে আম্বেদকরকে বলেছিলেন  ’ভণ্ড ঈশ্বর’। তার ফল স্বরূপ বিজেপি তাকে  সাংসদ করে, মন্ত্রীও করে।      

কিন্তু, শত আক্রমণেও আম্বেদকর ম্লান হয় না, ম্লান হয়নি। যত আক্রমণ বাড়ে, দলিত-আদিবাসীদের কাছে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে আম্বেদকর। আম্বেদকর তো শত শত বছর ধরে তাদের বঞ্চনার বিরুদ্ধেই লড়েছিলেন। রোহিত ভেমুলার মতো তাদের কাছে আম্বেদকর ফ্যাশন নয়, প্যাশন। মানে এক তীব্র অনুরাগ, এক অকৃত্রিম ভালোবাসা।      

Comments :0

Login to leave a comment