Tiger Bengal

বাঘবন্দির খেলায় এবার জিতলো বাংলা

রাজ্য

অপরাজিত বন্দ্যোপাধ্যায় 

ওডিশার সিমলিপালে রয়্যাল বেঙ্গলের রূপ বদলে গেছে। কালো ডোরা কাটা বাঘ সেখানে হয়ে যাচ্ছে কালো। দেশের চতুর্থ বৃহত্তম ব্যাঘ্র প্রকল্পে এমন হতে থাকায় দারুণ উদ্বেগে ভারতের ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞরা। আর সেই জন্যই মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে সিমলিপালে নিয়ে আসা হয় জিনাত ও যমুনা নামের দুই বাঘিনিকে। উদ্দেশ্য ছিল জিনাত বা যমুনা যদি সিমলিপালে ফের ডোরা কাটা বাঘের প্রজন্ম ফিরিয়ে আনতে পারে।
দুই বাঘিনির মধ্যে একজন পালিয়ে গেলে, চিন্তাও বাঁধবেই। সেটাই হয়েছে ওডিশা বন বিভাগের আধিকারিকদের। কিন্তু কিছুতেই সিমলিপালে মন টিকছে না ভিন রাজ্যের বাঘিনিদের। কালঘাম ছুটছে ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। তাই জিনাত পালাতেই ওই ব্যাঘ্র প্রকল্পের আইএফএস পদমর্যাদার ইস্ট, ওয়েস্ট ফিল্ড ডিরেক্টর সবাই রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেরিয়েছে। কখনো ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল তো কখনো এই বাংলায়।
ওডিশার প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) পি কে ঝা জানাচ্ছেন, সিমলিপালে এখন যে ৩৫টি বাঘ রয়েছে, তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি শরীরে দেখা গেছে কালচে রং। যেন কেউ ‘ময়লা’ করে দিয়েছে বাঘের পিঠ। সিমলিপালে থাকা বাঘেরা নিজেদের মধ্যেই ‘মেটিং’ করছে। হয়তো কোনও একটা বাঘের জিন মেলানিস্টিক। তার জিনগত বৈশিষ্ট্য গোটা ব্যাঘ্র প্রকল্পে ছড়িয়ে পড়েছে। আর তার জেরেই একের পর এক বাঘেদের গা কালো বানিয়ে দিয়েছে।  
সিমলিপালের রয়্যাল বেঙ্গলের এমন বিকৃত রূপ চোখে পড়ে ১৯৯৩ সালে। এর পোশাকি নাম ‘সিউডো-মেলানিস্টিক টাইগার’। ২০২৪ সালে প্রথমে সিমলিপালে এই আধা কালো রং বাঘ বেড়ে গেছে। তাতেই চিন্তার রেখা দেখা যায় ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞদের কপালে। এমনকি ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন কর্তৃপক্ষের কর্তারা আশঙ্কা করতে থাকেন, এইভাবে চলতে থাকলে রয়্যাল বেঙ্গলের সেই পুরানো চেহারাটাই হারিয়ে যাবে না তো ! 
কালো পিঠের ওই বাঘকে আর রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বলে দাবি করা যাবে কী ? এই নিয়ে নাওয়াখাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছিলেন ওডিশার বন আধিকারিকরা। তাঁদের কথায়, চুলে মেলানিন থাকার কারণে কালো রঙের চুল হয়। বয়স বাড়লে মানুষের চুল সাদা হয় মেলানিনের পরিমাণ কমে যাওয়ার জেরে। পশ্চিম ভারতে যে কালো চিতা বাঘ (ব্ল্যাক প্যান্থার) দেখতে পাওয়া যায় তাও ঘটেছে ওই মেলানিজম। সিমলিপালের বাঘেদের চামড়ায় মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
তাই এদের পিঠের দিকটার রং কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। একনজরে দেখলে মনে হয় বাঘের পিঠে যেন কেউ আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে। ওই বাঘকে  মেলানিস্টিক টাইগার বা কালো বাঘ বলে। রয়্যাল বেঙ্গলের ওই হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা রূপ বদলে গেলে ভবিষ্যতে কী হবে, সেটাই ভাবাচ্ছিল বাঘ বিশেষজ্ঞদের।  
বাঘের এই রূপ বদলে ওডিশা সরকার বেজায় চিন্তিত হলেও তাদের পর্যটন দপ্তর সেই বিকৃত রূপ দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছে ‘কালো বাঘ সাফারি’। পিঠে কালো দাগের বাঘকে পুরোপুরি কালো বাঘও করা যাচ্ছে না। তাই ওডিশা ব্যাঘ্র প্রকল্পের বাঘের গায়ের হলুদ ডোরাকাটা ফিরিয়ে আনতে ২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর জিনাত ও যমুনা নামে দুই বাঘিনিকে মহারাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসা হয়।  
বাঘিনির পিছু করা বাহিনীর চিন্তা বাড়াচ্ছিলো লালগড়ের ঘটনা। পাকড়াও করতে বেশি দেরি হওয়ার জন্য ২০১৮ সালে লালগড়ের গ্রামবাসীরা পিটিয়ে মেরেছিলো এক রয়্যাল বেঙ্গল’কে।   তাই কম সময়ের মধ্যে বাঘিনিকে কুপকাত করতে ডাকা হয়েছিল সুন্দরবনের বাঘবন্দির দলকে। শেষে বাঁকুড়ার গোঁসাইডিহি গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে জিনাত’কে পাকড়াও করে সুন্দরবনের সেই দল। বাঘিনিকে ঘুম পাড়ানি গুলি ছুঁড়ে চূড়ান্ত সফল হয়েছেন তাঁরা। 
দুই দুইবার ঘুম পাড়ানি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও মনোবল কমেনি সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের ডেপুটি রেঞ্জার মৃত্যুঞ্জয় বিশ্বাসের। শেষ হাসিটি তিনিই হেসেছেন। নিখুঁত ছোড়া ঘুমপাড়ানির সঙ্গে ওষুধের মাত্রা এতটাই যথাযথ ছিল যে জিনাত একদিনেই ফের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেছে। ২৯ ডিসেম্বর ঘায়েল হওয়ার পর কলকাতার আলিপুর পশু হাসপাতালে একদিনের চিকিৎসার পর ৩১ ডিসেম্বর রাতে রওনা দেয় সিমলিপালে। 
জিনাত ২৮ নভেম্বর থেকে ঘরছাড়া। প্রথমে ঝাড়খণ্ডে জামশেদপুর বনবিভাগ হয়ে চাকুলিয়ার জঙ্গলে আসে সে। বেলপাহাড়ির কাঁকরাঝোড়ে দিনদুয়েক ছিল বাঘিনি। তারপর ময়ূরঝরনা হয়ে পুরুলিয়ায় রাইকা পাহাড়ে যায়। খাবার, জল ও পাহাড় লাগোয়া জঙ্গলে বাসস্থান অনুকূল থাকায় সেখানেই দিব্যি সে ছিল। তবে বনদপ্তরের কর্মীরা হাতি তাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করে। 
হুলাপার্টি, মশাল, পটকায় বিরক্ত হয়ে বাধ্য হয়ে জিনাত বন ধরে লোকালয়ে চলে আসে। মানবাজারের ডাংরডির জঙ্গলে ছিল সে। আর তাতেই শুরু হয় আতঙ্ক। বন কর্মীদের পাতা জালের নিচ থেকে একবার জিনাত পালিয়েও যায়।  মুকুটমণিপুরের কংসাবতী জলাধারের কোল ঘেঁষা রানিবাঁধ ব্লকের বন পুকুরিয়া ডিয়ার পার্কের কাছে গোঁসাইডিহিতে চলে যায়। বন দপ্তরের হিসাব বলছে, সিমলিপাল ছাড়ার পর থেকে ২১ দিনে জিনাত  প্রায় ৩০০ কিলোমিটার এলাকা চষে বেরিয়েছে।  
পশু ফাঁদ পেতে জিনাতকে ধরার বারংবার চেষ্টা করা হলেও, সে শিকার করে খেতে ভালোবাসে। তাই ফাঁদে ধরা যায়নি। শেষে বাঘিনির ঘুরে বেড়ানোর এলাকায় কমিয়ে কমিয়ে ঘুম পাড়ানি (ট্যাংকুলাইজার) গুলি দিয়ে কবজা করতে হয়েছে। তবে বাঘিনির গতিপ্রকৃতি জানতে গলায় থাকা রেডিও কলার খুব কাজে এসেছে। সামান্য মাত্রার ওষুধ দিয়েই নিস্তেজ করা গেছেন ‘জিনাত’কে।  
এই নিয়ে জিনাত দুই বার পালিয়েছে। তাই এবারে তাঁকে আরও চোখে চোখে রাখা হবে।   ওডিশার প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) পি কে ঝা জানিয়েছেন, ‘‘আমরা প্রাথমিকভাবে দীর্ঘ সময়ের জন্য সিমলিপালের একেবারে কোর এলাকায় একটি সফট এনক্লোজারের মধ্যে জিনাতকে রাখব। যাতে সে নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। ওর গলায় রেডিয়ো কলার পরানো থাকবে। তার মাধ্যমে আমরা এনক্লোজারের মধ্যে বাঘিনির গতিবিধির উপর নজর রাখব।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment