অনিল কুণ্ডু: জয়নগর
জয়নগররের তৃণমূল নেতা খুনের ঘটনায় নিহতের এক আত্মীয় এবার পুলিশের সন্দেহের তালিকায়। সেই ব্যক্তি নিহত সইফুদ্দিন লস্করের খুড়তুতো ভাই। লাগোয়া একটি গ্রামের বাসিন্দা সেই ব্যক্তির সঙ্গে সইফুদ্দিনের গোলমাল চলছিল। পুলিশ তা জানতে পেরেছে।
এদিনই জয়নগর থানার আইসি বদল হয়েছে। রাকেশ চ্যাটার্জিকে সরিয়ে জয়নগর থানার আইসি করা হয়েছে পার্থসারথি পালকে। তিনি বারুইপুর জেলা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে ছিলেন। সইফুদ্দিন খুনের পাঁচ দিন পরেই জয়নগর থানার আইসি-কে সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ বিভিন্ন প্রশ্ন হাজির করেছে। পুলিশের একাংশ বলছেন, রাকেশ তৃণমূলের নির্দেশ অনুসারে পুরোপুরি তদন্ত করতে চাইছিলেন না। অবশ্য আর এক অংশের মত, তৃণমূলের ‘সন্দেহজনক’ গোষ্ঠীর সঙ্গে রাকেশের যোগাযোগ ছিল।
শুক্রবার বারুইপুর পুলিশ জেলার এক আধিকারিক বলেছেন, ‘‘এদিকে স্থানীয়দের থেকে এবং অন্যান্য আরও কিছু সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, ওই আত্মীয়কে রাস্তার সুপারভাইজারের কাজ দিয়েছিলেন সইফুদ্দিনই। কিন্তু এলাকায় সাট্টা, জুয়া সহ বিভিন্ন কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেই ব্যক্তির সঙ্গে গোলমাল চলছিল সইফুদ্দিনের।’’
বামনগাছি অঞ্চলের তৃণমূলের সভাপতি সইফুদ্দিন লস্করই এলাকার সব ভাগ বাটোয়ারা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর কথা না শুনলে পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করানো, আবার টাকা নিয়ে থানা থেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা— সব কিছুই করতেন সইফুদ্দিন। জয়নগর থানায় কালীপুজো ও মোচ্ছব হয় তাঁর টাকাতেই। বামনগাছির বাসিন্দারা তা জানাচ্ছেন। ফলে তৃণমূল নেতা সইফুদ্দিন লস্করের বিরুদ্ধে তার সেই ভাইয়ের মতোই তৃণমূলের নেতা, কর্মীদের একাংশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমছিল। এই খুনের ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ, এমনই অভিমত বামনগাছি অঞ্চলের বাসিন্দাদের। পুলিশও তা উড়িয়ে দিতে পারছে না। বিশেষত, কে দিয়েছিল খুনের সুপারি, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও ধৃত শরিফুলের থেকে স্পষ্ট জানতে পারেনি পুলিশ। সইফুদ্দিন খুন হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই যাকে তৃণমূলীরা বেধড়ক মেরে খুন করেছিল, সেই সাহাবুদ্দিন চালিয়েছিল গুলি এবং সেই আসলে জানত, সুপারি যে দিয়েছে তার নাম।
এদিকে খুনের ঘটনায় ধৃত আনিসুর লস্কর ও কামালউদ্দিন ঢালিকে শুক্রবার বারুইপুর আদালতে হাজির করা হলে বিচারক তাদের ১১ দিন পুলিশ হেপাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এদিন রাজ্য পুলিশের এডিজি (সাউথ বেঙ্গল) সিদ্ধিনাথ গুপ্তা, ডিআইজি প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ আকাশ মাঘারিয়া, পুলিশ সুপার পলাশ চন্দ্র ঢালি ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাঁরা এই খুনের ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গেও কথা বলেন। পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, এই খুনের ঘটনায় আরও ৭-৮ জন জড়িত রয়েছে। খুনের কারণ এখনই বলা যাচ্ছে না। ১১ দিনের জন্য পুলিশ হেপাজতে আনা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ চলবে। তদন্ত চলছে।
তবে সাহাবুদ্দিনকে বেধড়ক মেরে খুন ও দলুয়াখাকিতে হামলার ঘটনা নিয়ে কোনও তদন্ত পুলিশ করছে না। সেই দু’টি ঘটনায় শুক্রবার রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এদিন পুলিশ বলেছে, দলুয়াখাকিতে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। প্রসঙ্গত, দলুয়াখাকির মানুষ চেনেন তাদের, যারা সেদিন হামলা চালিয়েছিল, বাড়ি পুড়িয়েছিল। তাদের আড়াল করতেই পুলিশের এই কৌশল, তৃণমূলের নির্দেশে। ওই এলাকা এখনও পুরুষশূন্য। মহিলাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোনও পুলিশ কেড়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ। তৃণমূলের সন্ত্রাসে আতঙ্কে গ্রাম ছাড়া তাদের পরিবারের পুরুষরা। এমনকী তাঁরা পরিবারের কোনও খোঁজখবরও পাচ্ছেন না।
জয়নগরের দলুয়াখাকিতে ভস্মীভূত গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের ত্রাণ দিতে গেলে শুক্রবার কংগ্রেস নেতৃত্বকেও বাধার মুখে পড়তে হয়। গুদামের হাট এলাকায় তাঁদের পথ আটকায় পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের ধস্তাধস্তি হয়। প্রতিবাদে রাস্তায় বসে তাঁরা পথ অবরোধ করেন। এর আগে সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, রাহুল ঘোষ, রতন বাগচী, প্রভাত চৌধুরি সহ অন্যান্য পার্টি নেতাদেরও পুলিশ বাধা দিয়েছিল। আইএসএফ নেতা ভাঙড়ের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকিকেও পুলিশ বাধা দিয়েছে। গ্রামে ঢুকতে দেয়নি।
সিপিআই(এম) নেতৃত্ব’র চাপে জয়নগর-১ ব্লক প্রশাসনের তরফে শুক্রবার দলুয়াখাকি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়। সিপিআই(এম) দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী এদিন সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, দলুয়াখাকি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য নতুন বাড়ি নির্মাণ ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে প্রশাসনকে। খোলা আকাশের নিচে তাঁদের দিন কাটাতে হচ্ছে। মহিলা, শিশুরা রাতে ঠান্ডার মধ্যে পলিথিনের নিচে রয়েছেন। এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট, পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। ঘটনার পাঁচ দিনেও কেন জড়িত দুষ্কতীরা গ্রেপ্তার হলো না, সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
সিপিআই(এম) নেতা সুজন চক্রবর্তী জয়নগরে তৃণমূল নেতা খুনের ঘটনায় শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘তৃণমূলের বখরার লড়াই, অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা পুলিশ সহ এলাকার সবাই জানেন। আমডাঙায় তৃণমূলের প্রধান কীসের জন্য খুন হলেন! সর্বত্র একই কারণ। আমডাঙা, ভাঙড়, ক্যানিং, জয়নগর, বাসন্তীতে তৃণমূল খুন হচ্ছে। অপরাধী তৃণমূলই। গোটা রাজ্যেই পুলিশ, তৃণমূল, দুষ্কৃতী যোগসাজশ স্পষ্ট। আমরা বলছি, আসল অপরাধীদের ধরতে হবে।’’
Comments :0