সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য
প্রতিবারের মতো নয়, শরৎ এবার নিজের মতো করে সাজিয়েছে এক অবাক ডালি। এই সময় বড় অন্যরকম। আশ্বিনের আনন্দগান বেজেছে, কিন্তু ‘ব্যথার বাঁশিতে’। সেদিনটার কথা সকলে মনে রেখেছেন। একেবারে গভীরে লালন করছেন এক অবর্ণনীয় নৃশংসতায় একটি মেয়ের অকালে চলে যাবার কথা। অন্দর থেকে বাইরে, সর্বত্র বিচারের দাবি এতটাই আন্তরিক যে এবারের আশ্বিনের রোদও যেন উজ্জ্বল নয়! শরতের কাশফুলে সাদা একটু কম লাগে যেন ! আশ্বিন তোমার রোদটুকু এবার থাক। শুধু আলোটুকু দিও। শিউলি তুমি নিজের কাছেই রেখ। শুধু গন্ধটুকু যেন থাকে। প্রতিদিনের প্রতিবাদে মিশিয়ে দেব শিউলির সুবাস। যে আবেগে বাঙালি মহালয়ার ভোরে রেডিও চালায়, সেই আবেগ থেকেই এবার প্রদীপ জ্বালিয়ে ‘দ্রোহ’ চলবে একথা জানানো হয়ে গেছে। জলের নিচে জেগে থেকে স্থির পাহারা দিও প্রদীপ। হয়ত শুনতে পাবে যে মেয়ের জন্য এক হয়েছে সকলে, তার শ্বাসের শব্দটুকু। পারলে সেই শব্দই জমিয়ে রেখ তোমার আলোয়।
আর জি করের ঘটনার পরে কলকাতায় যে বিপুল জনজাগরণ ঘটেছে তার নজির খোঁজা দুষ্কর। শুরুতে চিকিৎসকদের আন্দোলন, তারপরে একে একে নানা পেশার মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানে সকলের আন্দোলন আজ তো উৎসবেই পরিণত হয়েছে। বাঙালির এই এক হওয়া, বাইরে বেরিয়ে আসা, চিৎকার, স্লোগান, স্ট্রিট পেইন্টিং, সরকারি পুরষ্কার ফেরানো সবই মনের ভেতরে এক বোধের জন্ম দেয়। আর যারা আন্দোলনের গায়ে ‘হুজুগ’ নাম বসিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা আর যাই হোন না কেন সমব্যথী তো নন। সব প্রজন্মের একাকার হয়ে যাবার মধ্যে একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে তো, যা আগেই তৈরি হতে শুরু করেছিল। চিকিৎসকের মৃত্যু সেই প্রেক্ষাপটে যখনই নতুন মাত্রা জোগালো হলো এক বিস্ফোরণ। তার ঢেউ তরঙ্গ থেকে ছড়িয়ে পড়ল তরঙ্গে। এমন ঘটনার পরে সবহারার মিছিল থেকে সব পাওয়ার মিছিল খুঁজে নিচ্ছে বাঙালি। কন্যাহারা বাবা-মায়ের মিছিলে কেউ ব্রাত্য নন। এক কন্যার প্রতি হওয়া অন্যায়ের বিচার চাওয়ার প্রতিটি কণ্ঠের প্রতিটি স্লোগান আসলে নিজস্ব কিছু অন্যায়ের বিচারও চাইছে আজ, এখন। চাইবে কালও, পরশুও। আন্দোলনজীবী নয়, একেবারে ছাপোষা গেরস্ত, পরিবারে গলাটুকুও তুলতে না পারা বধূ এখন পথে। এটাই বাস্তব ছবি। শেষ কবে এমন বাঁধনছাড়া উদ্বেলিত মিছিল দেখেছে রাজ্যবাসী। কবে অশীতিপর বৃদ্ধা, সোজা হয়ে হাঁটতেও পারেন না হাতে তুলেছেন প্রতিবাদের মোমবাতি !
আলোক উজ্জ্বল মণ্ডপ যখন হাতছানি দেবে, কোন আঁধার কোণে বসে ভাবতে ইচ্ছে হয় গভীর রাতে কি নিরন্তর যন্ত্রণায় কাঁদছিল তিলোত্তমা, কারও অভয়া। সেই কান্না শহর-মফস্বল শুধু নয়, ছুঁয়েছে দূরের কোনও গ্রামের মানুষকেও। তাই কলকাতার রাজপথে যখন মিছিল নামে রাত দখলের, পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে মশাল হাতে পথ চলেছেন মেয়েরা কোলেকাঁখে বাচ্চা নিয়েই। এই ক্রোধ, বেদনা, অনুচ্চারিত সব আবেগ তো ছড়িয়েই রয়েছে চারিপাশে। দিল্লি থেকে বিচার হবে কবে তা শুনতে প্রকৃতিও শব্দহীন। যখন চেতনা ফিরেছে, বেদনা উচ্চারিত হয়েছে, কেঁদেছে চোখ, তখন মন ভালো নেই।
শঙ্খ ঘোষ লিখছেন, …‘তমস্বিনী রাত্রি ভালো আজ, তমসীরে মেরো না মেরো না।’ বিচার পাওয়া না পর্যন্ত শারদোৎসবের দিনগুলিতে এবং আগামীতেও তাই বরং ভালো। তিনিই তো লিখেছেন, ‘আমরা কথা বলি আর প্রতিবাদ করি/প্রতিবাদ করতে করতে কথা বলি/কথা বলতে বলতে প্রতিবাদ করি/আর যা ঘটবার তা ঘটতে থাকে।’ ১৪ আগস্টের রাত দখলের পর থেকে যা এতটা বিস্তার লাভ করেছে, যে প্রতিবাদের ঢেউ পৌঁছে গেছে বিদেশে, সেই প্রতিবাদ থামানোর জন্য আর যা কিছু ঘটবে তার পরিসর ছেড়ে দিতে রাজি নয় মানুষ। শাসক আঙুল তুলে চোখ রাঙাচ্ছে, উৎসবে ফের। মণ্ডপে মাস্ট নেত্রীর ছবি। কিন্তু যন্ত্রণা নিয়ে চলে যাওয়া চিকিৎসক মেয়ের ছায়াটি যে এখন দীর্ঘ হয়েছে। মহীরূহের মতো। সমস্ত ডালপালা সহ গাছ হয়ে বেঁচে আছে সে। সেই মহীরূহই তো শান্ত হয়ে বিচারের অপেক্ষায়। তার ছায়ায় ঢাকা পড়া মণ্ডপে ছবিটবি দেখা যাবে কি ! আর বাঙালির কাছে শরৎ জুড়ে এই উৎসব বড় আবেগের। তবে মনে যখন খারাপ লাগার আঁধার নেমেছে তখন কেনাকাটাই হোক বা ভূরিভোজ, কোনও কিছুই কি জোর করে করানো সম্ভব ! মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বিচার চাইছেন। নাই বা হলো পুজোর আড়ম্বর !
পুজোয় বহিরঙ্গের জাঁকজমক বেশি, নতুন কথা নয়। অন্তরের গভীরে থেকেও বন্দনা করা সম্ভব। বড় মণ্ডপে ভিড়ের ছবি সমাজমাধ্যমে দেওয়া শুরু হয়েছে। বাঙালি ধর্মেই আছে, জিরাফে নেই প্রমাণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা শাসকের। ভিড়ের ছবি নতুন নাকি ! রাত দখল, ভোর দখল, মহামিছিল দেখার জন্য ভিড়কেই রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। সে নিজেও কোনোমতে মিছিলে ঢোকার সুযোগ পেয়েছে।
শাসক ঢাক বাজিয়ে বলছে, হোক উৎসব। বাঙালি তো বলছে বন্দনা চলুক, এবার বরং ফুর্তিতে স্থগিতাদেশ জারি হোক। উৎসবকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। মহালয়ার দিন যে প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে, তার আলোয় এক হঠাৎ চলে যাওয়া কন্যার ওপর ঘটা অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিচার চাওয়ার শপথ গেঁথেছে আজকের বাঙালি। শপথ রক্ষার অঙ্গীকার করেছে। তা কি এতই ঠুনকো নাকি যে মণ্ডপ, আলোকসজ্জা, থিম আর কার্নিভালের মোড়কে ভুলিয়ে দেওয়া যাবে ! এই ভাবনায় গরমিল রয়েছে বিস্তর। গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে, সময় ও স্থানভেদে প্রতিবাদী জনতা যে ভাষ্য রচনা করেছে তা একান্তই পার্থিব। আর পার্থিব বলেই সমস্ত চেতনা দিয়ে তাকে এত আন্তরিকভাবে অনুভব করা যাচ্ছে। অনেক দিনের জমে থাকা সব ক্ষোভ, চেপে রাখা দুঃখধারা পথ চিনেছে। পথে চিকিৎসকদের সাথি হয়েছেন শিক্ষক, সাথি হয়েছেন সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মী। সাথ দিয়েছেন শহরের রিকশাচালকরা। ঝটফট রাতের রান্না শেষ করে রাত জাগতে যাদবপুর ৮বি-তে এসেছেন যে গৃহবধূ, তিনিই বলতে পারবেন শেষ কবে, সকলের সাথে পথ হাঁটা ! রাজনৈতিক-অরাজনৈতিকের দ্বন্দ্ব দূরে রেখেই বলতে হচ্ছে পথে নামার এই ছবি বাঙালি কবে দেখেছে বিশেষ মনে পরে না।
আসলে একথা তো সত্যি, ওই যে চিকিৎসক কন্যা তাকে ‘ঘরের মেয়ের মতো মনে হয়।’ যার উৎসবে ফেরা-না-ফেরা নিয়ে এত চাপানউতোর সেই দুগগাকে তো বাঙালি ঘরের মেয়েই ভাবে। সেই তাগিদেই তো এত আয়োজন। ন্যায়বিচারের দাবির সাথে উৎসবের দ্বন্দ্ব আছে নাকি ! ক্ষোভ ছিলই, ৯ আগস্টের ঘটনার আগে থেকেই ছিল। কিন্তু চিকিৎসকের নির্মম হত্যার পরে সেই ক্ষোভ বিস্ফারিত হলো। গত দু’মাস ধরে বাঙালি ঘর থেকে বের হয়েছে। শেষ কবে এমন একত্রিত জনজোয়ার দেখেছে রাজপথ ! সারা বছর বাঁধা গতে রুটিন নির্মিত জীবন থেকে বের হয়ে আসার সুযোগ করে দেয় শারদোৎসব। যেন প্রাত্যহিক একঘেয়েমি ভুলতে শারদোৎসব একটা বিকল্প, তা অস্বীকার করার তো কিছু নেই। তবে এবারের উৎসবের ধরন হবে আলাদা, ধারণও। একথা চিন্তা করেই তবে ‘উৎসবে ফিরুন’ নামক শব্দবন্ধের ব্যবহার ! কিন্তু কেউ যদি পুজোয় আনন্দ করতে চান, বাধা নেই। যদি ওইসব দিনে নিজের মতো করে প্রতিবাদী রঙের প্যালেটে মিশে যেতে চান, তাঁকেও তো বাধা দেবার কেউ নেই। উদ্যাপনের গান বেঁধে দিতেও কি ফতোয়া লাগে!
ন্যায়, নীতি এসবই চিরন্তন। যেসব উপাদান দিয়ে ব্যক্তি তার জীবন গড়ে তোলে, তা তো বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর থেকেই পাওয়া। সমাজ থেকে যা আহরণ করা হয় তা তো সম্পূর্ণ শোধ করা যায় না। তবে হ্যাঁ, ঋণ শোধের ইচ্ছাটুকুও যখন থাকেনা তারই অভাবে বলা যায় দুর্নীতি। আর দুর্নীতিকে আশ্রয় করেই গড়ে ওঠে ভ্রষ্টাচার। পথে নামা মানুষ বিচার তো চাইছেনই, তবে ভয়হীন কণ্ঠে তাঁরা দুর্নীতির বিসর্জন চাইছেন। একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডর মতো ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। ধুসরপ্রসর পথে প্রতিবাদী জনতা কিন্তু আজ দুর্নীতি, চুরি, লিঙ্গসাম্য, মেয়েদের ও ট্রান্সজেন্ডারদের স্বাধীনতা ও অধিকারের প্রশ্নও তুলছে।
ঢাক বাজছে। আর বারবার ফিরে আসছে মেয়ের রক্তঝড়া কান্না। যে দুগগা আজ ঘরে নেই, ফিরে আসেনি কর্মস্থল থেকে সে ঘরে আজ আঁধার। কন্যাহারা বাবা-মা জানিয়েছেন যেদিন পাওয়া যাবে বিচার সেদিনই শুরু হবে তাঁদের পুজো। উৎসব। ওই বাড়িতে সকালে কান্না ওঠে ঘুম থেকে। রাতে কান্নাই ঘুমোতে যায় পরদিন সকাল হবার অপেক্ষায়। ঘন বিষাদের মধ্যে আরও গভীর বিষাদ ডুবে যায় শুধু। ও বাড়ির মা বলেন, ‘সেই রাতে মেয়েটা হয়ত মা বলে ডাকছিল, কাঁদছিল।’ বলেই আনমনা হয়ে যান। অকালবোধন নয়, এখানে মায়ের কোল খালি করে অকালে চলে গেছে এ বাড়ির ‘উমা’। নতুন করে এ বাড়ির সর্বজয়া, এ বাড়ির হরিহরের কাছে এসে আবদার করবে না ‘আমাদের দুগ্গা’।
তবে সকলের জন্য একটি কথা এখনও বলে যাচ্ছে সে, ‘তুমি তো ছুঁড়েছো শেষ মৃত্যুবাণ/মরিনি তাতেও/এই দ্যাখো বেঁচে আছি…।’ বেঁচে আছে মিছিলে, স্লোগান ঢাকা রাজপথে, মোমবাতি জ্বালানো ব্যালকনিতে, গ্রামের আলপথে…
Comments :0