JYOTI BASU on Babri demolition

মসজিদ ভেঙে বিশ্বের কাছে মাথা হেঁট করে দিয়েছিল আরএসএস

জাতীয়


ইতিমধ্যে আমাদের দেশের ভেতরকার ঘটনাগুলি বেশ জটিল হয়ে গেল। এটা বোঝা যাচ্ছিল যে বিজেপি ও তার সব ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলি ক্রমশ হিংস্র হয়ে উঠছে, আর কেন্দ্রের নরসিমা রাও সরকার আপসের রাস্তা নিয়েছে। যখন দরকার ছিল এসব ভয়ঙ্কর দেশবিরোধী শক্তিগুলির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, তখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে নরসিমা রাও সরকার এদেরকে কাজ করতে দিল। (১৯৯২ সালের) ১৮ জুলাই হলো জাতীয় সংহতি পরিষদের দ্বিতীয় সভা। যাতে অযোধ্যা নিয়ে বিজেপি’র একরোখা ইচ্ছেটা বেরিয়ে এল। তখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল। ইতিমধ্যে উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি তার ক্ষমতাকে কাজে লাগাচ্ছিল। দেখা গেল, বৃহৎ বুর্জোয়াদের একটা বড় অংশ বিজেপি’কে খোলাখুলিভাবে সমর্থন করছে, টাকা জোগাচ্ছে। বিজেপি বহু অবসরপ্রাপ্ত সৈন্য ও প্রতিরক্ষা বিভাগের অফিসারদের সমর্থন লাভ করতে সফল হয়, যা অবশ্যই প্রতিরক্ষা বাহিনীর সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক। বিজেপি শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত অংশের মধ্যে নতুন সমর্থক জোগাড় করেছে, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও ঢুকতে পেরেছে। প্রসঙ্গত, এর মধ্যে ২৫ জুলাই নতুন রাষ্ট্রপতি হলেন শঙ্করদয়াল শর্মা। আমরা তাঁকে সমর্থন করেছিলাম। 
আমরা, বামপন্থীরা, বহুদিন যাবৎ সাম্প্রদায়িক বিপদের কথা বলে আসছিলাম এবং এই বিপদকে রোখার জন্যই ১৯৯১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আমাদের পার্টির সাংসদ জয়নাল আবেদিন সংসদে ‘ধর্মস্থান স্থিতাবস্থা বিল’ নামে একটি বেসরকারি বিল আনেন, যা পরে সংসদের উভয় সভাতেই অনুমোদিত হয়ে আইনে পরিণত হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক শক্তি নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করে। আন্দোলনের নামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চক্রান্তকে যাতে বাধা দেওয়া যায় তার জন্যই এই বিল আনা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় মোর্চা, কংগ্রেস (আই) ও বামপন্থী দলগুলির নির্বাচনী ইশ্‌তেহারে প্রতিশ্রুত এই বিলটি পাশ করানোর জন্য আমাদের পার্টি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল এবং তা সফলও হয়েছিল। 
কিন্তু রাজ্যে (উত্তর প্রদেশে) বিজেপি সরকারে থাকার দরুন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অযোধ্যায় মন্দির তৈরির কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। রাজ্য সরকার একাজে সাহায্য করার জন্য অযোধ্যায় বিতর্কিত এই জায়গার একটি অংশ সহ জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি জারি করল। কোর্টের রায়কে অমান্য করে এসব বেআইনি কাজ তাঁরা করলেন। এর মূল কারণ মন্দির তৈরির জন্য বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে সাহায্য করা। এদিকে তারা জাতীয় সংহতি পরিষদের মিটিংয়ে বলছেন, স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে, অন্যদিকে মসজিদ ভাঙার জন্য কাজ সারছেন। আমি বলছিলাম নরসিমা রাওকে যে, আপনি বুঝতেই পারলেন না এত বড় বিপদ তারা করতে চলেছে। উনি বললেন, উনি বিজেপি’র মিথ্যা কথা ধরতে পারেননি। আশ্চর্য ব্যাপার, গোটা দেশ বুঝতে পারছে, উনি পারছেন না। সিবিআই, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রিপোর্টও তো দেখতে পারতেন। তাতেও তো বলা হয়েছিল একথা। 
একদিকে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার খালি বিবৃতি দিচ্ছে। আমাদের পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেসে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, তাই হলো। এটা নিশ্চিতভাবে বোঝা দরকার যে, জনসাধারণের একটা অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রচার জায়গা করে নিতে শুরু করছিল। ১৯৮৫ সাল থেকেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ক্রমাগত শিলাপূজা থেকে শুরু করে নানান সব ধর্মীয় তিথি উদ্‌যাপনের মধ্য দিয়ে দেশের বিরাট অংশের মনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পেরেছিল। ফলে বিপদের কারণ ছিল যথেষ্ট। 
অক্টোবর মাসের ২৮-৩১ তারিখে (১৯৯২) আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক হয়। তখনই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, বিজেপি- আরএসএস-ভিএইচপি জোটের চক্রান্তে অযোধ্যায় একটা গুরুতর সংঘাত হতে চলেছে। জুলাই মাসের ঘটনাবলীর পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আলোচনা ব্যর্থ হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক চলাকালীনই দিল্লিতে তথাকথিত ধর্মসংসদের সভা হয়। সেখানে ৬ ডিসেম্বর থেকে মন্দির নির্মাণের কাজ পুনরায় শুরু করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় কমিটি রাজনৈতিক প্রস্তাবে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, ‘মসজিদ ভাঙার জন্য বিজেপি-ভিএইচপি’র শয়তানি পরিকল্পনাকে ঠেকাতে না পারলে দেশের প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে যাবে।’ 
কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরই পলিট ব্যুরো নতুন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে বিজেপি’র মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠক ডাকার দাবি জানায়। আমাদের পার্টি, বামপন্থীরা এবং তাদের মিত্ররা প্রবল চাপ সৃষ্টি করায়, কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয়ে নভেম্বরের ২৩ তারিখে জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠক ডাকে। তার আগে বামপন্থীরা মিলিত হয়। ৩ নভেম্বর আমরা আবার দাবি জানাই, কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে সমগ্র বিতর্কিত এলাকা অধিগ্রহণ করুক ও যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক। জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠক এবং কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের দাবিতে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়ে যায়। এই পর্বে আমরা অন্যান্য বামদল এবং জনতা দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতে থাকি, যাতে আমাদের মধ্যে সমন্বয় বজায় থাকে। আমরা সবাই মিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটা যৌথ ডেপুটেশনও দিয়েছিলাম এবং অন্যদেরও সমবেত করতে পেরেছিলাম। ২৩ নভেম্বর জাতীয় সংহতি পরিষদের বৈঠকে আমরা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলাম। এর ফলে এই বৈঠকে সুরজিতের উত্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে যায়। ঐ প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, সংবিধান, আইন ও আদালতের নির্দেশ লঙ্ঘিত না করে তা সুনিশ্চিত করতে হবে এবং সেই জন্য প্রয়োজনীয় যে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হলো। 
পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে। নরসিমা রাওয়ের উচিত ছিল নজিরবিহীন এই ক্ষমতা দেশের স্বার্থে ব্যবহার করা। কিন্তু কেন্দ্র তারপরও চুপচাপ বসে রইল। রাও এমনকি বিজেপি–ভিএইচপি’র আক্রমণাত্মক কর্মসূচির নিন্দা পর্যন্ত করেননি। তাঁর সেই ঔদাসীন্য ও নিষ্ক্রিয়তা আমাকে এখনও বিস্মিত করে। এর কোনও ক্ষমা নেই। করসেবকরা ১ ডিসেম্বরের মধ্যে অযোধ্যায় বিরাট সংখ্যায় জড়ো হতে শুরু করল। রাও সরকার তখনও ঠুঁটো জগন্নাথ।
ইতিমধ্যে নির্মাণ কাজ চালানো যাবে না বলে আদালতের পুনর্নির্দেশ সত্ত্বেও ৬ ডিসেম্বরের কর্মসূচি ঘোষিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলার শুনানি শুরু হয়। ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয়, বিতর্কিত স্থানে কোনোরকম নির্মাণ কাজ করা যাবে না। নির্মাণের উপকরণও জড়ো করা যাবে না। কীর্তন ও ভজনের মাধ্যমে শুধু প্রতীকী করসেবা করা যেতে পারে। তার আগে অবশ্য উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকার আদালতে একটি হলফনামা পেশ করে। হলফনামাতে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বিতর্কিত অঞ্চলে কোনোরকম নির্মাণ কার্য করতে দেওয়া হবে না। তারপরই সুপ্রিম কোর্ট ঐ কীর্তন ভজনের অনুমতি দেয়। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট বলে দেয়, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে যথাযথ সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব প্রশাসনের। বিজেপি আরএসএস ভিএইচপি জোট সুপ্রিম কোর্টের আদেশে স্বভাবতই সন্তুষ্ট হয়নি। বরং ব্যাপারটাকে তারা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নেয় এবং বেপরোয়া হয়ে ওঠে। 
আরএসএস ৬ ডিসেম্বরের অনেক আগে থেকেই অযোধ্যাতে হাজার হাজার কট্টর সমর্থককে জমায়েত করার কর্মসূচি নিয়েছিল। বিজেপি ১ ডিসেম্বর থেকে যথাক্রমে বারাণসী ও মথুরা থেকে আদবানি ও মুরলিমনোহর যোশীর রথযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। নভেম্বরের ৩০ তারিখ আদবানির সাংবাদিক সম্মেলন থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় ওরা আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এই গুরুতর বিপদের মুখে দ্রুত সক্রিয় হয়। আমরা বামদলগুলির বৈঠক ডাকি। অযোধ্যায় বেআইনি কাজকর্ম বন্ধ করার জন্য এবং অবিলম্বে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের জন্য দাবি জানাই। 
১ ডিসেম্বর দিল্লিতে পলিট ব্যুরোর বৈঠকের পর ৩ থেকে ৬ ডিসেম্বর সভা সমাবেশ ও বিক্ষোভ সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা। এরপর সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য সভা ও বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। ৩ ডিসেম্বর উত্তর প্রদেশে জেলাস্তরে সমাবেশ হয়। ৫ ডিসেম্বর আটটি বিরোধী দল লক্ষ্ণৌ থেকে অযোধ্যা যাত্রা করে। মধ্য পথেই সেই যাত্রাকে আটকে দিয়ে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়। 
৩ ডিসেম্বর বামপন্থী ও রাষ্ট্রীয় মোর্চার এক প্রতিনিধিদল প্রস্তাবিত করসেবা বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রীকে রাজি করানোর একটা শেষ চেষ্টা চালান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী রাজি হননি। বরং যুক্তি দেখালেন, আরএসএস-বিজেপি নেতৃত্ব অবস্থা সামলে নেবে। ডিসেম্বর মাসে ১ ও ২ তারিখ পরপর দু‘দিন রাতে আরএসএস নেতা রাজেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে পিভি নরসিনহা রাও বৈঠক করেছিলেন। কেন সেই বৈঠক আমরা জানি না। এরপরই ফাঁস হয়ে যায় রাও কিছু করবেন না। 
ফলে সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলই। ৬ ডিসেম্বর বর্বররা ভেঙে দিল বাবরি মসজিদ। গোটা বিশ্বের কাছে মাথা হেঁট করে দিল আমাদের। 
সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। দেশভাগের পর এত বড় ব্যাপক দাঙ্গা আর কখনো বোধ হয় দেখা যায়নি। শুধুমাত্র বোম্বাইতেই কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারালেন। দু’মাস ধরে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। হায়দরাবাদ, সুরাটের মতো শহরে উন্মত্ত বর্বরতার প্রকাশ ঘটেছিল। সংখ্যালঘুরাই ছিল এর প্রধান শিকার। আমাদের কলকাতা শহরেও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল। দাঙ্গা ছড়ানোর কম চেষ্টা হয়নি। অসাধু লোকজন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছিল কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তিনদিন বন্‌ধ পালিত হয় গোটা রাজ্যে। কয়েক দিন কারফিউ জারি করতে হয় কলকাতায়। আমাদের পার্টি, বামফ্রন্ট রাজনৈতিকভাবে সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরোধিতা করে। প্রশাসনকেও সময়মতো ব্যবহার করা হয়।

(জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক আত্মকথন ‘যতদূর মনে পড়ে’ থেকে নির্বাচিত অংশ।)
 

Comments :0

Login to leave a comment