‘‘মিছিল তো আছেই, আগে চাট্টি মুড়ি পেটে ফেলে যাও, অনেকটা পথ হাঁটতে হবে যে।’’ ধমক মিশ্রিত মাতৃস্নেহে এক একজনকে ডেকে বাড়ির উঠানে নিয়ে এলেন বৃদ্ধা যমুনা বাউরি। সারা উঠান দু’দিন ধরে ন্যাতা দিয়ে মসৃণ তকতকে করে রেখেছেন। খালি নিজের গ্রাম নয়, আর পাঁচ, দশটা গ্রাম থেকে মানুষগুলো আসবে। আগে একটু জিরোবে, দুটি খাবে তারপর ঝান্ডা নিয়ে মিছিল। মিছিলে হাঁটবেন যমুনা বাউরিও। তার আগে জলখাবার খাইয়ে দিতে হবে তো সবাইকে।
ঘটনাস্থল বিষ্ণুপুর থানার লোখাশোল। বুধবার সকালে এই গ্রাম থেকেই বিষ্ণুপুর থানার লায়েকবাঁধ অঞ্চলের গ্রাম পদযাত্রা হলো। এই সেই লায়েকবাঁধ, যে অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই তৃণমূলবাহিনী ২০১১-র পর বছরের পর বছর ধরে দমবন্ধ করা সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছিল। তখন তৃণমূলের চোখে গরিব খেতমজুর মানেই লাল ঝান্ডার লোক। তাই সব কাজ তাঁদের বন্ধ। এমনকি বাইরেও কাজ করতে দেওয়া হতো না। এক প্রকার বন্দি অবস্থায় দিন কাটে তাঁদের। সরকারি কোনও সুযোগ তাঁরা বছরের পর বছর পাননি। তার সঙ্গে ছিল টানা হুমকি। কয়েক বছর আগে এখানে জাঠা মিছিলও করতে দেয়নি তৃণমূলবাহিনী। এত অত্যাচার চালিয়েও শেষ পর্যন্ত দম ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূলবাহিনী। এই লায়েকবাঁধ অঞ্চলের মানুষই রেগার কাজ দেওয়া, পঞ্চায়েতের দুর্নীতি বিরুদ্ধে একাধিকবার মিছিল করে পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দিয়েছেন। দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আজ এককাট্টা লায়েকবাঁধ।
এদিন সকালেই চুয়ামসিনা, লায়েকবাঁধ, অর্জুনপুর, মেটাপতন, ঘাটারমাথা সহ একাধিক গ্রামের মানুষজন কেউ হেঁটে, কেউ সাইকেলে করে লায়েকবাঁধে এসে হাজির হলেন। যমুনা বাউরি তাঁদের মিছিলের আগে মুড়ি খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। যমুনা বাউরি জানান, কাল সন্ধ্যায় মোটরকলাই একটা হাড়িতে ভিজতে দিয়েছিলাম। মুড়ি, মশলা, কাঁচালঙ্কা, পেঁয়াজ সব কিছুই বৌমাতে আমাতে জোগাড় করেছি। সঙ্গে ছিল ছেলে দিলীপ। তাঁরাও খেতমজুর। সকাল সাতটার মধ্যে ঘুগনি তৈরি। মানুষজন আসার পরই একে একে ডেকে এনে বাড়ির দাওয়ায় শালপাতা মেলে মুড়ি খাওয়ালেন তিনি। সামনেই বালতি ভর্তি জল। খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর সমস্ত পতাকাগুলো এক জায়গায় করলেন কাঁপা হাতেই। নির্দেশ দিলেন সবাই হাতে পতাকা নাও। পতাকা ছাড়া যেন মিছিলে একজনও না থাকে। তাঁর নির্দেশ অমান্য করবে এমন সাহস কারুর নেই। দীর্ঘ লড়াইয়ের স্মৃতি বহন করে চলেছেন যমুনা বাউরি। মিছিল শুরু হলো অজিত বাউরির পরিচালনায় কাঠিনাচ।
প্রত্যন্ত গ্রামেই এই সাংস্কৃতিক সংস্থাটি তৈরি করেছেন খেতমজুররা। শিল্পী কলম, অনিল, অজিত, বদন, গেড়া, নেউল, মানিক, শম্ভু, প্রশান্ত বাউরিরা। স্লোগান উঠল— রেগার কাজ চাই, চাই বকেয়া মজুরি। খেতমজুর মদন লোহার, বাগ বাউরি, পারুল বাউরি সহ শতাধিক খেতমজুর, কৃষক মানিক বাউরি সহ বহু কৃষক মিছিলে পা মেলালেন। দুপুরে চুয়ামসিনায় ভাত খাওয়া হলো। সন্ধ্যায় মিছিল শেষ হলো জয়রামপুরে।
Comments :0