editorial

প্রতিশ্রুতির ধোঁকার পিছনে বুলডোজার

সম্পাদকীয় বিভাগ

বেঁচে থাকতে অধিকারের প্রয়োজন, কৃপার নয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার কৃপা করার নামে কেবল ধোঁকা দিয়ে চলেছে, অধিকার দেওয়ার নামটুকুও করছে না। এই সত্য আবার প্রমাণিত হলো বারাসতের রেলের কলোনিতে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ নোটিস ধরানোর ঘটনায়। ইউসিআরসি’র নেতৃত্বে কলোনিবাসী গর মানুষ প্রতিবাদে সরব হওয়ায় জেলা প্রশাসন রেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসে আপাতত উচ্ছেদ স্থগিত রাখার বন্দোবস্ত করেছে, এটা নিঃসন্দেহে স্বস্তিকর। কিন্তু এই সাময়িক স্থগিত রাখার আপাতত বন্দোবস্তের মধ্যেই সারসত্য বেরিয়ে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার এরাজ্যের কোথাও কলোনিবাসীদের জমির অধিকার দিতে উদ্যোগী নয়, এমনকি আগ্রহীও নয়। বরং তারা কৃপা করার ভঙ্গিতে কলোনিবাসীদের রক্ষা করার ভান করে চলেছে, আনুগত্যে বেঁধে রাখতে চাইছে। এই ধোঁকা বছরের পর বছর মমতা ব্যানার্জির সরকার দিয়ে চলেছে। 
উদ্বাস্তুদের সংগঠন ইউসিআরসি দীর্ঘদিন ধরে কলোনিগুলির বাসিন্দাদের নিঃশর্ত জমির দলিল প্রদানের দাবি করে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকারের এবং রেল বন্দর কয়লা মন্ত্রক ইত্যাদির যে জমিগুলিতে দীর্ঘদিন ধরে উদ্বাস্তুরা বসবাস করছে সেগুলিও যাতে কলোনিবাসীদের নামে করা হয় তার জন্য রাজ্য প্রশাসনের উদ্যোগও দাবি করে আসছে। গত ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে ঘটা করে রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘রাজ্য সরকারের যত কলোনি আছে সব আইনত স্বীকৃত করে দেওয়া হয়েছে। তারা সময়, সময় পাট্টা পেয়ে যাবে। কেন্দ্রীয় সরকারের যত জমি আছে কয়লা, রেল মন্ত্রকের জমিতে যারা বসবাস করছে তাদেরও উচ্ছেদ করা যাবে না। আইন করে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি জমিতেও যারা বাস করছে তাদের জমি থেকেও উচ্ছেদ ঠেকাতে আইন করে দেওয়া হয়েছে।’’ এই আইন এবং ঘোষণামাফিক রাজ্য সরকারের জমি, রেলের জমি, কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্য মন্ত্রকের জমি এমনকি বেসরকারি জমিতে যারা বসবাস করছিলেন গত বিধানসভা ভোটের আগে তাদের অনেকের হাতে ‘নিঃশর্ত দলিল’ তুলে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা যদি ধোঁকা না হয়ে সত্য হতো তাহলে বারাসতের রেল কলোনির বাসিন্দাদের উচ্ছেদের নোটিস দিতে পারে না রেল কর্তৃপক্ষ। বারাসতের রেল কলোনির জমিতে বসবাসকারী ৯৭ জনকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ঘর দেওয়া হয়েছে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকার আবাস যোজনার টাকা বন্ধ করে দেওয়ার পর রাজ্য সরকার যখন আবাসের টাকা দিতে শুরু করে তখন রেলের জমির ওপর ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের ১০৮ জন উপভোক্তার কাছে টাকা তুলে দেওয়া দেওয়া হয়েছে। এভাবে সরকারি প্রকল্পে বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়ার অন্যতম শর্ত হলো উপভোক্তার নিজের জমি থাকতে হবে। যদি বারাসতের রেল কলোনির জমির মালিকানাই কারো না থাকে, যদি সবাই জবরদখলকারী হয়ে থাকে, তাহলে সরকারি প্রকল্পের টাকা তাঁরা পেলেন কীভাবে, সেই প্রশ্নও স্বাভাবিক। 
যা স্পষ্ট হয়েছে তা এই যে রাজ্য সরকার উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দাদের জীবনের নিরাপত্তা ও অধিকার সুনিশ্চিত করতে কোনও পদক্ষেপই আদপে নেয়নি। শুধু বারাসতের নয়, বামফ্রন্ট সরকারের পরবর্তীতে তৃণমূল সরকার কোথাও জমির আইনমাফিক নিঃশর্ত দলিল প্রদান করেনি। যা দিয়েছে তা আসলে দখলিস্বত্বের কাগজমাত্র। রেল কর্তৃপক্ষ তা মানবে কিনা, রাজ্য সরকারের প্রশাসন কলোনিবাসীদের রক্ষায় উদ্যোগী হবে কিনা তার ওপরে ভবিষ্যতেও নির্ভর করে থাকবে কলোনিবাসীদের জীবন। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত এবং আইনমাফিক অধিকারের মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেও এমন কাণ্ড কি ধোঁকা নয়? বুলডোজার রাজনীতিতে নামা মোদী সরকার এবং তাদের সংস্থাগুলি যে কোনও সময়ে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদে নামতে পারে। রাজ্য সরকার তাদের কোনও আইনি সুরক্ষায় আগ্রহী নয়। আসলে বুলডোজার রাজনীতিতে শরিক তারাও।

Comments :0

Login to leave a comment