বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের একবেলা রান্না করা খাবার দেবার মিড ডে মিল প্রকল্প আকার-আয়তনে বিশ্বের বৃহত্তম। বিশ্বের আর কোথাও এত ছেলে-মেয়েকে বিদ্যালয় চলাকালীন রান্না করা খাবার দেওয়া হয় না। ভারতে এই প্রকল্প নিঃসন্দেহে নজিরবিহীন। সব ছেলে-মেয়েরা যাতে বিদ্যালয়ে যায় এবং পড়াশুনা করে, অভাবের তাড়নায় যাতে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ না করে সেই জন্যই বহুদিন ধরে চালু আছে এই প্রকল্প। দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা বিদ্যালয়ে গিয়ে অভুক্ত থাকার চেয়ে কোনও না কোনও কাজে যুক্ত হলে সামান্য কিছু রোজগারকে অগ্রাধিকার দেয় দরিদ্র বাবা-মা। ফলে নিরক্ষরের সংখ্যা যেমন বাড়ে তেমনি বাড়ে শিশু শ্রম। এই সমস্যা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পেতে মিড ডে মিল প্রকল্প। অন্তত খাবার জন্য তারা বিদ্যালয়ে যাবে এবং বিদ্যালয়ে থাকবে। সেই সুবাদে প্রথাগত শিক্ষা অর্জন করার সুযোগ পাবে।
নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর আত্মপ্রচারের লোভের অঙ্গ হিসাবে এই প্রকল্পের নাম বদল করে নতুন ব্রান্ডে হাজির করেন ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ শক্তি নির্মাণ’ প্রকল্প। বাস্তবে নাম বদলেছে, মোদীর প্রচার হয়েছে কিন্তু প্রকল্পের গুণগত কোনও পরিবর্তন হয়নি। দেশের সমস্ত সরকারি এবং সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে এই প্রকল্পে ছাত্র-ছাত্রীরা রান্না করা খাবার পায় প্রতিদিন। বিদ্যালয়েই সেটা রান্না হয় এবং পরিবেশিত হয়। এহেন এক বৃহৎ প্রকল্পের নামে সরকারের কীর্তির ধ্বজা ওড়ানো হলেও বাস্তবে এই প্রকল্পে সরকারের ভূমিকা নিতান্তই সামান্য, অন্তত অর্থ বরাদ্দের বিচারে। ২০২৪-২৫ সালে এই প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ ছিল ১২৪৬৭ কোটি টাকা। এর সঙ্গে রাজ্যগুলি নিজস্ব বরাদ্দ যোগ করে প্রকল্প চালায়। কেন্দ্র থেকে বা রাজ্য দুয়ে মিলে যেটুকু বরাদ্দ সেটা দিয়ে খোলা বাজারে সকালের টিফিনও কেনা হয়। অথচ তা দিয়ে দুপুরে পেট ভরা পুষ্টিকর খাবার দিতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে কেমন পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।
দেশে যদি অভুক্ত-অর্ধভুক্ত দরিদ্র পরিবারের ছড়াছড়ি না থাকত তাহলে কেউ মিড ডে মিলের ঐ খাবার খেতে আসত না। সরকার যতই দরিদ্র হ্রাসের বা দারিদ্র সীমার ওপরে ওঠার গল্প বানিয়ে সাফল্যে প্রচার করুক বাস্তবে সে সব যে ফাঁকা আওয়াজ মিড ডে মিলের খাবারের মান থেকেই পরিষ্কার। দারিদ্র সীমার ওপরে থাকা মানুষ এত নিম্নমানের খাবার খায় না, অন্তত খাবার কথা নয়।
তেমনি যারা এই খাবার রান্না করে তাদের জন্য মাসিক মজুরি ২০০৯ সালে নির্ধারিত ছিল এক হাজার টাকা। ১৫ বছর পরেও তা এক পয়সাও বাড়েনি। দেশে অদক্ষ শ্রমিকদের গড় ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকার বেশি। অথচ মিড ডে মিলের রান্নার কর্মীদের সরকার মজুরি দেয় ১০০০ টাকা। বলা হয় এমন ২৫ লক্ষাধিক রান্নার কর্মী যাদের ৯০ শতাংশ মহিলা তারা নাকি আংশিক সময়ের স্বেচ্ছাশ্রমী। বাস্তবে যারা একাজ করেন তারা সকলেই দুঃস্থ। অন্য কোথাও বেশি আয়ের কাজ না পেয়ে বাধ্য হয় যৎসামান্য মজুরির এই কাজে। এই ঘটনা প্রমাণ করে দেশে কাজের কি ভয়ানক অভাব। তাছাড়া মুখে আংশিক সময়ের কর্মী বলা হলেও এরা রান্না ছাড়া স্কুলের যাবতীয় কাজ করে থাকে। শিক্ষকদের জন্য চা বানানো, থালা-বাসন মাজা, বিদ্যালয় ও বিদ্যালয় চত্বর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা ইত্যাদি কাজও করতে হয়। কার্যত ৮ঘণ্টাই তারা কাজ করে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা বা তারও কম মজুরিতে। তাই এটা বলা যেতেই পারে এমন প্রকল্প কেন্দ্র-রাজ্যের সামান্য অর্থে চলে না, চলে ২৫ লক্ষাধিক গরিব মানুষের বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমের বিনিময়ে। তাই এই প্রকল্পের কৃতিত্ব কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার দাবি করতে পারে না। সত্যিকারের কৃতিত্ব মজুরি না পাওয়া মানুষদের।
Mid day meal
কৃতিত্ব চুরি
×
Comments :0