বিশ্বের ‘বৃহত্তম’ গণতন্ত্রের আইনসভায় দেশের সংবিধান নিয়ে আলোচনার শেষে রেকর্ড সৃষ্টিকারী ১১০ ঘণ্টার জবাবী ভাষণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আলোচনার বিষয় সংবিধান হলেও মোদীর ভাষণে সংবিধানের আসল কথাগুলিই অনুপস্থিত। দেশের সব অংশের মানুষের সার্বিক স্বার্থকে মাথায় রেখে আম্বেদকরের নেতৃত্বে যে সংবিধান সারা বিশ্বের সামনে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিল সেই সংবিধানের সার কথা অর্থাৎ মর্মবস্তুটাই কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে। বদলে শোনা গেছে এক মেঠো নির্বাচনী ভাষণ। আমার সরকার কি কি ভালো করেছে আর বিরোধী পক্ষ কি কি খারাপ করেছে তার ফিরিস্তি শোনার জন্য সংসদে সংবিধান নিয়ে আলোচনার দরকার ছিল না। ওটা মোদী কোনও দলীয় সভায় বা জনসভায় গিয়ে সেরে ফেলতে পারতেন।
মোদীরা সম্ভবত বুঝতেই পারেননি ভারতের সংসদে সংবিধান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ নিছক কোনও আরএসএস বা বিজেপি নেতার ভাষণ নয়। এটা ভারতের সংসদে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। প্রধানমন্ত্রী যেমন শুধু বিজেপি সমর্থকদের প্রধানমন্ত্রী নন সমগ্র দেশের সব নাগরিকের প্রধানমন্ত্রী তেমনি ভারতের সংবিধানও মনুস্মৃতি বা সাভারকার-গোলওয়ালকারদের আত্মবিলাপ নয়। নানা ধর্ম, বর্ণ, জাত, ভাষা, সংস্কৃতির সব মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিশা হলো বহুত্ববাদী ভারতের সংবিধান। এই সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য ভিন্ন ও স্বতন্ত্রভাবে যেমন গভীর অর্থবোধক তেমনি তার নির্দেশাত্মক নীতিগুলি ভারতীয় সভ্যতার আধুনিক বিকাশের আলোকিত পথ রেখা। ভাষণ দেবার আগে প্রধানমন্ত্রী এসব নিয়ে বিন্দু বিসর্গ ভেবেছেন বলে মনে হয় না।
সংসদে যে কোনও বিষয়ে আলোচনার জবাবী ভাষণ নিছকই বিরোধীদের সমালোচনার জবাব নয়। সেই ভাষণ যদি প্রধানমন্ত্রী দেন তাহলে তো নয়ই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের হলেও এটা সত্যি মোদী রাহুল-প্রিয়াঙ্কার বক্তব্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে বেরোতে পারেননি। তাই সংবিধান নিয়ে মোদীর মুখে কিছু শোনা যায়নি। একবারের জন্যও উচ্চারিত হয়নি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি। আসলে ভারতের সমাজ সভ্যতার যে স্রোতধারা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে পরিস্নাত সেই ধর্মনিরপেক্ষতাই সংবিধানের মূল ভিত্তি। মোদীরা তো ধর্মনিরপেক্ষতাতেই বিশ্বাস করেন না। হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের ওপর ভিত্তি করে তারা হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী। সেই অর্থে তো মোদীদের কাছে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গুরুত্বহীন। তার মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে সংবিধানকে সম্মান করা যায় না। সত্যিকারের গণতন্ত্রে ধর্মের স্থান নেই, জাতের স্থান নেই। গণতন্ত্রের কাছে সকলেই সমান। সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের ধারণা গণতন্ত্রের শত্রু। এক দেশ এক ভোট গণতন্ত্রকে প্রসারিত করে না, কেন্দ্রীভূত করে। যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে। মোদীরা যে আদর্শে বিশ্বাস করেন এবং যে আদর্শের ভিত্তিতে দেশকে পুনর্নির্মাণ করতে চান সেই আদর্শ সংবিধান অনুমোদন করে না। তাই মোদীর সংবিধানের কথা অনুপস্থিত। তিনি আরএসএস-বিজেপি’র কথা বলেছেন সংবিধান ভাষণে। কারণ তাঁর দৌড় ঐ পর্যন্তই।
PM Constitution
সংবিধান ভাষণে সংবিধান কোথায়
×
Comments :0