Editorial

মোদী পে চর্চা

সম্পাদকীয় বিভাগ

স্বাধীনতার পর দীর্ঘ প্রায় ৮ দশক ধরে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী আধুনিক শিক্ষা যে বনিয়াদ গড়ে উঠেছিল এবং অন্যান্য দেশে প্রশংসিত হয়েছিল আজ শিক্ষার সেই বস্তুগত ও বৌদ্ধিক পরিকাঠামো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আর সেটা করা হচ্ছে সচেতনভাবেই। শিক্ষা থেকে যুক্তি নির্ভরতাকে কার্যত টাটা বাই বাই করে দিয়ে সেখানে যুক্তিহীন অন্ধ বিশ্বাস ও কল্পকাহিনির চাষ শুরু হয়েছে। এখন সিলেবাসে তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তির বিচারে উন্নীত ইতিহাসের জায়গা নেই। বদলে এসেছে বেদ-উপনিষদ-পুরাণে বিবৃত কাল্পনিক কাহিনিকে ইতিহাস গণ্য করে চর্চা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিও পরিবর্তিত হচ্ছে মন্দিরের সংস্কারে। ধর্মানুসরণের অনুষঙ্গকে পদে পদে যুক্ত করে সাজানো হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি। পাশাপাশি গড়ে উঠছে ধর্মীয় ও জাতপাতের নারীদের দেখা পুরুষতান্ত্রিকতার চোখে ইত্যাদি জাঁকিয়ে বসছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে বিজে‍পি শাসিত রাজ্যে অর্থাৎ ডাবল ইঞ্জিনের রাজ্যে এই প্রবণতা তীব্র।
দেশের সব শিশুকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা কোনও ভাবনা আরএসএস-বিজেপি’র নেই। বেশিরভাগ শিশু বিশেষ করে দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিশুদের ধর্মান্ধ পৌরাণিক শিক্ষার বদ্ধজলায় আটকে রাখতে চায়। তাই শিক্ষা খাতে বিশেষ করে সর্বজনীন শিক্ষা, জনশিক্ষা, সব শিশুকে স্কুলে আনার প্রকল্পে ব্যয় করতে ভীষণ রকমের অনীহা। উলটে বছর বছর এই সব খাতে একটু একটু করে বরাদ্দ ছাঁটাই হয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু বরাদ্দ পুরোপুরি বন্ধ, প্রকল্পও বন্ধ। এক্ষেত্রে কর্পোরেট হিন্দুত্বের প্রবল ছাড়। শিক্ষায় সরকারি ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ বিনামূল্যে অথবা অত্যন্ত কম মূল্যে সকলের জন্য বিশেষ করে গরিব, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার আয়োজন দ্রুত সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। বিজেপি শাসিত  অর্থাৎ ডাবল ইঞ্জিনের সরকারের দৌলতে রাজ্যে রাজ্যে নানা অজুহাতে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সরকারি স্কুল। একসময় শিশুরা যাতে স্কুলে যেতে পারে তাই গ্রামে গ্রামে সরকার স্কুল তৈরি করেছিল। এখন এক বা একাধিক স্কুল জুড়ে দিয়ে স্কুল ছুটের ব্যবস্থা হচ্ছে। শুধু উত্তর প্রদেশেই বন্ধ হচ্ছে ২৭ হাজার প্রাথমিক স্কুল। স্কুল বন্ধের দৌড়ে পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গও। গত বেশি সরকারি স্কুল বন্ধ করা সম্ভব হবে তত সরকারের শিক্ষা খাতে ব্যয় কমবে। সেই জায়গায় গড়ে উঠবে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসা। মোদী সরকার কর্পোরেটের হাতে শিক্ষাকে তুলে দিতে ছক কষে এগিয়ে চলেছে।
আর্থিকভাবে দুর্বল মেধাবী ও সম্ভাবনাময় ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যেতে সরকারের নানা ধরনের প্রকল্প আছে। সেগুলিও গুটিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। জাতীয় মেরিট কাম স্কিল স্কলারশিপ, উদ্ভাবনী শিক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ কার্যত বন্ধ। ২০২১ সাল থেকে ট্যালেন্ট সার্চ পরীক্ষা বন্ধ। ফলে প্রতি বছর দু’হাজার ছাত্র-ছাত্রী বৃত্তি থেকে বঞ্চিত। সংখ্যালঘু ছাত্র-ছাত্রীর জন্য স্কলারশিপ বন্ধ। এনওসি স্কলারশিপও বন্ধ করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সরকারি বরাদ্দ বন্ধ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্পোরেট পুঁজি ঢোকানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।
আর সবচেয়ে কুৎসিত চেহারা নিচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রে পরীক্ষা পে চর্চার নামে মোদী চর্চা ঘনঘটা। শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে। ইতিমধ্যে মোদী প্রচারে শিক্ষা বরাদ্দ থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। শিক্ষার বরাদ্দ থেকে প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করে সারা দেশে মোদীর প্রমাণ সাইজের কাটআউট সহ ১১১১টি সেলফি পয়েন্ট তৈরি হয়ে। মোদী ছবি, ভিডিও নিয়মিত প্রচার হচ্ছে পরীক্ষা পে চর্চার নামে। মন কি বাতের মতো প্রচারে খরচ হয়েছে ছ’কোটির ওপর। কোভিডের সময় অনলাইন চর্চায় খরচও ৬ কোটি টাকা। মোদীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি প্রচারে শিক্ষার কি উন্নতি হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এমনিতেই শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে। তার উপর সেই টাকায় মোদীর প্রচার হচ্ছে। এসব অনাচার অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার।

Comments :0

Login to leave a comment